Thank you for trying Sticky AMP!!

নিমজ্জনের গল্প

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমি জানি, আমার বয়স তখন চৌদ্দ। হ্যাঁ, আমি এটি নিশ্চিতভাবে জানি। আমি আরও জানি, অনেকেই অনেক বেশি কথা বলে, বিশেষত ওই আমেরিকান লোকটি, যিনি কথা বলা শুরু করলে আর থামতে চান না। এবং যখনই তোমাকে নিয়ে কথা বলেন সে কথার শেষ হয় হাস্যরস কিংবা তাচ্ছিল্য দিয়ে। এটি সত্যিই অদ্ভুত লাগে, কীভাবে তিনি অচেনা-অজানা-অখ্যাত কিছু মানুষের নামের পাশে তোমার নাম জুড়ে দেন! লোকটির নাম অ্যালেন্ডে লুমুম্বা। নামটি শোনামাত্র এমন একটি দেশের নাম মনে হয়, যেখান থেকে কুন্তা কিন্তে (ঐতিহাসিক চরিত্র, এই নামের একটি চরিত্র আমেরিকান লেখক অ্যালেক্স হেলের রুটস উপন্যাসে আছে) এসেছিলেন। আমেরিকান ভদ্রলোক সব সময়ই তাঁর চোখ কালো রোদচশমায় ঢেকে রাখেন। দেখলে মনে হয়, এখানকার কালো মানুষদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু শেখানোর জন্য আমেরিকা থেকে একজন সন্ত এসেছেন। মহল্লায় থাকা কিউবান ও আমেরিকান—দুজনের মিল একেবারে গলায়-গলায়। দুজন একসঙ্গে থাকার সময় একজন কথা বললে অন্যজন চুপ থাকেন। কিউবান ভদ্রলোক বন্দুককে তেমন পাত্তা দেন না। তিনি বলেন, বন্দুক নিজেকে নিজে অপরিহার্য করে না তুললে এর কোনো দাম নেই।
এবং জানি, একটি ছোট্ট নড়বড়ে খাটে ঘুমিয়ে অভ্যস্ত ছিলাম আমি। আমি এ-ও জানি, আমার মা ছিলেন একজন পতিতা আর বাবা ছিলেন এই বস্তির সর্বশেষ ভালো মানুষ। এখন থেকে দিনকয়েক আগে প্রথমবারের মতো তোমার হোপ রোডের বিশাল বাড়িটি আমি দেখেছিলাম। একবার, একবারই তুমি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলে। মনে হচ্ছিল তুমি মহান যিশু, আর আমরা ইসকেরিউট। তোমার মাথা নাড়ানোর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, তুমি বলছ, যাতে তোমার সঙ্গে আমরা থাকি; এবং নিজের মতো করে তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাবে। এক টুকরো কাঁঠাল খেতে খেতে পেছনের বারান্দা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলে তুমি। তোমার চলে যাওয়া আমি দেখেছি কি না মনে করতে পারছি না, তবে আমার পাশে থাকা অনেকেই দেখেছিল। এক নারী উঠোনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল তোমার জন্য। আমি জানি, নারীটি হন্তদন্ত হয়ে বের হচ্ছিল ঘর থেকে, মনে হচ্ছিল, ওই মধ্যরাতেও বাইরে কোনো জরুরি কাজ ছিল তার। তোমার অনাবৃত শরীর দেখে হতবাক হয়েছিল সেই নারী। ধীরে ধীরে সে তোমার দিকে এগিয়ে গেল। বলতে পারো, কাঁঠালের আশায়। বলে রাখি, রাস্টা নারীদের বেশ্যা হয়ে যাওয়াকে খুবই অপছন্দ করত। যা হোক, তোমাদের দুজনের মধ্যেই মধ্যরাতের উচ্ছ্বাস দেখা গেল। তোমাদের উচ্ছ্বাস দেখে আমিও খানিকটা উচ্ছ্বসিত হলাম। পরবর্তী সময়ে এই উচ্ছ্বাস নিয়ে একটি গানও লিখছিলে তুমি।
আট নম্বর লেনের এই বস্তি কিংবা কোপেনহেগেন শহরে আপনার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত সব ঘটনা না দেখে উপায় নেই। রেডিও থেকে মিষ্টি গলার স্বর ভেসে আসছে। বলা হচ্ছে, অরাজকতা, সন্ত্রাস আর জুলুমে দেশ ছেয়ে গেছে। আদৌ যদি কোনো পরিবর্তন আসে, তবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সত্যিই তো এই আট নম্বর লেনে বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা আর অপেক্ষা করা ছাড়া কী-ইবা করার আছে। আমি বসে বসে দেখেছি। দেখছি, নর্দমার ময়লা পানি উপচে রাস্তা ভরে যাচ্ছে। অপেক্ষা করছি, দেখা যাক কী হয়। দেখছি, মা ২০ ডলারের বিনিময়ে দুজন পুরুষের সঙ্গে রাত কাটাতে চলে যাচ্ছেন। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়। আজকাল মাকে নিয়ে বাবা তেমন চিৎকার-চেঁচামেচি করেন না। বাবা তাঁকে কুকুরের মতো পেটাতে পেটাতে ক্লান্ত। দেখি, একটি কামরায় সাতজন পুরুষ ও একজন গর্ভবতী নারী। জৈবিকতার ঠাঁই এখানে সবকিছুর ওপরে। মানুষ এখানে এতটাই দরিদ্র যে লজ্জাটুকু কেনার সামর্থ্য তাদের নেই। আমি অপেক্ষা করছি।
এবং ছোট কামরা দিনে দিনে আরও ছোট হচ্ছে। কারণ, গ্রাম থেকে ভাই-বোন-আত্মীয় এসে শহরে ঢুকছে। শহর বড় হচ্ছে। অবস্থা এমন, অদূর ভবিষ্যতে পা ফেলার জায়গাই পাওয়া যাবে না; হতে পারে অবশিষ্ট একটি মুরগিও এ তল্লাটে থাকবে না রান্না করে খাওয়ার জন্য। এমনকি ছোট একটি মেয়েও ছুরিকাঘাতে মারা যেতে পারে। কারণ, বস্তির লোকেরা জানে প্রতি মঙ্গলবার দুপুরের খাবারের জন্য মেয়েটি অল্প পয়সা পায়। আমার মতো বালকদের বয়স বাড়ছে। তারা স্কুলে নিয়মিত যায় না। ডিক ও জেনের গল্প জানে না তারা। তবে কোকাকোলা চেনে। না পারলেও গান লিখতে চায়, সুর করতে চায়—গাইতে চায় জনপ্রিয় গান। চায় এই বস্তির বাইরে নিজেদের নাম ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু আট নম্বর লেন বা কোপেনহেগেন এমন একটি শহর—যতই আপনি এর শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে চান, পারবেন না। কারণ, প্রান্ত ছায়া হয়ে সামনে দাঁড়াবে আপনার। অপেক্ষা করুন।
আমি জানি, তুমি ক্ষুধার্ত। অপেক্ষা করছ। জানি, ভাগ্য তোমাকে নিয়ে খেলছে। স্টুডিওর চারপাশে ঘুরছো। ডেসমন্ড ডেকার স্টুডিওর ওই লোককে বলছেন, তোমাকে যাতে একটি সুযোগ দেন। সে ব্যক্তি তোমাকে সুযোগ দিয়েছে। না দিয়ে উপায় নেই। কারণ, তোমার গলায় তুমি ধারণ করেছ এ জাতির নিপীড়নের চিত্র। তোমার কণ্ঠে গাওয়া প্রথম গানটি হিট হয়নি। তাতে কী? আমরা তোমার মতো জেগে ওঠার স্বপ্ন দেখেছি, কথা বলতে চেয়েছি তোমার মতো করে। আবার মহল্লার অনেকে তোমাকে দেখতে চেয়েছে ব্যর্থ হিসেবে।
মনে আছে, আমেরিকার দেলাওয়ার থেকে ফিরে আসার পর তুমি স্কা-ধারায় (একটি সংগীত ধারা, যা গিটার ও পিয়ানোর মিশ্রণে বাজানো হয়) গান তৈরির চেষ্টা করলে, অথচ স্কা ইতিমধ্যে মহল্লা ছেড়ে শহরের ভদ্র পল্লিতে চলে গেছে। তত দিনে স্কা প্লেনে চড়ে বিদেশের পথে। সাদা চামড়ার লোকদের তার শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে চায় স্কা। হতে পারে স্কা-এর প্রতি লেবানিজ বা সিরীয়দের দুর্বলতা আছে; কিন্তু আমরা যখন লেবানিজ বা সিরীয়দের বিমানবালাদের সঙ্গে পোজ দিতে দেখি, তখন গর্বিত হই না, বরং বোকা বনে যাই। যা হোক, তুমি এরপর আরেকটি নতুন গান বানিয়েছ। এবারে এটি খুব হিট। কিন্তু একটি জনপ্রিয় গান তোমাকে এই মহল্লার বাইরে পা ফেলতে খুব একটা সাহায্য করবে না।
এদিকে আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। ধর্মপ্রচারক বলেন, প্রত্যেক মানুষের হৃদয়েই একটা শূন্যতা আছে, তবে এই মহল্লার লোকেরা শূন্যতা দিয়ে শূন্যতা পূরণ করে অভ্যস্ত। তাদের গণ্ডি এতটুকুই। এসব কথা থাক।
১৯৭২ সাল ১৯৬২ থেকে ভিন্ন। মানুষ এখনো গুঞ্জন করে যে তারা কখনো উচ্চ স্বরে বলতে পারেনি, আর্টি জেনিংসের আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্বপ্নও উবে গেছে। কিসের স্বপ্ন তা আমি জানি না। কেবল জানি, এখানকার মানুষ নির্বোধ। তারা স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের তফাত জানে না। তবে ভালো জীবনের আশায় আরও বেশি মানুষ মহল্লায় স্থায়ী আবাস গড়তে থাকল। কারণ, ডেলরয় উইলসন গাইছে, ‘সুদিন আসবেই’। যে লোকটি আজ বাদে কাল প্রধানমন্ত্রী হবেন, তিনিও গলা মেলাচ্ছেন উইলসনের সঙ্গে। চারিদিকে একই ধ্বনি—‘সুদিন আসবেই’। যে মানুষটি দেখতে সাদা চামড়ার মানুষের মতো অথচ আচরণ নিগ্রোদের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য ব্যক্তিটির সমান, তার মুখেও ‘বেটার মাস্ট কাম’; যে নারীর বেশ-ভূষা রানির মতো এবং যে কখনো মহল্লার জীবন নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবে না, তার কণ্ঠেও সুদিনের গান।
অথচ এল খারাপ দিন।
আমরা দেখছি আর অপেক্ষা করছি। দুজন লোক মহল্লায় বন্দুক নিয়ে এল। তাদের একজন আমাকে বুঝিয়ে দিল কীভাবে এটি ব্যবহার করতে হয়। তবে এর বহু আগ থেকেই মহল্লায় মানুষ মারার চল আছে। লাঠি, ছুরি, ধারালো দা প্রভৃতি আছে মহল্লার ঘরে ঘরে। খাবারের জন্য খুন, টাকার জন্য খুন—এসব নিত্যকার ঘটনা। এমনকি একজনের তাকানোর ধরন আরেকজনের কাছে ভালো লাগছে না বলে খুনের ঘটনা ঘটেছে—এমন নজিরও নতুন নয় এখানে। এটিই আমাদের মহল্লা। এখানে মানুষ মারতে কারণ লাগে না। কারণ খোঁজে ধনী লোকেরা; আমাদের আছে উন্মাদনা, পাগলামি।
শহরের এই অভদ্র প্রান্তে উন্মাদনা কেবলই বাড়ে। কোনো নারীর পোশাকে একটু আধুনিকতার ছোঁয়া থাকলে দৌড়ে কাছে গিয়ে তার ব্যাগ, টাকা ছিনিয়ে নেওয়া এখানকার পাগলামির মধ্যে পড়ে। শুধু তা-ই নয়, তার ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়াটাও স্বাভাবিক; কিংবা চোখের সামনে তাকে হত্যা করাটাও অস্বাভাবিক নয়। এমনকি তাকে হত্যার আগে কিংবা পরে যখন খুশি ধর্ষণ করা যায়। এখানকার অসভ্য বালকেরা এসবই করতে ভালোবাসে।
শুধু কি তাই! পাগলামি তোমাকে কিং স্ট্রিট থেকে স্যুট-বুট পরে বের হওয়া কোনো ধনী লোককে পেছন থেকে অনুসরণ করতেও সাহস জুগিয়েছে। দূর থেকে দেখছ, লোকটি কীভাবে একটি স্যান্ডউইচ ছুড়ে মারে এবং ভাবছ, মানুষ কেমন করে এত ধনী হয়। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছ, দুটি পাউরুটির মাঝখানে কীভাবে একটি মাংসের টুকরো ঢুকিয়ে রাখা হয়। নর্দমায় ফেলে দেওয়া স্যান্ডউইচের অবশিষ্ট অংশের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবছ, আচ্ছা, হাড় ছাড়া মাংস খেতে কেমন! যা হোক, তুমি নিজেকে পাগল না-ও ভাবতে পারো। তবে আমি জানি, তোমার পাগলামিতে লুকিয়ে আছে প্রচণ্ড ক্ষোভ। আমি জানি, লোকটি তোমাকে দেখানোর জন্যই খাবার ছুড়ে মেরেছে। তাই হয়তো মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছ, একদিন অসভ্য বালকের মতো ছোরা নিয়ে ঘুরবে; কিন্তু তোমার এ অবস্থা দেখে আমি ঠিক থাকতে পারিনি। ফলে পরক্ষণেই দৌড়ে গিয়ে ওই লোকটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছি।
লোকটি জানে, আমার মতো ছেলে শহরের এই ভদ্র প্রান্তে বেশিক্ষণ ঘোরাঘুরি করতে পারব না। অর্থাৎ পুলিশের কাছে ধরা আমাকে দিতেই হলো। শহরের এই ভদ্র লোকালয়ে রক্তচোষা নিগ্রোরা কী করছিস—এ কথা বলার আগেই পুলিশ কর্মকর্তা দেখল, আমার পায়ে জুতা নেই। ছাড়া পাওয়ার দুটি উপায় বলা হলো আমাকে। প্রথমটি, শহরকে দুটি ভাগে ভাগ করে দেওয়া রাস্তা ধরে দৌড়াতে বলা হলো। পুলিশ পেছন থেকে তাড়া করে আমাকে গুলি করবে। দ্বিতীয়টি, ভদ্র মানুষজনের সামনে আমাকে বেত্রাঘাত করা হবে। হঠাৎ কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই কপালের ডান পাশে এমনভাবে কষে থাপড় মারল যে ডান কানে আমি আর ভালো শুনতে পাব বলে মনে হচ্ছে না। মারতে মারতে বলছে, আশা করি উচিত শিক্ষা হয়েছে আর জীবনে কোনো দিন নিগ্রো বন্যরা শহরের ভদ্র প্রান্তে পা রাখবে না। আমি কেবল দেখছি আর অপেক্ষা করছি।
অবশেষে তুমি আমেরিকা থেকে ফিরে এলে; কিন্তু কেউ জানে না কখন গিয়েছিলে। নারীরা জানতে চায়, কেন তুমি ফিরে এলে? তারা বলে, আংকেল বেন রাইসের মতো ভালো ভালো জিনিস রেখে কেন ফিরে এলে তুমি? আমরা বিস্ময়ে থাকি, হয়তো তুমি জনপ্রিয় গান গাওয়ার জন্য সেখানে গিয়েছিলে। ছোট নদীর মাছ বড় নদীতে পড়লে যেমনটি হয়, তোমারও হয়তো তেমনটিই হয়েছে। তোমার খেলাটি আমি ধরতে পেরেছি। বন্দুকধারী কিছু ব্যক্তির সঙ্গে তোমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। যা হোক, সে কথা এখন আর বলব না। তোমাকে বস্তির সবাই খুব ভালো জানে। তুমি যা খুশি গাইতে পারো, জনপ্রিয় হওয়ার মতো অনেক কিছুই তোমার মধ্যে আছে। ‘অ্যান্ড আই লাভ হার’ কিংবা ‘ইউ ওন্ট সি মি’—যেকোনো গানই এখন তোমার কণ্ঠে হিট। তোমার যা আছে তুমি তা ব্যবহার করো, এমনকি অন্যের গান গেয়েও তুমি জনপ্রিয় হতে পারো, তুমি পেছন ফিরে আমাদের দিকে তাকিয়ো না, গেয়ে চলো যতক্ষণ নিশ্বাস থাকে প্রাণে। আমি জানি, ১৯৭১ সালের মধ্যে তুমি টেলিভিশনের পর্দায় আর ’৭১ সালেই আমি প্রথম গুলি করতে শিখি।

আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব সেভেন কিলিংস
অরাজক সময়ের চিত্র
মারলন জেমস
প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার এ উপন্যাসে জ্যামাইকার তিন দশকের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরেছেন মারলন জেমস। সদ্য বুকারজয়ী এ ঔপন্যাসিকের জন্ম ১৯৭০ সালের ২৪ অক্টোবর জ্যামাইকার কিংস্টোন শহরে। বাবা-মা দুজনেই পেশায় ছিলেন পুলিশ। স্কুলে পড়ার সময় মায়ের দেওয়া ও’হেনরির গল্পসমগ্র পড়ে লেখালেখিতে আগ্রহ, লেখালেখির হাতেখড়িও তখনই। তবে বই প্রকাশের জন্য ঢের সময় নিয়েছেন। প্রথম উপন্যাস বেরিয়েছে ২০০৯ সালে। ১৯৯১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রি নেন জেমস। বহু বছর যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাকালেস্টার কলেজে সৃজনশীল লেখালেখি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর লেখা উপন্যাসের সংখ্যা তিন—জন ক্রো’স ডেভিল, দ্য বুক অব নাইট উইমেন ও আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব সেভেন কিলিংস। বলার কথা হলো, ২০১৪ সালে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব সেভেন কিলিংস ‘ফিকশন’ বিভাগে ম্যান বুকার পুরস্কার ২০১৫-তে ভূষিত হয়েছে। উত্তরাধুনিক ধারায় লেখা এ উপন্যাসে একটি মূল গল্পের ছায়ায় অনেক ছোট ছোট গল্প বলেছেন কথক। এতে বিশ্বখ্যাত পপগায়ক বব মার্লের বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে ফুটে উঠেছে গোটা জ্যামাইকার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের অণুচিত্র। বলা ভালো, বব মার্লে এখানে বড় পরিসর নিয়ে আছেন। এমনকি উপন্যাসের মূল গল্পও তাঁকে কেন্দ্র করে—তাঁর হত্যাচেষ্টাকে বিষয় করে আবর্তিত হওয়া মূল গল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লেখকের জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ও কল্পনা। তিনি নিজের কল্পনাপ্রসূত চরিত্রদের জ্যামাইকার নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছেন। তাদের এমন বিশ্বাসযোগ্যভাবে নির্মাণ করেছেন, মনে হয়, চরিত্রদের প্রত্যেকেই যেন বাস্তব। এবার মূল আখ্যানের কিছুটা জানা যাক: তৎকালীন জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী ও পিপলস ন্যাশনাল পার্টির নেতা মাইকেল ম্যানলি আয়োজিত পাবলিক কনসার্টে বব মার্লেকে উদ্দেশ্য করে গুলি করা হয়। কিন্তু তাতে বন্ধ হয়নি কনসার্ট। মার্লে পুরো সময়েই সংগীত পরিবেশন করেন। তবে ওই কনসার্ট শেষে দুই বছরের জন্য লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান মার্লে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায়, লন্ডনে তিনি গেলেন কেন? প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর উপন্যাসে পাওয়া যাবে না; তবে মার্লের চলে যাওয়ার পেছনে জেমস কতগুলো প্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করেছেন। ধারণা করা হয়, ওই দিন মোট সাতজন বন্দুকধারী তাঁকে গুলি করতে এসেছিল। উপন্যাস ঘেঁটে জানা যায়, পশ্চিম কিংস্টোনের বস্তিগুলোয় জ্যামাইকার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রচ্ছায়ায় থাকত সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা এবং বন্দুকধারীরা সেই বাহিনীরই লোক। প্রথমাবস্থায় ওই সাতজনের একজনকেও ধরা হয়নি। পরে মার্লের ওপর হামলার জন্য নয়, অন্য কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ওই সাত বন্দুকধারীকেই হত্যা করা হয়। এমন নানা রহস্যময় ঘটনায় বর্ণিল আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব সেভেন কিলিংস। পুরো উপন্যাসে আছে ৭৫-এর বেশি চরিত্র। চরিত্রগুলোর বেশির ভাগই লেখকের কল্পনাপ্রসূত।
.
প্রতিটি চরিত্রের মধ্য দিয়েই ১৯৭০, ’৮০ ও ’৯০ দশকের জ্যামাইকার সামাজিক অসংগতির বর্ণনা করার চেষ্টা স্পষ্ট। ১৯৭০ ও ’৮০-এর দশকে জ্যামাইকার সমাজব্যবস্থায় খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ প্রভৃতি প্রতিদিনকার বিষয় হয়ে উঠেছিল। শ্রেণি বিভাজনও ছিল প্রকট। তবে কেবল এসব জাতীয় বিষয়ই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের অনেক কিছুও পাওয়া যাবে আখ্যানটিতে—জ্যামাইকার চারিদিকে যখন অস্ত্রের ঝনঝনানি, সেই সময় সিআইএ-এর গুপ্তচরেরা কীভাবে এদেশের বিভিন্ন শহরের পাড়া-মহল্লা ও বস্তিতে গোপনে অবস্থান করছিল—আছে এসবের সরস বর্ণনা। আবার ঠিক কী কারণে গুম, হত্যা, মাদক আর চোরাচালানির আখড়া হয়ে উঠেছিল জ্যামাইকা—বিভিন্ন চরিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন জেমস। উপন্যাসের কথনশৈলীর ক্ষেত্রে লেখক মুখের ভাষাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সাবলীল বিবরণে চেষ্টা করেছেন ঘটনার ভেতরের রহস্য উন্মোচনের। তবে অনেক সমালোচক এ-ও বলেছেন, এটি একটি বেসুরো উপন্যাস। কারণ, ঘটনার পরম্পরা এতে অনুপস্থিত। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মারলন জেমসের ভাষ্য: ‘ঘটনাসমূহ পরম্পরা বজায় রেখে ঘটে না। তা ছাড়া নানা সময়ে সংঘটিত হওয়া ঘটনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে যাওয়াটা বোকামি। তাই আমার উপন্যাসে প্রতিটি গল্প খানিক বাদে বাদে তার নিজস্বতা নিয়ে হাজির হয়েছে।’ আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব সেভেন কিলিংস-এর প্রথম অধ্যায় থেকে ‘নিমজ্জনের গল্প’ নামে অনূদিত অংশটি মূলত ১৯৭০ দশকের জ্যামাইকার কোপেনহেগেন শহরের আট নম্বর লেনের এক বস্তির গল্প। এখানকার বেশির ভাগ মানুষই হতাশায় নিমজ্জিত; কিন্তু সুদিনের অপেক্ষায় অধীর তাদের চোখ। আর এই বস্তির পাশের হোপ রোডে নানা প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করে বেড়ে উঠছে এক কিশোর গায়ক—বব মার্লে।