Thank you for trying Sticky AMP!!

ব্রিজের ধারের বৃদ্ধ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চোখে স্টিল ফ্রেমের চশমা, পোশাক ধূলিধূসরিত—বুড়ো লোকটি রাস্তার ধারে বসে ছিল। তার সামনে ছোট ভাসমান ব্রিজটার ওপর দিয়ে অসংখ্য খচ্চরের টানা গাড়ি, ট্রাক, নারী-পুরুষ-শিশু পার হচ্ছিল সারা দিন ধরে। নদীর খাড়া পাড় বেয়ে খচ্চর টানা গাড়িগুলো হিঁচড়ে হিঁচড়ে ওপরে উঠছিল—সৈনিকেরা চাকার আড়া ধরে ঠেলে ওগুলোকে ওপরে উঠতে সাহায্য করছিল। ট্রাকগুলো ছিল সবার সামনে। গোড়ালি পর্যন্ত ধুলোতে ডুবিয়ে চাষিরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাঁটছিল। কিন্তু বুড়ো মানুষটা একটুও না নড়ে একভাবে বসেই ছিল। এত পরিশ্রান্ত সে যে আর হাঁটার ক্ষমতা ছিল না তার।
আমার কাজ ছিল শুধু ব্রিজ পার হয়ে ওপাশটা খোঁজা এবং শত্রুরা কতটা এগিয়ে এসেছে তা লক্ষ করা। কাজ শেষ করে আমি ব্রিজটার ওপর ফিরে এলাম। খচ্চরে টানা গাড়ি এখন আর বেশি নেই। আর পায়ে হাঁটা লোকও ছিল কম। কিন্তু বুড়ো মানুষটা তখনো সেখানে ছিল।
‘কোথা থেকে আসছ তুমি?’—তাকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘স্যান কারলাস থেকে।’—সে উত্তর দিল এবং মৃদু হাসল।
ওটা তার নিজের শহর। কাজেই তার উল্লেখে বুড়োর মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল।
‘আমি পশুপাখির দেখাশোনা করতাম।’—লোকটা আমাকে বুঝিয়ে বলল।
‘ওহ।’—ব্যাপারটা ঠিক না বুঝেই আমি বললাম।
‘হ্যাঁ।’—সে বলল, ‘পশুপাখির দেখাশোনা করার জন্যই আমি এত দিন ছিলাম, বুঝলে? আমিই শেষ লোক স্যান কারলাস শহর ছেড়েছি।’
তাকে মেষপালক বা পশুপালক কারও মতো দেখাচ্ছিল না। আমি তার কালো ধুলোমাখা জামাকাপড়ের দিকে এবং ধূসর ধুলোভর্তি মুখের দিকে এবং স্টিল ফ্রেমের চশমার দিকে চেয়ে বললাম, ‘কী কী প্রাণী ছিল তোমার?’
‘নানা রকম জীবজন্তু।’—লোকটা বলল এবং মাথা ঝাঁকাল, ‘সব ছেড়ে আসতে হলো আমাকে।’
আমি ব্রিজটাকে এবং আফ্রিকার মতো দেখতে এবরো ডেলটার দেশটিকে লক্ষ করছিলাম এবং ভাবছিলাম, শত্রুদের সম্মুখীন হতে আর কত দেরি হবে। আর সেই অদ্ভুত রহস্যময় ঘটনা যাকে বলা হয় শত্রুসংযোগ—ইঙ্গিতবহ শব্দ শোনার চেষ্টা করছিলাম সব সময়।
বৃদ্ধ তখনো সেখানে বসে ছিল।
‘কী কী প্রাণী ছিল বললে?’—আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘তিনটে জন্তু ছিল।’—সে বলল, ‘দুটো ছাগল, আর একটা বিড়াল আর ছিল চার জোড়া পায়রা।’
‘ওদের ছেড়ে আসতে হলো তোমাকে, তাই না?’—আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘হ্যাঁ। গোলন্দাজদের জন্য। গোলন্দাজ বাহিনীর জন্যই ক্যাপ্টেন আমাকে পালিয়ে যেতে বলল।’
‘পরিবার-পরিজন কেউ নেই তোমার, না?’—ব্রিজের দূরপ্রান্তে যেখানে অল্প কটা খচ্চরে টানা গাড়ি ঢালু তীর বেয়ে অপসারিত হচ্ছিল সেখানে চোখ রেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘না।’—বৃদ্ধ বলল, ‘যে জন্তুগুলোর কথা বললাম তারা ছাড়া কেউ নেই আমার। বিড়ালটার অবশ্য কোনো অসুবিধাই হবে না। বিড়াল নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নিতে পারে, কিন্তু অন্যদের যে কী হবে, আমি ভাবতেও পারি না।’
‘কোন রাজনীতিতে বিশ্বাস করতে তুমি?’
‘আমার কোনো বিশেষ রাজনীতি নেই।’—সে বলল, ‘আমার বয়েস ছিয়াত্তর বছর। আমি বারো কিলোমিটার এসেছি। আর একটুও যেতে পারব না মনে হচ্ছে।’
‘থামার জন্য ভালো জায়গা নয় এটা।’—আমি বললাম, ‘যদি মনস্থির করতে পারো দ্যাখো—টরটোসায় ট্রাক যাচ্ছে অনেক।’
‘আমি আর একটু দেরি করব এখানে, তারপর চলে যাব। ট্রাকগুলো কোথায় যাচ্ছে বললে?’
‘বার্সেলোনার দিকে।’—তাকে বললাম।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘ওদিকে কাউকে জানি না আমি।’—সে বলল, ‘কিন্তু তোমাকে ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে।’
শূন্যদৃষ্টিতে ভারি শান্তভাবে সে আমার দিকে চাইল। তারপর যেন তার দুঃখের ভাগ আর একজনকে দেওয়ার জন্যই বলল, ‘বিড়ালটার কোনো অসুবিধা নেই, আমি ঠিক জানি। বিড়ালটার সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। কিন্তু অন্যগুলো? অন্যগুলোর কী হবে বলো তো?’
‘বোধ হয় তারাও ঠিক ঠিক এই দুর্দিন পার হয়ে যাবে।’
‘তোমার কি তা-ই মনে হয়?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।’—নদীতীরের দূরপ্রান্তে যেখানে এখন কোনো গাড়ি ছিল না সেদিকে লক্ষ করতে করতে আমি বললাম।
‘কিন্তু আমাকেই যখন গোলন্দাজদের উৎপাতের জন্য পালিয়ে আসতে বলল, তখন কামান চলতে শুরু করলে ওরা কী করবে?’
‘পায়রা খোপগুলো খোলা রেখে এসেছিলে তো?’—আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে তারা ঠিক উড়ে যাবে।’
‘হ্যাঁ, ওরা তো নিশ্চয়ই উড়ে যাবে। কিন্তু অন্যগুলো? অন্যগুলোর কথা চিন্তা না করাই ভালো।’—সে বলল।
‘তোমার বিশ্রাম নেওয়া যদি হয়ে যায় তাহলে আমি এখন যাই।’—আমি বললাম, ‘আস্তে আস্তে উঠে এখন হাঁটতে চেষ্টা করো।’
‘ধন্যবাদ।’—সে উঠে দাঁড়াল, কিন্তু উঠেই টলমল করে দুলতে শুরু করল এবং তারপর আবার ধুলোর ওপর বসে পড়ল।
‘আমি জীবজন্তু দেখাশোনা করতাম।’—ভোঁতা গলায় বলল সে, কিন্তু এবার আর আমার উদ্দেশ্যে নয়, ‘আমি জীবজন্তু দেখাশোনা করতাম।’
তার বিষয়ে আমার আর কিছুই করার ছিল না। ইস্টারের রোববার আজ; এবরোর দিকে ফ্যাসিস্টরা এগিয়ে আসছিল। ধূসর মেঘাচ্ছন্ন সকালের দিন সেটা। কাজেই ফ্যাসিস্টদের বিমানগুলো আজ ওড়েনি—এই সুবিধা আর বিড়ালরা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিতে পারে—এই আস্থা ছাড়া বুড়োর ভাগ্যে ভালো কিছু আর জুটবে না।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (২১ জুলাই ১৮৯৯—২ জুলাই ১৯৬১)
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
কালজয়ী মার্কিন কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর সংক্ষিপ্ত ঋজু রচনাশৈলীর জন্য পৃথিবীব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন। ভয়াবহ ঘটনা ও দৃশ্য বা প্রচণ্ড আবেগ বর্ণনার সময়েও তিনি হিরের মতো কঠিন, স্বচ্ছ ও বিশেষণহীন ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। পরবর্তীকালের অধিকাংশ মার্কিন লেখক এই লিখনশৈলী গ্রহণ করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এর কারণ হলো, বাহির থেকে নেহাত সাদামাটা হলেও, হেমিংওয়ের গদ্যে রয়েছে দৃঢ়বদ্ধ গাঁথুনি, অপরিমিত সংযম এবং অন্তর্লীন ভঙ্গি আর এক প্রসারিত মানবিকতা, যা একজন গদ্যশিল্পীরই থাকতে পারে। এই অণুগল্পে তাঁর এই রচনাশৈলীরই নমুনা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, যার জন্য বাংলা ভাষার মাধুর্য ও সম্পূর্ণতা হয়তো অটুট থাকেনি সব সময়। ‘দ্য ওল্ডম্যান অ্যাট দ্য ব্রিজ’ নামের এই গল্পটি নেওয়া হয়েছে হেমিংওয়ে রিডার থেকে।