Thank you for trying Sticky AMP!!

ঠগির দল ও হেনরি স্লিম্যানের অভিযান

শিল্পীর তুলিতে ঠগিদের ডাকাতি: কয়েকজন ভুলিয়ে রেখেছে পথচারীকে। একজন ঠগি তার পেছনে গিয়ে গামছার ফাঁস ঠিক করছে

১৮০৯ সাল। তরুণ উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান ইংল্যান্ড থেকে বাংলায় এলেন অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। সৈনিক হিসেবে যোগ দিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে। অভাবিত উন্নতি করলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎই কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ লাইব্রেরিতে পাওয়া পুরোনো একটি বই এলোমেলো করে দিল এই ইংরেজের জীবন।

বইটির লেখক এম থিভেনট নামে এক ফরাসি পর্যটক। এ বইয়ের প্রতিটি ছত্রে আছে ঠগি নামের ভয়ংকর খুনিদের অজানা গল্প। গল্প নয়, একেবারে সত্য ঘটনা। বইটি প্রায় এক শ বছরের পুরোনো।

স্লিম্যান বইটি পড়েন। মনে প্রশ্ন জাগে তাঁর, এখনো কি আছে ঠগিরা? না-ই যদি থাকবে, তবে তাদের দমন করল কে?

ঠগি আছে গোটা বাংলায়, ভারতজুড়েই। শহরের অলিতে-গলিতে, বিজন মরুভূমিতে, নদীতে, পাহাড়ে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ধর্ষ খুনির দল। কিন্তু স্লিম্যান ছাড়া কেউ বিশ্বাস করেন না এ কথা। তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করে লোকজন। বলে, ঠগি হয়তো কোনো এক কালে ছিল ভারতবর্ষে, তবে গত এক শ বছরে তাদের কোনো আলামত তো পাওয়া গেল না, এখন এটা কী বলছেন এই সাদা ইংরেজ, আশ্চর্য তো!

হাল ছাড়লেন না স্লিম্যান। তক্কে তক্কে থাকলেন। একসময় উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদের কালেক্টর অফিসে তিনি পেলেন ডা. রিচার্ড শেরউডের লেখা ১৭৯৯ সালের ঠগিদের নিয়ে একটি পাণ্ডুলিপি। ঠগিরা নেশার মতো পেয়ে বসল তাঁকে। ঠগিদের সম্পর্কে নানা গল্প ও বিভিন্ন তথ্য জানলেন তিনি। যেমন ঠগি দলে লোকবল থাকে কয়েক শ পর্যন্ত। পথে বেরিয়ে তারা ভাগ হয়ে যায় ছোট ছোট দলে। একেক দল একেক ছদ্মবেশ নেয়। কোনো দল তীর্থযাত্রী, কোনো দলকে দেখে মনে হয় সাধারণ ব্যবসায়ী। হাটে, ঘাটে, মেলায় কিংবা তীর্থস্থানে ওরা পরখ করে লোকজনকে। খোঁজখবর নেয়। যদি বোঝে কারও কাছে টাকা কিংবা মূল্যবান জিনিস আছে, নিঃশব্দে অনুসরণ করে তাকে। তারপর দুর্গম কোনো পথে ঠগির দলটা দেখা দেয় বন্ধুবেশে।

রাস্তায় কত বিপদ-আপদ। তাই দল ভারী হলে বড্ড সুবিধা। হতভাগা পথচারীরা ঘুণাক্ষরেও টের পায় না বন্ধুবেশে তাদের পিছু নিয়েছে ভয়ংকর খুনির দল। ধীরে ধীরে দুই দলের মধ্যে সৌহার্দ্য হয়। একসঙ্গে খাবার ভাগ করে খায়। গান-বাজনা চলে। তারপর হঠাৎ আক্রমণ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হতভাগ্যদের গলায় পেঁচিয়ে যায় ঠগিদের গামছার মরণ ফাঁস। তারপর গোটা দলটিই যেন মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। কেউ তাদের খোঁজ পায় না। অস্ত্র বলতে তাদের থাকে এক টুকরা গামছা। গামছার এক কোনায় বাঁধা থাকে এক টুকরা পাথর কিংবা দুটি তামার পয়সা। সুযোগ বুঝে হতভাগ্য পথচারীদের গলা লক্ষ্য করে ছুড়ে মারে সেটা। গলায় পেঁচিয়ে যায় গামছা। তখন হ্যাঁচকা টানে শুইয়ে ফেলা হয় পথচারীকে। এরপর চার-পাঁচজন তার পিঠে চেপে বসে মৃত্যু নিশ্চিত করে। কখনো কখনো গামছার বদলে ব্যবহার করা হয় দড়িও।

এই ঠগিদের সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্যই একসময় সৈনিকের চাকরি ছেড়ে সিভিল সার্ভিসে যোগ দিলেন স্লিম্যান। ১৮২২ সাল। গভর্নর জেনারেলের এজেন্ট হয়ে তিনি গেলেন মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে। তত দিনে ওই বই আর পাণ্ডুলিপি থেকে ঠগিদের চালচলন, আচরণ অনেকটাই জেনে গেছেন, জেনেছেন তাদের নিজস্ব ভাষা সম্বন্ধেও।

নিকট অতীতের অনেক ঘটনা স্লিম্যান মন দিয়ে শুনেছেন স্থানীয় লোকদের কাছে। খতিয়ে দেখেছেন কোনো ঘটনার সঙ্গে মেলানো যায় কি না ঠগিদের যোগসূত্র।

একদিন অফিসে বসে স্লিম্যান ভাবছিলেন ঠগিদের কথা। বাইরে ছিল একদল তীর্থযাত্রী। তাদের দেখে তাঁর মনে হলো, এরা ঠগি নয়তো? তারপর আবার ডুবে গেলেন ভাবনায়। হঠাৎ একজনের ডাকে সংবিৎ ফিরল। স্লিম্যান চোখ তুলে দেখলেন দাঁড়িয়ে আছে কল্যাণ সিং। এই কল্যাণ সিংকে তিন মাস আগে জেলে পাঠিয়েছিলেন। লোকটা কোম্পানির এক আস্তাবলে কাজ করত। ঘোড়ার খাবার চুরির অপরাধে জেল হয় তার। বড্ড গরিব। তাই তার পরিবারকে দেখেশুনে রেখেছিলেন স্লিম্যান। এ জন্য লোকটা তাঁকে ধন্যবাদ দিতে এসেছে। কল্যাণ সিংকে স্লিম্যান কিছুক্ষণ আগে দেখেছেন ওই তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে।

‘তুমি বদ লোকের সঙ্গ নিয়েছ কল্যাণ সিং।’ আন্দাজে ঢিল ছুড়লেন স্লিম্যান। তারপর ঠগিদের কিছু মুখস্থ স্বভাবের কথা বললেন। ভয় পেয়ে গেল কল্যাণ সিং। ভাবল, দেবতা ছাড়া কারও পক্ষে এসব তো জানার কথা নয়। স্বীকার করে ফেলল সবকিছু। একে একে বলে গেল অনেক রোমহর্ষক কাহিনি। তখন স্লিম্যানকে আর পায় কে!

ঠগিদের নির্মূল করা উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান


দুই
ভারতজুড়ে বিশাল এক যোগাযোগ-বলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল ঠগিরা। বংশপরম্পরায় তারা বেছে নিত এই পেশা। ঠগির ছেলে তাই ঠগিই হতো। ওদের বিয়ে, আত্মীয়তা সব ছিল ঠগিদের মধ্যেই। বেশির ভাগ ঠগির স্ত্রী-সন্তানেরা জানত না তাদের স্বামী বা পিতা কী করে।

সরকারি কর্মচারীদের ওপর চড়াও হতো না ঠগিরা, ক্ষতি করত না কোনো সাদা চামড়ার মানুষের। এ কারণে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে শত শত বছর ধরে নিঃশব্দে পথচারীদের গায়েব করতে পেরেছিল ওরা।

কুসংস্কারই ওদের ভয়াবহ খুনি বানিয়েছিল। ঠগিদের বিশ্বাস, ওরা দেবী ভবানীর সন্তান। ভবানী মানে কালী। ওদের বিশ্বাস, তারা নিজেরা মানুষ মারে না। মা ভবানীই ঠিক করেন কে ঠগিদের হাতে মরবে। তাই ওসব মানুষকে মেরে ফেলা ওদের দায়িত্ব। নইলে মায়ের নির্দেশ অমান্য করা হবে যে! স্লিম্যানের হিসাব অনুযায়ী গোটা ভারতে হিন্দু-মুসলমান ঠগিদের সংখ্যা ছিল সমান সমান। মুসলমান ঠগিরা তাদের ধর্মের সব আচার-আচরণ যেমন মেনে চলত, একইভাবে মানত ভবানীকে; মানত ঠগিদের কুসংস্কারও।

 স্লিম্যান মনে করতেন, বাইরে থেকে যতই আলাদা মনে হোক, গোটা ভারতবর্ষে মাকড়সার জালের মতো ছেয়ে আছে ঠগিদের একটাই দল। একদিন এক বন্ধুকে তিনি বলেছিলেন, ‘একবার একজন ঠগি ধরা পড়লে ওদের জালে টান পড়বে, সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে সব ঠগি।’ হয়েছিলও তাই। কল্যাণ সিং ধরা পড়ার পর মাত্র ২৬ বছরে গোটা ভারত থেকে নির্মূল হয়ে গিয়েছিল এই ভয়ংকর খুনির দল। দেশ উজাড় করে ঠগ বেছে ফেলেছিলেন স্লিম্যান।

কল্যাণ সিংকে নিয়ে স্লিম্যান নামেন ঠগি শিকারে মাঠে। একটা করে দল ধরেন আর ফাঁসিতে ঝোলান। প্রতিটি দল থেকে দু-একজনকে বেছে নিয়ে রাজসাক্ষী বানাতেন। তাদের মাধ্যমেই মিলত দলের বাকি সদস্যদের খবর। তবু ঠগিদের ধরা অত সহজ ছিল না। অতঃপর ঠগি ধরতে স্লিম্যান অবলম্বন করলেন ঠগিদের পন্থা, ঠগি ধরার বিশাল একটা দল তৈরি করেন তিনি। তারা ব্যবসায়ী কিংবা পথচারীদের ছদ্মবেশে পথে পথে ঘুরে বেড়াত। ঠগির দলকে অনুসরণ করত। আর ঠগিরা ভাবত, নতুন কোনো মক্কেল বুঝি পা দিয়েছে তাদের ফাঁদে। ওদিকে স্লিম্যানের পুলিশ বাহিনী দূরত্ব বজায় রেখে অনুসরণ করত আগের দলটাকে। যে-ই দেখত ঠগিরা তাদের ফাঁদে পা দিয়েছে, অমনি তারাও এসে হাজির। ঘিরে ফেলত গোটা দলকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঠগিদের আশ্রয় হতো জেলে।

ঠগিরা যখন ধরা পড়তে শুরু করল, তখন ওদের ভেতরে ভর করল একধরনের আতঙ্ক। ওরা বিশ্বাস করতে শুরু করল, মা ভবানী তাদের ওপর রুষ্ট হয়ে ওদের ছেড়ে চলে গেছেন। নিশ্চয়ই তিনিই স্লিম্যানকে পাঠিয়েছেন ওদের শায়েস্তা করতে। ঠগিদের এই বিশ্বাস সহজ করে দিয়েছিল স্লিম্যানের কাজ। রসন জমাদার, এনায়েত, রুস্তম খাঁ, ফিরিঙ্গিয়া, বুকুত জমাদারের মতো দুর্ধর্ষ ঠগি-সর্দারকে রাজসাক্ষী বানিয়েছিলেন স্লিম্যান। ওদের মুখ থেকেই শুনেছিলেন রক্ত হিম করা ওদের ডাকাতির গল্প। সেসব গল্প তিনি লিখে গেছেন দ্য থাগস অর ফাঁসিগারস অব ইন্ডিয়া বইতে। সেটিই আজ ঠগিদের দুর্ধর্ষ জীবনের অকাট্য দলিল।

ডাকাতির পর নির্মমভাবে পথচারীকে খুন করছে ঠগিরা


পূর্ব বাংলার ঠগিরা
আমাদের পূর্ব বাংলা চিরকালই নদী-নালার দেশ। এ দেশে স্থলপথে চলার চেয়ে জলপথে চলার সুবিধাই বেশি। জলপথে ঠগিদের সুবিধা অনেক। খুব সহজেই লাশ পানিতে ফেলে কাজ হাসিল করা যায়। জলের এই ঠগিদের নাম পাঙ্গু। সুবন জমাদার নামে এক কুখ্যাত পাঙ্গু ঠগি ধরা পড়ে স্লিম্যানের লোকদের হাতে। সুবন ময়মনসিংহ থেকে রংপুর, সিরাজগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুর, মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তুলেছিল তার পাঙ্গু বাহিনী। আর ছিল ঠ্যাঙাড়ে। এরা গামছার বদলে ব্যবহার করত মুগুর। মগুরপেটা করে পথচারীদের হত্যা করত এরা। ধাতুরিয়া নামে আরেকটা দল ছিল। পথিকদের তারা মারত ধুতরার বীজ থেকে তৈরি বিষ দিয়ে।