Thank you for trying Sticky AMP!!

ভয়ংকরের মুখোমুখি ধ্বংসযজ্ঞে লেখালেখি

এখানেই ঘটেছিল সেই চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনা। এটি বিস্ফোরণের আগের ছবি

মহামতি চেখভের তিন বোন নাটকটির কথা মনে পড়ছে। নাটকে প্রধান চরিত্র এ সংলাপটি বারবার বলে, ‘জীবন এখন দুর্বিষহ, আমরা বাস করছি এক দুর্গন্ধময় আবর্জনার স্তূপে, তবে এক শ বছর, হ্যাঁ এক শ বছর পর কী সুন্দর, কী অপরূপ সুন্দরই না হয়ে উঠবে সবকিছু!’
তো এক শ বছর পরে কী ঘটেছে? আমরা চেরনোবিল পেয়েছি, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার গুঁড়িয়ে যেতে দেখেছি। ইতিহাসে এ এক নতুন অধ্যায়। আমরা এ সময় এমন সব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে পার করছি যা আমাদের অতীতলব্ধ জ্ঞানকে তো বটেই, কল্পনাশক্তিকেও হার মানাচ্ছে। আমরা এক নিদারুণ ভয়ের সংস্কৃতিতে ঝুঁকে পড়েছি যাকে দুর্যোগ বললে ঠিক বলা হয় না। কারণ দুর্যোগ হলো ভয়ের এক পুঞ্জীভূত রূপ। আজ আমাদের সভ্যতা ব্যাপক-বিশাল আয়োজনে যা কিছু উৎপাদন করে চলেছে তা ভয়। ফলে যা কিছু ঘটছে তা অবিশ্বাস্য। মানুষের সাধ্য নেই তা অনুধাবন করে, কারণ ঘটনাগুলো ঘটছে অতি দ্রুত।

লেখালেখি শুরু করার আগে বছর দশেক সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সূত্রে আমি এটুকু বুঝেছি, কেবল লিখিত ভাষায় ঘটমান এই বর্তমানকে ধরে রাখা সম্ভব নয়। ভাষার ক্ষমতা সীমিত।
যুক্তরাষ্ট্রের জীবনযাত্রার সংস্কৃতির সঙ্গে আমি পরিচিত নই, যে কারণে এখানে মানুষের মনে ঘটনাগুলো ঠিক কী ধরনের ছাপ ফেলেছে তা অনুধাবন করা আমার পক্ষে কঠিন। তবে রাশিয়া বা স্লাভিক অঞ্চলের মানুষের প্রসঙ্গে যদি আসি, তাদের অবস্থা বুঝতে লিখিত ভাষার চেয়ে তাদের মুখের ভাষা আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাস্তাঘাটে, ভিড়ে-জটলায় যা শুনতাম তা ছাপা লেখাজোখার তুলনায় প্রকৃত পরিস্থিতিকে অনেক বেশি গভীর ও সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারত। আমার মাথায় ভাবনাটা গজায় তখনই, বর্তমান এ সময়ে যা ঘটছে তার সবটুকু কোনো মানুষের পক্ষে বইপত্রে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়, তলস্তয় বা দস্তইয়েফস্কি যেমন পেরেছিলেন উনিশ শতকে। সুতরাং আজ আমাদের প্রয়োজন এমন বই, যাতে অনেক মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পাব; একজন হয়তো আধা পৃষ্ঠা অবদান রাখবে, অন্য কেউ পাঁচ পৃষ্ঠা বা মাত্র একটা অনুচ্ছেদ।

>
দ্য চেরনোবিল প্রেয়ার: ক্রনিকল অব দ্য ফিউচার
১৯৮৬ সালে ইউক্রেনের চেরনোবিলে পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর দ্য চেরনোবিল প্রেয়ার: ক্রনিকল অব দ্য ফিউচার নামে একটি বই লেখেন স্ভেতলানা অালেক্‌সিয়েভিচ। তাঁর এই লেখাতেও আছে অতীত ও বর্তমান পৃথিবীর প্রেক্ষাপট ও চেরনোবিলের সেই দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ

আমার এ ধরনের লেখার নাম দিয়েছি ‘কণ্ঠস্বরের আখ্যান’—‘দ্য নভেল অব ভয়েসেস’। আমি মানুষের কাছে যাই, শুনি তারা কী বলে, তারপর সেগুলো গেঁথে রাখি। ফ্লুবেয়ার একবার বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম এ ম্যান অব দ্য প্লুম’। অর্থাৎ নিজেকে তিনি মনে করতেন পুচ্ছের মানুষ। নিজের সম্পর্কে বলতে পারি, কোনো ঘটনা আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখে এবং কানে শোনার ভিত্তিতে লেখার পক্ষপাতী; আরও সহজ করে বলা যায়, আমি মানুষটা কানের—‘অ্যা পারসন অব দ্য ইয়ার’। ৩০ বছর মানুষের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, মানুষের এমন অনেক কিছুই রুদ্ধ, অকথিত থেকে যায় যা শিল্প (আর্ট) বের করে আনতে পারে না। আমি মানুষের অনুভূতি ও সংগ্রামে আগ্রহী। মানুষের মনের অতলে কী ঘটছে অনুধাবন করতে গিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি তাদের কাছে সেসবের কী তাৎপর্য, কিসে তাদের যন্ত্রণা।

বিস্ফোরণের পর

চেরনোবিলের ঘটনার পর যেবার প্রথম সে অঞ্চলে যাই, আমার চোখে পড়েছিল শত শত না হলেও ডজন ডজন সাংবাদিক। নিজেকে তখন বলেছিলাম, ‘এরা খুবই দ্রুত এ নিয়ে বইটই লেখা শুরু করে দেবে, তবে আমি যা লিখতে চাই তা কয়েক বছর নিয়ে নেবে।’ আসলেই আমার লেগেছিল ১০ বছর। আমি যখন সেসব সাংবাদিকদের বইপত্রে নজর দিই, দেখতে পাই তথ্যের পর তথ্য, চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানা তথ্যেও সেসব পরিপূর্ণ। সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ যত চেষ্টাই করুক, তথ্য চাপা দিতে পারেনি, ঠিকই বেরিয়ে পড়েছিল। চেরনোবিল জন্ম দিয়েছিল সোভিয়েত ও কমিউনিস্টবিরোধী বিস্তর বইপত্রের, সেই সঙ্গে অণু-পরমাণু বিষয়ে নানা বিশ্লেষণেরও। কিন্তু সে ঘটনা থেকে যে শিক্ষা আমাদের নেওয়া জরুরি তার জন্য প্রয়োজন ছিল সময়ের।
বেলারুশে আমরা তখন নিজেদের আবিষ্কার করেছিলাম বোধবুদ্ধিরহিত এক উদ্ভট জগতে। বেলারুশের মতো কৃষিনির্ভর একটা দেশ যেন হঠাৎ করেই গোটা বিশ্বের সামনে এসে পড়েছিল। দৃশ্যটা একবার কল্পনা করুন: ডিমভর্তি ঝুড়ি নিয়ে চলেছে এক নারী, তার পাশাপাশি কড়া পাহারায় হেঁটে চলেছে একজন পুলিশ। পুলিশের এই নিবিড় পাহারার উদ্দেশ্য নারীটি ডিমগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলছে তা নিশ্চিত করা, কারণ ওগুলো তেজস্ক্রিয়। কত কিছু যে পুঁতে ফেলতে হয়েছে! দুধ, রুটি, মাংস। সে একসময় ছিল দীর্ঘ, অনিঃশেষ শবযাত্রার—জড়বস্তুর শবযাত্রা। দলবেঁধে হাজার হাজার সৈন্য মাটির ওপরের স্তর কেটে মাটিতেই পুঁতে কবর দিয়েছে। এসব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে প্রতিটি মানুষই যেন হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। তাদের অতীত অভিজ্ঞতায় বা ইতিহাসের পাতায় এর সমতুল্য কিছু ছিল না, যা দিয়ে তারা সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারত।
বিষয়টি এভাবে দেখা যেতে পারে: অতীত-পৃথিবীর সবকিছুই মানুষের নিয়ন্ত্রণে ছিল; মানুষই ঠিক করত কাদের তারা হত্যা করবে, কাদের ছাড় দেবে। কিন্তু হঠাৎই সব পাল্টে গেল, যেন পৃথিবী জেগে উঠল বিদ্রোহে, কেড়ে নিল মানুষের হাত থেকে নিয়ন্ত্রণের সব শক্তি। এমন অবস্থায় আপনার চারপাশ ঘিরে মৃত্যু, এক অন্য মৃত্যু—অবয়বে, প্রকৃতিতে—যা উপলব্ধি করাই দুঃসাধ্য। তেজস্ক্রিয়তা জিনিসটাকে চোখে দেখা যায় না, এর কোনো সাড় নেই যে কানে শোনা যাবে, গন্ধও নেই যে নাকে টোকা দেবে। আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় যা আমাদের নিজেদের সুরক্ষা করতে শিখিয়েছে, সে সময় কোনো ধরনের সাহায্যেই এগিয়ে আসেনি।
সেই মহাদুর্যোগের পরের সাতটা দিন মৌমাছিরা তাদের চাক ছেড়ে বেরোয়নি, পোকামাকড় মাটিতে গর্ত খুঁড়ে নিজেদের আড়াল করেছে। এমনকি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীট যারা মাটিতে-ঘাসে চরে বেড়ায়, তারাও বুঝতে পারছিল নিজেদের রক্ষা করতে তাদের কী করতে হবে। গোলমেলে একটা কিছু ঘটে গেছে তারা বুঝতে পারছিল। কিন্তু আমরা মানুষেরা তখন কী করেছি? টেলিভিশনে চোখ রেখেছি, গর্বাচভের বক্তৃতা শুনেছি, কেউ কেউ ফুটবল খেলাও দেখেছি। আর আমরা যারা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজকর্ম করি, তাদেরও কোনো প্রস্তুতি ছিল না, জানা ছিল না যা ঘটেছে তা নিয়ে মানুষকে কী বলা যায়। মানুষও জানত না নিজেদের মধ্যে কী নিয়ে কথাবার্তা চালাবে।
দ্য প্যারিস রিভিউয়ের সৌজন্যে, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত