Thank you for trying Sticky AMP!!

বিতর্ক শেখার সহজ পাঠ

বিতর্ক ভুবন

বিরূপাক্ষ পাল

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: আগস্ট ২০১৭, ২০০ পৃষ্ঠা, দাম: ৪০০ টাকা।

একটি সমাজ তখনই সজীব ও জীবন্ত, যখন সেই সমাজের চলমান কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানা মতের মানুষের মধ্যে শুরু হয় গঠনমূলক বিতর্ক এবং সেই বিতর্কের ভেতর দিয়ে চলে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা। দেশ ও সমাজ একটা পরস্পর সম্পৃক্ত কাঠামো। সেই কাঠামো সেই সময়ই প্রকৃত কাঠামোর মর্যাদায় বিভূষিত হয়, যখন তা অনড় বা অনালোড়িত কিছু হয়ে ওঠে না। ইতিহাসের আলোকে আমরা দেখি, বিশ্বে সেই সব দেশ বা সমাজই অগ্রগতির শীর্ষচূড়া স্পর্শ করেছে, যেসব দেশ বা সমাজে বিতর্ক একটি সদা বহমান প্রক্রিয়া; এবং বিতার্কিকেরা সমাজ বা রাষ্ট্রে আসীন সসম্মানে।

ঠিক এই ভাবনার থেকে আমরা যখন রাষ্ট্র বা সমাজকে প্রত্যক্ষ করি, তখন দৃষ্টির সর্বাগ্র সীমায় নিয়ে আসি বিতর্ক ও বিতার্কিকদের। তাঁরাই সে সময় আমাদের গভীর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। এই প্রেক্ষাপট বিচারে যে মুহূর্তে আমাদের হাতে এসে পড়ে বিরূপাক্ষ পালের বিতর্কভুবন বইটি, তখন আমাদের মনোযোগের পুরোটা তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। আমরা তন্ন তন্ন করে, চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখি, কী আছে বইটিতে। সোজা কথায় বইটি বিতর্কবিষয়ক বই।

বিতর্কের সামগ্রিক রূপ নিয়ে, তার বৈশিষ্ট্য বা প্রকৃতি নিয়ে, সর্বোপরি, কীভাবে ভালো বিতার্কিক হওয়া যায়, যেসব বিশ্লেষণ ও শ্রেণিবিন্যাস এখানে যেমন তুলে ধরা হয়েছে, রূপ ও পদ্ধতিগত দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি তুলে ধরা হয়েছে তার অনুকূল দৃষ্টান্তের পর দৃষ্টান্ত। শুধু তা-ই নয়, বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে বিতর্কের মডেলগুলোর রূপ ও প্রকৃতিও। মোট ৩৭টি অধ্যায়ে বিভক্ত এ বই তাই বিতার্কিকদের জন্য হয়ে উঠতে পারে একটি রোল মডেল গোছের আধারবিশেষ।

পাঠকদের সুবিধার জন্য, বিশেষত বইটির চরিত্র বোঝার জন্য নিচে ৩৭টি অধ্যায় থেকে কয়েকটি অধ্যায়ের শিরোনাম উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন—‘বিতর্কের প্রধান তিন ধারা’, ‘বিতার্কিকের লক্ষ্য ও বিকাশ পথ’, ‘বিতর্ক প্রস্তুতির ষড়্‌ভুজ মডেল’, ‘বিতর্কের সংসদ মডেল’, ‘বিতর্কের জাতিসংঘ মডেল’, ‘বিতর্কের পুঞ্জ মডেল’, ‘বিতর্কে উৎকর্ষ অর্জন’, ‘বিতর্ক ও সাংবাদিকতা’ এবং ‘বিতর্ক ও যুক্তিবাদী সমাজের বিনির্মাণ’ ইত্যাদি। অধ্যায়গুলোর ওপরে উল্লেখিত শিরোনাম থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে লেখক বিরূপাক্ষ পালের কাউকে বিতার্কিক হিসেবে পারঙ্গম করার লক্ষ্যগত প্রয়াস এ বইয়ে কতটা গভীর ও আন্তরিকতায় পূর্ণ। অধিকন্তু এখানে তাঁর যে ‘লেখকের কথা’ শীর্ষক যে ভূমিকা, সেখানে তিনি যেমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, তা বেশ প্রণিধানযোগ্য। তাঁর ভাষ্য, ‘বইটি সহজ ভাষায় লেখা, যাতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আনন্দ নিয়ে এর পাতায় পাতায় বিচরণ করতে পারেন।...অধ্যাপনা পেশায় বিতর্ক আমাকে প্রতিদিন নতুন কিছু শেখায়, নতুনভাবে বিশ্লেষণের ক্ষমতা দেয়, দেয় কথা বলার আত্মবিশ্বাস। বইয়ে তারই প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করেছি।’ যথার্থই বলেছেন লেখক।

 অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ বইয়ের ‘ভূমিকা’য় লেখেন, ‘বিতর্ক যে কলহে পরিণত হয় না তার কারণ পরস্পরবিরোধী দুই পক্ষের সহনশীলতা। বিতর্কের সঙ্গে তাই গণতন্ত্রের যোগ আছে। প্রাচীনকালে গ্রিকরা বিতর্কের জন্য যে খ্যাতি অর্জন করেছিল, তার বড় কারণ সেখানে একধরনের গণতন্ত্র ছিল। এক পক্ষ আরেক পক্ষের মত শুনত, বিরুদ্ধ মতকে মূল্য দিত।’ তাঁর এ বক্তব্য থেকে বিতর্ক শেখা, বিতার্কিক হওয়া শুধু কথার কথা মাত্র নয়, বিতর্ক সভা শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, এ চলমান জীবনেরই অংশ, যাকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্র অর্জিত হতে পারে না। বিতর্ক এক অপরূপ শিল্প, গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করার জন্য সেই শিল্পকে তাই আয়ত্ত করা জরুরি। বিতর্ক-সংক্রান্ত এ বই তাই আমাদের প্রত্যেকের নিত্যসঙ্গী বা সহচর হোক।