Thank you for trying Sticky AMP!!

যে ষড়যন্ত্র সফল হয়নি

বাঁ থেকে: সিবতে হাসান, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, হামিদ আখতার ও নাদিম কাসেমি

সোহরাব হাসান তাঁর রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র ১৯৫১ মাধ্যমে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন-পরবর্তীকালের এমন এক বিস্মৃতপ্রায় অথচ ঘটনাবহুল অধ্যায়কে তুলে ধরেছেন, পাঠক হিসেবে যার পাঠ আমাদের মনকে নিঃসন্দেহে ভাবনার সঙ্গী করে, বিশ্লেষণপ্রবণও করে তোলে।

বইয়ের ‘ভূমিকা’ মারফত লেখক আমাদের জানান, ‘এ বইয়ে রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্রের তিন প্রধান কুশীলবের জীবন ও চরিত্র বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে। জেনারেল আকবর চৌকস ও দক্ষ সেনা কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি কেবল সরকারের কাশ্মীরনীতিতে ক্ষুব্ধ ছিলেন না, আমেরিকাঘেঁষা নীতিরও প্রচণ্ড বিরোধী ছিলেন। আর ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ও সাজ্জাদ জহির চেয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানকে তাঁদের আদর্শে প্রতিষ্ঠা করতে, যেখানে ধর্ম বা জাতিগত নিপীড়ন থাকবে না।’ তিনি আরও জানাচ্ছেন, ‘শেষ পর্যন্ত তাঁরা সফল হননি।’

কেন হননি, কী হয়েছিল শেষ পর্যন্ত রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র-সংশ্লিষ্ট কুশীলবদের পরিণতি, সর্বোপরি ‘রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র আসলে কার ষড়যন্ত্র ছিল’—এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে লেখককে মোট ৯টি অধ্যায় লিখতে হয়েছে এবং ‘সংযুক্তি’ শিরোনামের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধকেও বইয়ের উপসংহার হিসেবে জুড়তে হয়েছে। এই প্রবন্ধের লেখক স্টেলে ড্রাইল্যান্ড।

বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘দেশভাগ ও জিন্নাহর “পোকায় খাওয়া” পাকিস্তান’। এতে সোহরাব হাসান সংক্ষেপে পাকিস্তানের জন্মের পটভূমি, শাসকমহলের আদর্শচ্যুতি, কাদের স্বার্থে রাষ্ট্রটির জন্ম, হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং দুই পাকিস্তানের মধ্যকার সার্বিক বৈষম্যের বিবরণ তুলে ধরে দেখান, এই সবকিছুরই গর্ভে রোপিত হয়েছিল ১৯৫১ সালের রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্রের বীজ।

দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম ‘ষড়যন্ত্রের শেষ, না শেষের শুরু?’ এতে রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্রের প্রকৃত কারণ নানা তথ্যসূত্রের সাহায্যে তুলে ধরেছেন লেখক। এই অধ্যায়ের পাঠ সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সোহরাব আমাদের জানাচ্ছেন, ‘ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তের আলোকে আমরা দেখতে পাই, ১৯৪৯-৫১ সালে মেজর জেনারেল আকবরের নেতৃত্বে যেসব তৎপরতা চলেছে, তাকে নিছক সামরিক অভ্যুত্থান-প্রয়াস বলা যায় না। এটি ছিল আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যার উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তন।’ এই সঙ্গে তিনি আরও জানাচ্ছেন, ‘ঘটনাটি এ কারণে তাৎপর্যপূর্ণ যে পাকিস্তানে আজ পর্যন্ত যতগুলো সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, সব কটিই ছিল রাজনৈতিক ধ্যানধারণায় ডানপন্থী। কিন্তু ১৯৫১ সালের অভ্যুত্থান-প্রয়াসটি ছিল বামপন্থী তথা কমিউনিস্টদের সমর্থনে।’

তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম ‘আকবর খান: না নায়ক, না প্রতিনায়ক’। এতে তুলে ধরা হয়েছে এই ষড়যন্ত্রের প্রধান আসামি আকবর খানের নানা তৎপরতা, কারা তাঁর সহযোগী, তাঁর গ্রেপ্তারি এবং তাঁর তৎপরতা সম্পর্কে আদালতে অন্যদের দেওয়া জবানবন্দির বিবরণ। আছে আকবর খানের অভ্যুত্থান-সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা এবং ঘোষণার সারসংক্ষেপ। পাশাপাশি তুলে ধরা হয়েছে অভ্যুত্থানের লক্ষ্য সম্পর্কে কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ও কমিউনিস্ট নেতা সাজ্জাদ জহিরের বক্তব্য। এই অধ্যায়ে ধৃত ও অভিযুক্ত ১৫ জন আসামির পরিচিতিও তুলে ধরা হয়েছে।

‘বিচার না প্রহসন’ শিরোনামের অধ্যায়ে আছে রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র ফাঁস হওয়ার পাশাপাশি এর কথিত কুশীলবদের বিচারের বিবরণ। ১৯৫১ সালের ১০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ‘পাকিস্তানের শিকড় ধরে টান দেওয়া’র যে অভিযোগ তোলেন, তারই পুনরাবৃত্তি করে করাচি, ঢাকা ও পেশোয়ারের বিভিন্ন পত্রিকার ১৮ জন সম্পাদকের বিবৃতি ছাপা হয়, যাতে কথিত ষড়যন্ত্রের প্রয়াসকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে অভিহিত করা হয়।

আসামিদের বিচার চলছিল বিশেষ আদালতে। যে আইনের বলে এই আদালত গঠিত হয়েছিল, তাকে চ্যালেঞ্জ করে করা হয়েছিল রিট। কিন্তু আদালত তা গ্রহণ করেননি। মামলাটি বেসামরিক আদালতে হলেও আপিলের সুযোগ ছিল না। ফলে সেই বিশেষ আদালতের রায়ই ছিল চূড়ান্ত। শেষত আমরা দেখি, আসামিদের নানা মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একজন শুধু বেকসুর খালাস পান। তিনি আকবর খানের সহধর্মিণী।

এর পরের অধ্যায়গুলো, যেমন ‘লিয়াকত হত্যা ও সিআইএ’, ‘আইয়ুব খান: এক ঢিলে দুই পাখি মারা’, ‘ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ: কবিতা-বিপ্লবের মেলবন্ধন’, ‘সাজ্জাদ জহির ও প্রগতি লেখক সংঘ’ এবং ‘পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি: স্বপ্নভঙ্গের কাহিনি’। উল্লিখিত অধ্যায়গুলোর ভেতর দিয়ে আলোচ্য রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্রের যে পরিণতি বা ফলাফল আমরা প্রত্যক্ষ করি, তা শুধু ইতিহাসের কৌতূহলোদ্দীপক বিবরণকেই হাজির করে না, দেয় দৃষ্টান্তমূলক এক শিক্ষাও।
বইটি অনালোচিত এক ইতিহাসকে নতুন করে সামনে এনেছে।

রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র ১৯৫১
সোহরাব হাসান
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: মার্চ ২০১৮, ১২০ পৃষ্ঠা, দাম: ২৫০ টাকা।