Thank you for trying Sticky AMP!!

রোমাঞ্চ আর বিজ্ঞানের মিশেল

নক্ষত্রের ঝড়

নক্ষত্রের ঝড়
দীপেন ভট্টাচার্য
প্রচ্ছদ: রেনে মাগরিটের চিত্র অবলম্বনে অশোক কর্মকার
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
১০৪ পৃষ্ঠা
দাম: ২২০ টাকা।
দীপেন ভট্টাচার্যের লেখা বিজ্ঞান কল্পকাহিনি আগে পড়া হয়নি, এই ‘অপরাধ’ শুরুতেই স্বীকার করে নেওয়া উচিত। তিনি মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি করেছেন। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড ক্যাম্পাসে জ্যোতির্বিদ হিসেবে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি অধ্যাপনাও করছেন। পড়ালেখা আর কাজের অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই তাঁকে নক্ষত্রের ঝড় নামে এই ঝকঝকে বিজ্ঞান কল্পকাহিনিটি লিখতে সাহায্য করেছে। এর আগে তাঁর তিনটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনি প্রকাশিত হয়েছে।
বিজ্ঞান কল্পকাহিনির রেসিপি বোধ করি একটু কঠিন। বিজ্ঞান আর কল্পনার অনুপাতটা জুতসই না হলে কাহিনিটা ঠিক জমে না। সেদিক থেকে নক্ষত্রের ঝড়কে এককথায় ‘দুর্দান্ত’ বলা যায়। প্রথম পরিচ্ছদ থেকেই রোমাঞ্চটা চেপে ধরতে শুরু করেছিল।
১৯৩০ সাল। খামারগাছা রেলস্টেশনের একটা ব্যাখ্যাতীত ঘটনা দিয়ে গল্পের শুরু। কামারডাঙা থেকে খামারগাছা স্টেশনে ট্রেন পৌঁছানোর পর স্টেশনমাস্টার মনোহরবাবু আবিষ্কার করলেন, ১ আর ৩ নম্বর কামরার মানুষগুলো বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে! তাদের বাক্স পেটরা, স্যুটকেস, চায়ের কাপ...সব ঠিক আছে। কোনো ধ্বস্তাধ্বস্তির চিহ্ন নেই, মাঝে কোথাও ট্রেন থামেনি। ট্রেনের অন্য কামরাগুলোতে সব ঠিকঠাক আছে। অথচ ৫০ জন যাত্রী যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। পুলিশ ট্রেনের ইঞ্জিনচালক ও তাঁর সহকারীকে ধরে নিয়ে গিয়ে তঁাদের ‘দায়িত্ব’ পালন করল। কেউ কেউ বলল, এটা গণ-অপহরণ। এরপর কেটে গেল অনেক বছর। ছোট স্টেশনের বড় ঘটনাটা খুব বেশি মানুষের জানা হলো না।

১৯৩০ সালে এক রেলস্টেশন থেকে রহস্যময়তার শুরু। শিল্পী: জো, ডিজিটাল আর্ট

পরের ঘটনার পটভূমি ১৯৫৪ সাল। একই কায়দায় গায়েব হয়ে গেল ৩৬ জন যাত্রী। তবে এবার ট্রেন নয়, চলন্ত প্লেন থেকে! ব্রিটিশ যাত্রীবাহী বিমান বিওএসডির ডে হ্যাভিল্যান্ড কমেটের এই বিচিত্র ঘটনা নিয়ে বেশ শোরগোল হলো। প্লেনের ক্যাপ্টেন, কো-পাইলটসহ অন্যান্য ক্রুদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। ফলাফল, খামারগাছা স্টেশনের সেই ট্রেনের কাহিনির মতোই শূন্য।
প্রথম দুই পরিচ্ছদ দিয়েই লেখক মূলত পুরো মনোযোগ কেড়ে নিয়েছেন। লেখার ভাষা এতটাই সাবলীল, খুঁটিনাটি বিবরণ এতটাই চমৎকার—দুটো ঘটনাই বইয়ের পাতায় স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। একটু নড়েচড়ে বসতে হয় পরের পরিচ্ছদে গিয়ে। যেখানে ‘ফ্ল্যাশব্যাক’ শেষে ‘গল্পের বর্তমান সময়’ অর্থাৎ ২০৪১ সালের শুরু। ভবিষ্যতের ঢাকা কল্পনা করতে গেলেই অনেক লেখকের কলম স্বপ্নিল হয়ে ওঠে। দীপেন ভট্টাচার্য স্বপ্নের চেয়ে শঙ্কাগুলোকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।
২০৪১ সালের ঢাকার বর্ণনায় তিনি লিখেছেন, ‘...দোকান আর আমার বাড়ির মাঝ দিয়ে ছোট রাস্তা। দিনের বেলা রিকশা, গাড়ি, ঠেলাগাড়ি, তিন চাকার ছোট ট্যাক্সিতে ঠাসা। ২০৪১ সালেও এই দেশে রিকশা ও ঠেলাগাড়ির আধিপত্যে বিদেশিরা অবাক হয়। এদিকে প্রায় সরকারিভাবেই দক্ষিণ ঢাকাকে পরিত্যাগ করা হয়েছে। ওয়ারী এলাকা থেকে উত্তরের শহরে সহজভাবে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। আর উত্তরের কাছে দক্ষিণ ঢাকা হচ্ছে এক দুর্ভেদ্য অঞ্চল। জনসংখ্যার চাপে, রাস্তার অভাবে, পয়ঃপ্রণালির নিষ্কাশনব্যবস্থার অবক্ষয়ে এই অঞ্চল যেন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন এক যুদ্ধক্ষেত্র। মোটামুটিভাবে বলা চলে, শহরের কোনো অঞ্চলই বসবাসের যোগ্য নয়। অন্যদিকে ২৪ কোটি মানুষের পদভারে দেশের সব অংশই একটা পরিবেশ-সংকটের সম্মুখীন।’
অতিরিক্ত জনবহুল হয়ে যাওয়ায় অফিসগুলো দিন আর রাত, দুই শিফটে খোলা থাকে—এমন ‘আধুনিক বিপর্যস্ত’ ঢাকার বর্ণনা দিতে গিয়েও লেখক অবশ্য তাঁর একটি দুর্বলতা এড়িয়ে যেতে পারেননি। গল্পের একটি চরিত্র ফারহানা। প্রচণ্ড সংকটের সময়ও তাঁর বাসায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান কাহিনির আবহসংগীত হয়ে বাজে। কে জানে, এ সময়ের ‘হঠাৎ তারকা’দের ছাপিয়ে ২০৪১ সালেও হয়তো হেমন্তরাই টিকে থাকবেন!
পৃথিবীর মানুষ একে একে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে, ২০৪১ সালে এই হলো গল্পের মূল সংকট। এমন দুর্যোগের সময়ও দেখা যায়, দেশের রাজনীতিবিদেরা নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলেই বেশি মনোযোগী। লেখক ঘটনাটা এত চমকপ্রদভাবে তুলে ধরেছেন, মনে হয় এমন পরিস্থিতি সত্যিই বাংলাদেশে সম্ভব।
লোকবিরল পৃথিবীতে গল্পের সঞ্চালক অমল, মন্টু, শামসু ভাই আর অমলের পোষা কুকুর কানু—এদের নিয়েই কাহিনি এগোয়। কেন মানুষগুলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, সংকটের সমাধানই বা হবে কী করে—এই রোমাঞ্চ শেষ পৃষ্ঠা অবধি টেনে নিয়ে যায়। বিজ্ঞান কল্পকাহিনি হলেও শেষের দিকে ঘটনার বর্ণনায় অমন নিরেট বিজ্ঞান বোধ হয় সাধারণ পাঠকের জন্য খানিকটা দুর্বোধ্য হতে পারে।