Thank you for trying Sticky AMP!!

নজরুলের প্রণয় ও পরিণয়

>

বইমেলায় প্রকাশিত নির্বাচিত  বইয়ের পাণ্ডুলিপি থেকে অংশবিশেষ

বহরমপুর থেকে যাত্রা করে নজরুল কান্দিরপাড়ে (কুমিল্লায়) পৌঁছে গিয়েছিলেন পরের দিনই—১৯ ডিসেম্বর (১৯২৩)। তিনি যেমন ত্বরিতগতিতে ছুটে গিয়েছিলেন, ধারণা করি, আশালতাও (অবিবাহিত অবস্থায় প্রমীলার নাম) তেমনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ছিলেন তাঁর জন্য। এ সময় আশালতার বয়স ছিল মাত্র পনেরো বছর সাত মাস হয়ে কয়েক দিন। [...] ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কবি যখন ‘বিদ্রোহী’র ঝান্ডা উড়িয়ে বিজয়ীর বেশে কান্দিরপাড়ে এসেছিলেন এবং একনাগাড়ে প্রায় চার মাস সেখানে ছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল আরও কম—চৌদ্দ বছরও পুরো হয়নি। কিন্তু বিশ্বজয় করে এলেও নজরুল সেই কিশোরীর প্রেমেই পড়েছিলেন এবং বিদ্রোহের পতাকা ‘বিজয়িনী’ দোলনের চরণতলে অর্পণ করে হার স্বীকার করেছিলেন। মুজফ্ফর আহ্‌মদ তো লিখেই ছিলেন যে, আফজালুল হকের মতে আশালতা এবং নজরুলের বিবাহ স্থির হয়েই গিয়েছিল। বিয়ে হয়নি, তবে পাত্রপাত্রী উভয়ে সেই সংকল্প নিয়ে থাকলেন।

এবারে নজরুল কুমিল্লায় আসেন প্রায় ১৩ মাস কারারুদ্ধ থাকার পর। তাঁর বিচার, সাজা এবং জেলে থাকার সময়ে অনশনকে কেন্দ্র করে পত্রপত্রিকায় তাঁকে নিয়ে লেখালেখি হয়েছিল বিস্তর। বিদ্রোহী কবি হিসেবে তাঁর খ্যাতিও বৃদ্ধি পেয়েছিল। [...] তাঁর অনশন ভাঙাতে গিয়ে বিরজাসুন্দরী দেবীও (প্রমীলার ছোট চাচি) জনপরিচিতি লাভ করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবে নজরুলকে তাই উষ্ণতার সঙ্গেই সেনগুপ্ত পরিবারের গ্রহণ করার কথা ছিল। কিন্তু আগেরবার মুসলমান যুবক নজরুলের সঙ্গে হিন্দু তরুণী দোলনের (আশালতা ওরফে প্রমীলাকে পরিবারে ডাকা হতো দোলন নামে) সম্পর্ক নিয়ে কুমিল্লার হিন্দু সমাজে নিন্দা-অপবাদের যে ঝড় উঠেছিল, এমনকি নজরুলকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার যে চেষ্টা চলেছিল, সে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এবারের আগমনকে সেনগুপ্ত পরিবার কতটা উষ্ণতার সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছিল, সেটা আমরা কেবল অনুমান করতে পারি। অসম্ভব নয় যে, দোলনের পরিবারের একাংশ আগেরবারের নিন্দা-অপবাদের কথা মনে রেখে—কবির প্রতি শীতল ব্যবহার করেছিল।

অপর পক্ষে, গিরিবালা দেবীর স্বামী ছিলেন না, দোলন ছাড়া তাঁর অন্য কোনো সন্তানও ছিল না। তিনি ছিলেন নিঃস্ব এবং অসহায়। সকন্যা তিনি আশ্রয় পেয়েছিলেন দেবরের বাড়িতে। পরিবারে তাঁর প্রতি কতটা সম্মান দেখানো হতো, জানা যায় না, কিন্তু কন্যার প্রতি সেই সহায়-সম্বলহীন গিরিবালার দুর্বলতা কিছু বেশিই ছিল। [...]

...নজরুলের প্রতি সন্তানের গভীর প্রণয় লক্ষ করে তাঁকে তিনি দৃঢ়ভাবে নৈতিক সমর্থন জানান বলে মনে হয়। সেনগুপ্ত পরিবারের এই সম্ভাব্য অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে নজরুল এবারে কান্দিরপাড়ে ছিলেন বড়জোর সপ্তাহ দুয়েক। তার থেকে কমও হতে পারে। আগে যতবার বেড়াতে এসেছিলেন, কোনোবারই এত কম সময় থাকেননি। এবারে কান্দিরপাড় ত্যাগ করার পর তিনি আর কখনো কান্দিরপাড়ে ফিরে যাননি। [...]

সে যাই হোক, কান্দিরপাড়ে তাঁর অল্প দিন থাকাটা কেবল সেনগুপ্ত পরিবার কতটা অন্তরঙ্গতার সঙ্গে তাঁকে গ্রহণ করেছিল, কেবল তার ওপর নির্ভর করছিল না। এবারেও রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ দোলনের সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক নিয়ে তাঁকে অপমানিত করতে চায়। তাই ঢাকঢোল না পিটিয়ে তিনি নীরবে কান্দিরপাড় ত্যাগ করেন। [...]

আশালতা সেনগুপ্তের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে হবে—এপ্রিলের প্রথম দিকেই এমন খবরাখবরও প্রকাশিত হতে থাকে। জনৈক কমরুজ্জামান ছোলতান পত্রিকায় লেখেন, ‘সংবাদপত্র পাঠে জানিতে পারিলাম যে, বাঙ্গালার নবযুগের তরুণ কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছাহেবের সহিত জনৈক বিদুষী সম্ভ্রান্ত হিন্দু মহিলার শুভ-বিবাহ স্থির হইয়াছে।’এ কথা লেখা হয় ১১ এপ্রিলের (১৯২৪) পত্রিকায়। তার অর্থ অন্য সংবাদপত্রে এ খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল তারও আগে। মনে হয় তখন থেকেই বিয়ের আয়োজন চলতে থাকে। কোথায় বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে, বিয়েতে কারা থাকবেন, সেখানে খাওয়া-দাওয়া কী হবে, বিয়ে কে পড়াবেন ইত্যাদি খুঁটিনাটি ছিল এর মধ্যে। এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা আগে থেকে শুরু হয়েছিল, কারণ এ বিবাহটি আর পাঁচটা বিয়ের মতো সরল-সহজ ছিল না।


সে জন্য কেবল বিয়ের আয়োজনের কথা কবির মাথায় ছিল না, তার চেয়েও উদ্বেগের বিষয় ছিল, সামাজিক এবং পারিবারিক বাধা। নিজের দিক থেকে কোনো বাধা ছিল না তাঁর। কারণ, আত্মীয়দের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু আশালতার পরিবার প্রবল বাধা দিয়েছিল—গোটা পরিবারই। কুমিল্লার হিন্দু সমাজ যে তীব্র প্রতিকূলতার সৃষ্টি করেছিল, তা বলা বাহুল্য। সেনগুপ্ত পরিবারকে একঘরে করা হবে, সে কথাও কি ওঠেনি? এই পরিবেশে আশালতার খুড়তুতো দাদা বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত, যাঁর নামে নজরুল যুগবাণী গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন, সেই ‘রাঙা দা’ বৈকালী পত্রিকায় রীতিমতো লিখিতভাবে এ বিয়ের বিরোধিতা করেছিলেন। [...] কিন্তু এসবের মধ্যে একমাত্র ইতিবাচক বিষয় ছিল আশালতা এবং গিরিবালা দেবী এ বিয়েতে পুরোপুরি সম্মত ছিলেন এবং পরিবারের বন্ধন ছিঁড়ে অনেক আগেই (খুব সম্ভব জানুয়ারির শুরুতে) তাঁরা দূরে সরে এসেছিলেন।

অপর পক্ষে, বেহিসেবি নজরুল নিজের আসন্ন বিবাহের আবশ্যকীয় আয়োজন অসম্পন্ন রেখে ১৭ এপ্রিল বহরমপুরে যান নলিনাক্ষ সান্যালের বিয়েতে যোগ দিতে। [...]বহরমপুরে বিয়ের পালা শেষ করে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন বলে মনে করা সংগত। ফিরে এসে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নিজের বিয়ের আয়োজন নিয়ে। বিরজাসুন্দরী দেবী নজরুলকে সত্যি সত্যি ছেলের মতো ভালোবাসতেন। তা সত্ত্বেও এ বিয়ে ঠেকানোর জন্য শেষ মুহূর্তে তিনিও কলকাতায় এসে দোলন এবং তাঁর মাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গিরিবালা দেবী এবং আশালতার দৃঢ়তার মুখে তিনি তা পারেননি। [...]

বিরোধিতা সত্ত্বেও, আশালতা এবং তাঁর মায়ের দৃঢ়তার মুখে কোনো আপত্তি টিকতে পারেনি। তবে তাঁদের দৃঢ়তা দেখানো ছাড়া অন্য উপায়ও ছিল না।

মুসলমান সমাজে, এককথায় বললে, বিয়ের সরাসরি বিরোধিতা করেনি। কিন্তু পত্রপত্রিকায় আশা প্রকাশ করা হয়েছিল যে, অতঃপর এই হিন্দু নারী ইসলাম ধর্মীয় গ্রন্থের বিধিবিধান স্বীকার করে নেবেন এবং তাতে বিশ্বাস স্থাপন করবেন। ধারণা করা হয়েছে যে, ইসলাম ধর্মের মূলমন্ত্র তিনি নিজের জীবনে পালন করবেন।

কিন্তু এ বিয়েতে সামাজিক বিরোধিতার চেয়েও ঢের বড় রকমের বাধা ছিল আইনের। প্রমীলা হিন্দু, নজরুল মুসলমান। এঁদের বিয়ে হবে কোন আইন অনুসারে? একটা অত্যন্ত সহজ সমাধান ছিল: আশালতা যদি মুসলমান হয়ে যেতেন। কিন্তু কেন হননি, জানা যায় না। সেকি তাঁর নিজের নাকি তাঁর মায়ের আপত্তিতে, নাকি স্বয়ং কবির বিরোধিতায়, বলা কঠিন।