Thank you for trying Sticky AMP!!

মাটির মায়ায়

‘শিল্পী’, শিল্পী: সমর মজুমদার

সমর মজুমদারের আঁকা বইয়ের প্রচ্ছদের কথা কমবেশি জানা আমাদের। কিন্তু ‘মৃত্তিকা মায়া’ শিরোনামে শিল্পীর একক প্রদর্শনী থেকে এবার ধারণা পাওয়া গেল তাঁর শিল্পকর্ম সম্পর্কে। এটি শিল্পীর দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী। ৩৮টি কাজের মধ্যে ১০টিই আঁকা হয়েছে ক্যানভাসে অ্যাক্রেলিক রঙে। বাকিগুলো হ্যান্ডমেড কাগজে অ্যাক্রেলিক রং দিয়ে করা।

দৃশ্যশিল্পে লোকজ ধারার গল্প বলার পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন সমর মজুমদার। আমাদের পটচিত্রে ছবির সঙ্গে সুরে সুরে গল্প বলে বুঝিয়ে দেন শিল্পীরা। সমর মজুমদার যেন অনেকটাই এই ধারার অনুসারী, ঐতিহ্যসন্ধানী। তাঁর ক্যানভাসের বিষয়গুলোতে দেখা যায় বাংলার চিরচেনা জীবন-প্রকৃতি। তাঁর কয়েকটি ছবির নাম: ‘মাছ বিক্রেতা’, ‘মাছ ধরা’, ‘জলকেলি’, ‘সাঁকো’, ‘দক্ষিণের ঘাট’, ‘হাটুরে’, ‘মা’। ছবিগুলোতে আছে আমাদের অতিচেনা জীবনের গল্প।

সমরের ছবিতে গ্রামীণ জনজীবনের রোজকার চেনা বিষয়গুলো যখন আমাদের কাছে হাজির হয়, দর্শক হিসেবে আমরা ফিরে যাই শৈশবে। বুঝতে পারি, মৃত্তিকার মায়ার মধ্যে বসবাস করেন শিল্পী।

সহজ ফর্মে বিষয়গুলো বর্ণনা করেন সমর। জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, এস এম সুলতান, মোহাম্মদ কিবরিয়া ও সফিউদ্দিন আহমেদের মতো বিষয় নির্বাচনে দর্শকের কাছাকাছি গিয়েছেন শিল্পী। তাঁর ছবিগুলো এমন: একেবারে বাস্তব নয় আবার মানুষ ও অন্য প্রাণীগুলোর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় একটা সম্পর্কও। রয়েছে একটি ছবির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ক। প্রদর্শনী নিয়ে শিল্পীর ভাষ্য, ‘একটি ছবির সঙ্গে আরেকটি ছবির সম্পর্ক আছে, এমন ছবিগুলোই এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। প্রায় ৫০টি ছবি থেকে বাছাই করে প্রদর্শন করা হচ্ছে ৩৮টি ছবি। আমার ছবিই দর্শককে গল্প বলে, স্মৃতিকাতর করে তোলে।’

লোকজ ও আধুনিকতার মিশেলে ছবির জমিন তৈরি করেছেন সমর। রং প্রলেপ দেওয়ার সময় মৌলিক রং ব্যবহার করেছেন। রঙের প্রয়োগে রাখেননি অতিনাটকীয়তা। কোনো কৌশল ছাড়াই একটি বিষয় ভাগ করে নিয়ে আলো আর ছায়ার বিন্যাস দেখিয়েছেন। সবল বর্ণলেপন বা সহজ ভঙ্গিতে আধা বিমূর্ত বিষয়ে রঙের ব্যবহারেও দেখা যায় সরলীকরণ। যৌগিক বা মিশ্র রং ব্যবহারের প্রবণতা তাঁর কাজে খুব কম দেখা যায়। এ রকমভাবে রং ব্যবহার সমরের ক্যানভাসকে সরল করে তুলেছে। অন্যদিকে লোকজ শিল্পের রং ব্যবহারের পদ্ধতি অনুসরণের ছাপও এতে স্পষ্ট। এ তো গেল সমর মজুমদারের করণকৌশলের বিবরণ। এবার ছবির বিষয় ও ছবি নিয়ে দু-চার কথা বলি।

প্রথমেই ‘অবলম্বন’ ছবির কথা। এ ছবিতে একমাত্র গাভিটি জড়িয়ে ধরে আছেন কৃষক। এর চিত্রতলে যে বান্ট সিয়েনা রঙের ব্যবহার হয়েছে, তার সঙ্গে গরুটির রং মিলে গেলেও কৃষকের সাদা লুঙ্গির উজ্জ্বলতা ছবিটিকে আলাদা আলো দিয়েছে। এতে ছবির বিষয়ের সঙ্গে তৈরি হয়েছে রঙের ঐক্য।

‘মা-১’ ছবিতে দেখা যায় ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে হারিকেন উঁচিয়ে মা দেখছেন তাঁর প্রিয় মানুষটি আসছে কি না। অপেক্ষার আনন্দের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে ক্যানভাসের মানুষটির মুখে। এ দুটি ছবির বিষয় ভিন্ন কিন্তু দুটি ছবির মধ্যে ঐক্য তৈরি হয়েছে ব্যাকগ্রাউন্ডে গাঢ় রং ব্যবহার করায়। আরও একটি ছবি সম্পর্কেও এখানে বলতে হবে। ছবিটির নাম ‘নৌকা ভ্রমণ’। ছবিতে দূর আকাশ মিলেমিশে আছে। নীল-সাদা রঙের আকাশ অনেক দূরে মিলিয়ে যায়। উপরন্তু এখানে নৌকার গলুই আর মাঝির অবস্থান ক্যানভাসকে ভাগ করে দিয়েছে কৌণিকভাবে। এতে গোটা ছবির ভেতরে যেমন প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি ছবির সঙ্গে দর্শকের যোগাযোগও তৈরি করেছে।

বিশ্বায়নের এই যুগে পুঁজির দুনিয়ায় সমর মজুমদার ছবি আঁকেন স্মৃতি হাতড়ে। নগরের বাসিন্দা তিনি, তবে নগরে থেকে নিত্য মনে করেন গ্রামকে এবং শহরের দর্শকদের কাছে উন্মোচন করেন মাটির মায়ার কথা, গ্রামজীবনের কথা। প্রতিদিন নতুন নতুন বিষয় সাজিয়ে তোলার মাধ্যমে স্মৃতিকে জীবন্ত করে দেখান শিল্পী। ফলে তৃণমূল মানুষের দৈনন্দিন সহজ জীবন অভিভূত করে তোলে আমাদের।

আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে ১৩ অক্টোবর শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি শেষ হয়েছে ২৬ অক্টোবর।