Thank you for trying Sticky AMP!!

সত্য গল্পের রূপকথা

বিশ্বজনীন সংযোগ ও মিথস্ক্রিয়ায় ‘শিল্প’ মানবজাতির সংস্কৃতির প্রায়োগিক ব্যবহারের হাতিহারস্বরূপ। হাতিয়ার মাত্রই যে তা কেবল দ্রোহ-সংগ্রামের শিল্পকর্ম হতে হবে তা নয়। একজন কর্মঠ, সৃজনশীল, উদ্যমী মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, দর্শনের নির্মাণও আধুনিক সভ্যতায় এবং আধুনিক শিল্পচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শিল্পীর ব্যক্তিগত বিচরণ আদৌ কতটা ব্যক্তিপর্যায়ে থাকা সম্ভব সেটা ভাবনার বিষয়। ‘ফ্যাটা মরগানা’ সম্পর্কে রোকেয়া সুলতানা ক্যাটালগে বলেছেন, ‘অনেক দিক বিবেচনা করলে আমার শিল্পকর্ম হলো আমার মনোজগতের ভার্চুয়াল ভ্রমণ।’ শিল্পী রোকেয়া সুলতানা ৩০ বছর ধরে প্রিন্টমেকিং এবং পেইন্টিং দুই মাধ্যমেই কাজ করছেন। ফলে ফ্যাটা মরগানা প্রদর্শনীর শিল্পকর্মগুলোতে একই সঙ্গে চিত্রকর্মের গুণাগুণ ছাপচিত্রকলার রীতিসিদ্ধতার সঙ্গে একত্র হয়ে নতুনতর নান্দনিক অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করেছে। প্রদর্শনীর সবগুলো শিল্পকর্ম যুক্তরাজ্যের নেব্রাস্কালিনক্লোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুলব্রাইট স্কলারশিপের সময়ে করা। রোকেয়া সুলতানা নন-টক্সিক, সহজে ও স্বল্প মেশিনারি বা টেকনোলজির সহায়তায় নতুন পদ্ধতিতে ছাপচিত্রের সম্ভাবনা নিয়ে বিভিন্ন নিরীক্ষা করেছেন এবং সেই নিরীক্ষার ফলাফল শিল্পীর ১২তম একক চিত্র প্রদর্শনী। মাধ্যমগতভাবে শিল্পী একে বলছেন ইউনিক প্রেসার প্রিন্ট, যা জাপানে তৈরি নিশিনোউচি কোজো নামক বিশেষ ধরনের কাগজের ওপরে করা। রোকেয়া সুলতানা ২০১০ সালে ‘দ্য মিসটিক এমপেরর’ শীর্ষক একক প্রদর্শনীতে যেসব পেইন্টিং করেছিলেন, সেগুলোতে বিভিন্ন ফর্ম, রঙের স্বচ্ছতা, নমনীয়তা এবং সর্বোপরি আধা-বাস্তবানুগ মানুষের অবয়ব তাল-লয়সমৃদ্ধ ড্রয়িং নিয়ে উপস্থিত ছিল। তিনি মানুষ, প্রকৃতি, জীবন নিয়ে ছবি আঁকেন। তাঁর ছবিতে একধরনের অতীতবিধুরতা, এক ধরনের প্রেম ও বিষাদবিধুরতার রোমান্টিসিজম দেখা মিলেছে। আবার যে আঙ্গিকসমূহের সমন্বয়ে রোকেয়া সুলতানা দেশকালভেদে আন্তর্জাতিকতাবোধমুক্ত হতে চান, তা বাংলাদেশের শিল্প-অঙ্গনের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে উতরে যায়। নিজের কাজ নিয়ে বলেন, ‘আমি সিরিজ ধরে শিল্পকর্ম করতে পছন্দ করি। আগের কাজগুলোতে মানুষ, বস্তু, ফর্ম, রং, নিত্য ব্যবহূত বস্তু ইত্যাদি; এদের পরস্পরের সম্পর্ক, যা প্রকৃতি দিয়ে প্রভাবিত, তা নিয়ে কাজ করেছি। এই নতুন কাজগুলো সেই ক্রমের পরিবর্ধিত রূপ।’ ফ্যাটা মরগানা একটি ইতালিয়ান শব্দ, যার বাংলা অর্থ এককথায় মরীচিকা। নির্দিষ্ট বায়বীয় পরিস্থিতিতে ফ্যাটা মরগানা সমুদ্র বা স্থলভাগের দিগন্ত বরাবর দেখা যায়, যা আসলে একধরনের দৃষ্টিবিভ্রম তৈরি করে। ফ্যাটা মরগানা শব্দটি একটি বাগধারা, যা লাতিন ‘ফেইরি’ এবং আর্থারিয়ান জাদুকর মরগ্যান লি ফ্লেই থেকে উদ্ভূত। এই নামের অন্তর্ভুক্ত দ্য লিভিং ওশান, ভেনাস ক্রসিং দ্য মুন, অফ টাইম অ্যান্ড স্টারস, সোলারিস, ফ্যাটা মরগানা, ফ্লোরা, ফিওনা অ্যান্ড আই শিরোনামের অনেকগুলো সিরিজের শিল্পকর্মগুলো নানা মাত্রায় প্রতীক/রূপক তথা সিম্বলিক। এ প্রসঙ্গের বিশ শতকের শিল্পবোদ্ধা সুজান ল্যাঙার বলেছিলেন, ‘শিল্প হলো মূলত সিম্বল’ অর্থাৎ প্রতীক, উপমা, সংকেত ইঙ্গিত হলো নির্দিষ্ট কনটেক্সটে কতিপয় মূর্ত বা বিমূর্ত ফর্মের সমন্বয়। কারণ, রোকেয়া সুলতানার এই সিরিজগুলোর প্রধানতম কর্তৃত্বপরায়ণ গঠনগত বৈশিষ্ট্য হলো নানাবিধ ফর্মের কম্পোজিশনে সৃষ্ট নকশা বা ডিজাইন, যা আবার একধরনের প্রহেলিকা বা ইলিউশন সৃষ্টি করে। কখনো দর্শকের মনে হতে পারে আকাশের অপারের বিশাল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব কিংবা কখনো সমুদ্রের জলের নিচের অতলের কথা। ফলে একধরনের চেতনাজাত দৃশ্যমান ফ্যান্টাসি নির্মাণ হয়। অনেক কর্মের ভেতরে একটিকে মূল ফোকাস করে বাকিগুলোকে নিয়ে শিল্পী স্বাধীন ও দুঃসাহস নিয়ে খেলেছেন। রং ব্যবহারে পূর্ণ পরিশীলিত রূপ ও স্বাধীনচেতা মনোভাবের নিয়ন্ত্রিত সমন্বয়। একজন আবেগী, নিজের সাধনার সঙ্গে সদা বোঝাবুঝি সম্পর্ক নিয়ে রোকেয়া সুলতানা সমসাময়িক বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী হিসেবে বিবেচিত। ফ্যাটা মরগানাতে রোকেয়া সুলতানা যে রহস্যময়তা ও আধ্যাত্মিকতা আরোপ করেছেন তা একান্তভাবেই আমাদের এ অঞ্চলের বাউল আধ্যাত্মিক জীবনের রহস্য, যা আবার একই সঙ্গে বাস্তব জীবনের সহজিয়া যাত্রার অপর নাম। এই বহুমাত্রিক আঙ্গিকের উন্মোচন একুশ শতকের একজন উচ্চ কল্পনাপ্রবণ প্রকাশবাদী শিল্পীর বৈশিষ্ট্য।

১৭ মে থেকে বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে শুরু হওয়া ‘ফ্যাটা মরগানা’ শিরোনামের একক প্রদর্শনীটি চলবে ১১ জুন পর্যন্ত।