Thank you for trying Sticky AMP!!

জম্পেস এক আড্ডা

প্রথম আলোর কার্যালয়ে জম্পেশ আড্ডা—যেখানে কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন জ্যোতির্ময় দত্ত ও মীনাক্ষী দত্ত।

ঢাকায় এসে জ্যোতির্ময় দত্ত ভাবলেন, এ সময়কার তরুণ সাহিত্যিকদের সঙ্গে কথা বলবেন। প্রথম আলোতেই এলেন তিনি মীনাক্ষী দত্তকে নিয়ে। রোববার সন্ধ্যায় তাঁদের সঙ্গে কথা বলার জন্য যাঁরা এলেন, তাঁরা বললেনও, শুনলেনও। আড্ডাটা হয়ে উঠল তাজা চনমনে।

জ্যোতির্ময় দত্ত ডাকসাইটে সাংবাদিক। ভারতে সাংবাদিকতা করেছেন, পরে পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। মীনাক্ষী দত্ত বুদ্ধদেব বসুর মেয়ে। তিনিও সেখানে থাকেন। প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ পরিচয়পর্ব শেষ করিয়ে দেওয়ার পর প্রথমেই জ্যোতির্ময় দত্ত ঢাকা সম্পর্কে করলেন ভূয়সী প্রশংসা। একমাত্র ট্রাফিক জ্যাম ছাড়া।

খবরের কাগজ
সাংবাদিকতা জীবনের শুরুতে অর্থকষ্টের কথা স্মরণ করলেন জ্যোতির্ময় দত্ত। কেরানিদের চেয়েও কম বেতন ছিল সাংবাদিকদের। এখন তো প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক পরিবর্তন এসেছে কাগজে। বেতন বেড়েছে। তবে ওই প্রযুক্তির কারণেই ইউরোপ আমেরিকায় ছাপা কাগজের কদর কমছে। এমনকি নিউইয়র্ক টাইমসের মতো কাগজও উঠে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে এখনো ছাপা কাগজ পড়ে মানুষ। বাংলাদেশ নতুন দেশ, শুধু অন্তর্জালে খবর দেখে তারা সন্তুষ্ট নয়।

আড্ডায় চলল ফটোসেশনও।

সাহিত্য নিয়ে

লেখকদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন এল, বাংলাদেশের সাহিত্য কি পড়া হয়?

‘খুব কম জানি। যখন সম্ভব হয়েছে, সামনে পেয়েছি, পড়েছি, অবাক হয়েছি। আল মাহমুদের কবিতা ভালো লেগেছে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এমন অনেক কিছুই করেছেন যা আমার ভালো লাগেনি, কিন্তু কবি হিসেবে তিনি খুব ভালো। ভালো লেগেছে শামসুর রাহমানের কবিতা। আর গদ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। আমার তো বয়স হচ্ছে, স্মৃতি সব সময় ঠিকভাবে কাজ করে না।’ বললেন জ্যোতির্ময় দত্ত।

জাকির তালুকদার বললেন, সাহিত্য এখন এ দেশে প্রান্তিক। কেন্দ্রীয় অবস্থায় নেই। সাহিত্যিকেরা মানুষের জন্য অতোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের দেশে হুমায়ূন আহমেদ খুব জনপ্রিয় ছিল। পশ্চিমবঙ্গে সুনীল, শক্তিরা। এখন সাহিত্যিকেরা ও রকম জনপ্রিয় হয় না। সময়টাই সে রকম নেই হয়তো। আমাদের দেশে সাহিত্য এখন প্রান্তিক অবস্থানে।

একেবারেই একমত হলেন না জ্যোতির্ময় দত্ত। বললেন, ‘উল্টো। বাংলাদেশে সাহিত্য প্রান্তিক নয়। কবিতা উৎসব দেখলাম, বইমেলা দেখলাম, পৃথিবীর কোথায় এটা এভাবে আছে? বাংলা ভাষায় কবি হওয়া একটা ব্যাপার বটে। এখন কি আমেরিকার একজন বড় কবির নাম বলতে পারবেন? কিংবা ফ্রান্সের? সেই ফ্রান্সের কথাই বলছি, যে ফ্রান্স র‍্যাবোঁ, বোদলেয়ার, মালার্মের দেশ! আমার মনে হয়, দুর্দিন, দুর্যোগ না হলে কবিতা হয় না। রুশ বিপ্লব, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তাই কবিতা হয়েছে।

নাসরীন জাহান একমত হলেন। বললেন, ‘বই পড়ার অভ্যাস আমাদের দেশে বেশি। একসময় দুই কিলোমিটারও লাইন ধরে দাঁড়িয়ে মেলায় ঢুকত মানুষ। কোটি কোটি টাকার বই বিক্রি হতো। আমাদের এখানে হয়তো ভাষা, শহীদ, একুশ—এ সবের আলাদা মানে আছে বলেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম এটা ধরে রেখেছে।’

কথাটা লুফে নিলেন জ্যোতির্ময় দত্ত। বললেন, ‘এই দেশটা তৈরিই হয়েছে স্বপ্নের ওপর, আবেগের ওপর। রাস্তায় গুলি চলেছে, মানুষ ধরাধরি করে আহত মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। এ রকম আবেগই সৃষ্টি করেছে ইতিহাস।’

আলাপচারিতায় তাঁরা।

প্রেম নিয়ে কথকতা

মীনাক্ষীর প্রেমে যখন পড়লেন জ্যোতির্ময়, তখন তিনি বাংলায় পটু ছিলেন না। দক্ষিণ ভারতে বড় হয়েছেন, তাই ইংরেজিটাই তাঁর আসত ভালো। বাংলা ভাষার একজন সেরা কবির মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছেন, তাই তিনি ইংরেজিতে কবিতা লিখে মীনাক্ষীকে দিলেন। মীনাক্ষী তা খুলেও দেখলেন না। মীনাক্ষী অবাক হলেন এই ভেবে যে, একজন বাঙালি ছেলে একজন বাঙালি মেয়েকে ইংরেজিতে কবিতা লিখে পড়তে দিচ্ছে! মীনাক্ষী বললেন, ‘বাংলায় লিখে নিয়ে এসো।’

অগত্যা! বাংলায়ই লিখে নিয়ে এলেন জ্যোতির্ময়। সে কবিতা বাবা বুদ্ধদেব বসুকেও দেখালেন মীনাক্ষী। বুদ্ধদেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছেলেটা কে?’ জ্যোতির্ময়ের এই বর্ণনায় হাসির রোল উঠল।

কেন কবিতা নয়, কেন সাংবাদিকতা?

কাজল শাহনেওয়াজ প্রশ্ন তুললেন, ‘আপনি তো কবিতার পাগল। কিন্তু সাংবাদিকতার খোলস পরে থাকলেন কেন? কবিতার সঙ্গেই তো ছিলেন। এটা কি অভিমান?’

‘না অভিমান নয়।’ বললেন জ্যোতির্ময়। ‘আমি পরীক্ষা ভালোবাসি। যে মুহূর্তে সাফল্য আসে, আমি ভয় পেয়ে যাই। যখন দেখি, ৪০ হাজার ডলার বেতন হবে, তখনই বুঝি, নতুন কিছু করতে হবে। নতুনের কাছে থাকা, সেটা অন্য এক জিনিস। কবিতায় একটা উত্তেজনা, ভয়, শঙ্কা আছে, কবিতার চেয়েও অনেক সময় অনেক কিছু তীব্র হয়ে ওঠে।’

আড্ডায় চলল ফটোসেশনও।

মীনাক্ষী বললেন নজরুলের কথা

ট্রেনে করে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসছিলেন বুদ্ধদেব বসু আর প্রতিভা বসু। সেই ট্রেনেই দেখলেন নজরুলকে। বুদ্ধদেব বললেন, ‘রানু, তোমার কবিদা!’

প্রতিভা বসু কবির সঙ্গে আলাপ করতে গেলেন, কিন্তু তখন কবি কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ।

এ কথা বলতে গিয়েই জানালেন, একসময় বনগ্রামে প্রতিভা বসুর বাড়িতে এসেছিলেন নজরুল। বাড়িতে পরিচারিকা ছাড়া কেউ ছিল না। বিফল মনরথ হয়ে ফিরে গেলেন নজরুল। আর প্রতিভা বসুরা বাড়ি ফেরার পর সেই পরিচারিকা বলেছিলেন, ‘কেষ্ট ঠাকুর এসেছিল গো!’

বুদ্ধদেব আর প্রতিভার প্রথম দেখা হয়েছিল সত্যেন বোসের বাড়িতে। এখন যেখানে প্রেসক্লাব, সেটাই ছিল সত্যেন বোসের বাড়ি। ‘মা খুবই বিখ্যাত মহিলা। গান করতেন ভালো। বাবা কাছেই বন্ধুর বাড়িতে অপেক্ষা করতেন মায়ের গান শোনার জন্য। পরে কলকাতায় তাদের আলাপ হয়।’

আলাপে আলাপে দু ঘণ্টা কখন কেটে গেল, কে জানে। উপস্থিত সাহিত্যিকেরা প্রশ্ন করলেন, উত্তর পেলেন। ফারুক মঈনুদ্দীন ক্লিনটন বি সিলির সঙ্গে পত্রালাপ নিয়ে একটি লেখাও পড়ে শোনালেন। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় আর মীনাক্ষী দত্তের অনুবাদে ‘ডা. জিভাগো’র কবিতাগুলো অনুবাদ করে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু, এল সে প্রসঙ্গ। শাগুফ্‌তা শারমীন তানিয়ার প্রশ্নের জবাবে মীনাক্ষীর কণ্ঠে কারিনা, শাহরুখের দাপটে বাংলা ভাষার হাল নিয়েও আক্ষেপ প্রকাশ পেল। বাবা বুদ্ধদেব বসুর কাছে আসা কবিতার চিঠির খাম খুলে দিতেন মীনাক্ষী, সে কথাও তিনি স্মরণ করলেন। আজ থেকে ১০ বা ৫০ বছর পর বাংলাদেশ বা বাঙলা ভাষার অবস্থা কী হবে, তা নিয়েও কথা হলো।

তারপর একসময় বোঝা গেল, ফেরার সময় হয়েছে।

এই চমৎকার আড্ডায় আরও ছিলেন আবুল হাসনাত, শাহনাজ মুন্নী, পিয়াস মজিদ, পারভেজ হোসেন, শামসেত তাবরেজী, সোহরাব হাসান, আনিসুল হক, মশিউল আলম, জাফর আহমদ রাশেদ, আলতাফ শাহনেওয়াজ প্রমুখ।