Thank you for trying Sticky AMP!!

সাহেব-মেমের চোখে বাংলার ঝড়

উইলিয়াম হিকি দেখলেন, ঝড়ের প্রবল দাপটে তাঁর বাড়ির বারান্দার অবস্থা বেহাল। অলংকরণ: আরাফাত করিম
>কালবৈশাখী চিরকালই রণমূর্তি ধারণ করে এসেছে বাংলায়। কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলে বিলেতি সাহেব-মেমসাহেবরা বৈশাখের ঝড়-বাতাসকে দেখেছেন যথেষ্ট আতঙ্ক নিয়ে, একটু ভিন্নভাবে।


১৭৭৮ সাল। ভারতজুড়ে কোম্পানির সদম্ভ শাসন আস্তে আস্তে পোক্ত হচ্ছে। এমন সময় কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের অ্যার্টনি হয়ে এলেন ২৮ বছর বয়সী এক তরুণ ইংরেজ আইনজীবী—উইলিয়াম হিকি। মাসখানেক তাঁর কাটল কলকাতা শহরে। প্রথম প্রথম বঙ্গীয় গ্রীষ্মকালের ঝড়-জলমাখা বিমিশ্র আবহাওয়া খারাপ লাগছিল না তাঁর। কারণ, ‘ঝড়ের পরের বাইরের আবহাওয়া বেশ শান্ত, শীতল ও উপভোগ্য’। যদিও অচিরেই বাংলার ঝড় সম্পর্কে তাঁর এই আপাতনিরীহ ধারণা বদলাতে বাধ্য হলেন হিকি। এমনটি কেন ঘটল? খোলাসা করেই বলি। হিকি নিজের থাকার জন্য একটি বাড়ি ভাড়া করেছিলেন কলকাতা শহরে, নিজের খরচাতে সেই বাড়িতে নতুন বারান্দা তৈরি করানো থেকে শুরু করে নানা সংস্কারকাজেও টাকা ঢালতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু বিধিবাম। ১৭৭৮ সালের এপ্রিলের শেষার্ধে তিনি গিয়েছিলেন এক বন্ধুর বাড়িতে, খানাপিনা ও মৌজমস্তি করতে।Ñএমন সময় উঠল তীব্র কালবৈশাখী ঝড়। মৌজমস্তি ভুলে হিকির বুকে তখন বাজছে দুরুদুরু শঙ্কার ঢাক। কারণ, ঝড়টা উঠেছিল উত্তর–পূর্ব কোণ থেকে, আর তাঁর নতুন ভাড়া করা বাড়িও ওই মুখো। সুতরাং বন্ধুর বাড়ি ছেড়ে দ্রুতপায়ে ব্যক্তিগত আবাসের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে যাত্রা করলেন। সেখানে ফিরে দেখলেন, তাঁর নিজের টাকায় গড়া ‘সাধের বারান্দা ধুলোয় গড়াগড়ি যাচ্ছে, উঠোনের ওপর তার ভগ্নস্তূপ ছড়িয়ে রয়েছে।’ আর বাড়ি তো নয়, বাড়ির কঙ্কালটাই শুধু পড়ে আছে!
বাংলার ঝড়ের পাল্লায় পড়ে নাজেহাল হওয়ার এহেন বিষম বর্ণনা উইলিয়াম হিকি তাঁর সুবৃহৎ স্মৃতিকথার পুস্তকে লিখে গিয়েছিলেন। বাঙালির মন ঝড়ঝঞ্ঝাকে দেখেছে ইতি-নেতির মিশেলে। বাঙালি কবি-সাহিত্যিকেরা দুরন্ত বঙ্গীয় কালবৈশাখী বা গ্রীষ্মকালের ঝড়-বাতাস নিয়ে কম কাব্য লেখেননি। ঝড়-বজ্রপাতে প্রাণহানির হাহাকার যেমন সেসবের মধ্যে পাই, তেমনি কারও কারও স্মৃতিচারণে মেলে ঝোড়ো হাওয়ার দিনে আম কুড়ানোর আনন্দও। ঔপনিবেশিক আমলে যেসব ইংরেজ সাহেব-মেম এই বাংলা মুলুকে এসেছিলেন, তাঁদেরও নজরে পড়েছিল এখানকার কালবৈশাখী ও গ্রীষ্মের ঝড়ের দাপট। সাহেব-মেমদের লেখা একাধিক স্মৃতিকথা-দিনলিপিতেও আছে বাংলার ঝড়ের কথা। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঝড়ের মধ্যে পড়ে নাকাল হওয়া কিংবা ঝড়ের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগ-দুর্দশা-প্রাণহানির নেতিবাচক কিংবা উদ্ভট বর্ণনার পূর্ণ বিবরণই শুধু দিয়ে গেছেন তাঁরা। ঝড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা তাঁদের লেখাজোখায় প্রায় অনুপস্থিত। অবশ্য দু-একটি ব্যতিক্রম পাওয়া যে যায় না একেবারে, এমন নয়।
যেমন ধরা যাক, এক ইংরেজ কেরানি-পত্নী ফ্যানি পার্কসের কথা। ১৮২৩ সালের পয়লা জুন নিজের ব্যক্তিগত দিনলিপিতে (এটি পরে উইলিয়াম ডালরিম্পলের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে) কলকাতায় বসে গ্রীষ্মকালীন ঝড় দেখার অভিজ্ঞতা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন এভাবে: ‘সকালটা খুব গরম ছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে বৃষ্টি এমনভাবে পড়ছে যে মনে হচ্ছে দুনিয়াকে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য স্বর্গের জানালাগুলো ফের খুলে গেছে; ভয়ংকরভাবে বাজ পড়ছে, আর তীব্রভাবে ঝলসাচ্ছে বিদ্যুৎ। ইউরোপে এমন বজ্রপাতের আওয়াজ কদ্যপি শুনিনি।’ পরে তিনি আরও লিখেছেন, ‘ইংল্যান্ডে ঝড়-বৃষ্টি নেহাতই গরম থেকে রেহাই পাওয়ার আনন্দে ভরপুর, সেখানে কেউ ঝড়-বজ্রপাতের এমন ভয়ানক রূপের কথা চিন্তাও করতে পারে না।’
ফ্যানির মতো বাংলার গ্রীষ্মের ঝড় সম্পর্কে প্রায় অনুরূপ অনুদার বর্ণনা দিয়েছেন এক ইংরেজ সিভিলিয়ানও। ১৮৫৯ সালে পূর্ববঙ্গের তৎকালীন ময়মনসিংহ মহকুমায় শাস্তিস্বরূপ সিভিল জজ হিসেবে বদলি হয়ে আসা উইলিয়াম টেইলর (পদাবনতি ঘটিয়ে তাঁকে সিভিল জজ করা হয়)। টেইলর তাঁর স্মৃতিকথা থার্টি এইট ইয়ারস ইন ইন্ডিয়া বইয়ে ওই সময়ের ময়মনসিংহের কথা লিখতে গিয়ে সেখানকার গ্রীষ্মের ভয়ানক ঝড়ের কথা বেশ সবিস্তারে বলেছেন। দিয়েছেন গারো পাহাড়ের প্রান্তে মেঘ জমা থেকে শুরু করে পূর্ণরূপে গোটা জেলায় ঝড়ের আবির্ভাবের বর্ণনা। তাঁর মতে, অন্য এলাকার ঝড়ের সময়কার বজ্রধ্বনি ও বিদ্যুতের চমক যেন নেহাত পায়রার বাক–বাকম আওয়াজ। আর ময়মনসিংহের ঝড়ের সময়কার কর্কশ আওয়াজ ও ঝলসানো বিদ্যুৎরেখা দেখে মনে হয়, রোমান পুরাণের আকাশদেবতা জুপিটার বুঝি পাগলা হয়ে গেছেন, নয়তো তিনি তাঁর চিরশত্রু টাইটানদের হাত থেকে নিজের সিংহাসনকে রক্ষা করার জন্য লড়ছেন। টেইলর লিখেছেন, এখানকার ঝড় দেখার পর বিলেতের ঝড়কে মনে হবে যেন ‘কোমল পশ্চিমা বাতাস’ কিংবা ‘ভায়োলেট ফুলের গুচ্ছের ওপর দিয়ে বয়ে চলা মধুর দখিনা বাতাস’। খানিক বক্রোক্তি, সন্দেহ নেই। তবে টেইলর নিজের এই নির্বাসনের সময়ে এমন ঝড়ের দৃশ্য দেখাকে সৌভাগ্য বলেও অভিহিত করেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়। কেন যে এই স্ববিরোধ, কে জানে!

অলংকরণ: আরাফাত করিম

১৮৬৫ সালের বৈশাখ মাসের গোড়ায়, একদিন সকালে তুমুল ঝড়ের পর তৎকালীন মাদারীপুর মহকুমার প্রশাসক আর্থার লয়েড ক ্লের কাছে খবর এল, বজ্রপাতে কয়েকজন স্থানীয় লোকের প্রায় মরণদশা। ঘটনা শুনে তৎক্ষণাৎ ক্লে সাহেব নিজের পোষা ঘোড়ায় চেপে অকুস্থলে রওনা দিলেন। সঙ্গে নিলেন একজন স্থানীয় চিকিৎসক ও দারোগাকে। সেখানে পৌঁছে দেখলেন, ‘এই ঘটনায় তিনজন পুরুষ বাঁশ কর্তনের সময় বজ্রাহত হয়েছিল; এদের মধ্যে একজন মারা গেছে, যে ঝাড়ে সে কাজ করছিল, সেখানেই তাকে পড়ে থাকতে দেখা গেল। লক্ষ্যণীয়ভাবে বাঁশগুলো অক্ষত ছিল।’ বাকি দুজনের পরিণতি অবশ্য এত করুণ হয়নি, তারা স্রেফ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। পরে স্থানীয় ডাক্তার গায়ে পানি ছিটিয়ে তাদের সুস্থ করে তোলেন। এর বছর দুই পর, ১৮৬৭ সালে ঢাকায় বদলি হন ক্লে। ওই সময় তাঁকে নিদারুণ নাকাল করেছিল জ্যৈষ্ঠের ঝড়। ঘটনাটি এমন, ওই বছর মে মাসের শেষ দিকে মুন্সিগঞ্জ যাচ্ছিলেন তিনি। তা-ও আবার নৌকায় চড়ে। উদ্দেশ্য, সেখানে গিয়ে শিকার করবেন (শৌখিনদার ক্লের বন্য প্রাণী শিকারের নেশা ছিল)। গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই, ২৮ মে হঠাৎই ঝড় উঠল তেড়েফুঁড়ে। প্রথম প্রথম ক্লে ভাবলেন, ঝড়ের মধ্যেও নদীপাড়ের রাস্তা দিয়ে গুন টেনে নৌকাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া যাবে। কিন্তু ঝড়ের গতি ক্রমে বাড়ছিল। আর এমন সময় গুন টানার পথেও ঝড়ের তোড়ে উড়ে এসে পড়ল দুটো বিশাল গাছ। এই অবস্থায় পথ চলতে গেলে তো জান খোয়ানোর শঙ্কা থাকে। অতঃপর ক্লে নিরাপত্তার খাতিরে নৌকা পাড়ে ভেড়াতে বাধ্যই হলেন এক রকম। কিন্তু প্রচণ্ড ঝড়ের তোড়ে নৌকা বেঁধে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোনো রকমে যাতায়াতের নৌকাটিকে স্রোতে ভেসে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারলেও তাঁর রান্নার জন্য আলাদা করে রাখা ছোট নৌকাটা তখন ডুবে গিয়েছিল। বাংলার ঝড়ঝঞ্ঝার মুখোমুখি হওয়ার এই সব বিচিত্র কাহিনি ক্লে লিখে গেছেন তাঁর বই লিভস ফ্রম এ ডায়েরি ইন লোয়ার বেঙ্গল-এ। 

টু আন্ডার দ্য ইন্ডিয়ান সান-এর প্রচ্ছদ

উনিশ শতক পার করে, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পূর্ববাংলার নারায়ণগঞ্জ শহরে পিতার কর্মসূত্রে শিশুকালেই এসেছিলেন দুই সহোদরা, জন গডেন ও রুমার গডেন। নারায়ণগঞ্জে কাটানো শৈশবের স্মৃতি নিয়ে গডেন ভগ্নিদ্বয় পরে টু আন্ডার দ্য ইন্ডিয়ান সান শিরোনামে যে স্মৃতিকথা লেখেন, তাতে পাই গ্রীষ্মকাল আসতে না আসতেই ঝড়ের পাল্লায় পড়ার আখ্যান। মার্চ মাসের এক ঝড়ের বিবরণ দিতে গিয়ে তাঁরা লেখেছেন: ‘বাগানের গাছগুলোর ঊর্ধ্বপানে ওড়ার দশা, সেগুলো ঝাঁকুনি খাচ্ছিল। তালগাছগুলো মাটিতে প্রায় নত হয়ে পড়েছে আর আকাশজুড়ে পাতা, ডাল এবং এমনকি গাছের খণ্ডাংশও উড়ছে।’
আরেকটি বড় ঝড় যেদিন এল, সেদিন দুই বোন নারায়ণগঞ্জের বাইরে ছিলেন। পরে বাড়ি ফিরে বাবার কাছ থেকে শুনলেন, তীব্র ঝড় নাকি আস্ত একটা প্যাডেল স্টিমারকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তবে ঝড়ের সময়কার যে ঘটনাটি তাঁদের কিশোরী মনকে সবচেয়ে বিস্মিত করেছিল তা হলো, বাড়ির চাকর নিতাইয়ের বৃদ্ধা মা নাকি ওই ঝড়ের বেদম বাতাসে উড়ে গিয়ে একটা বাঁশের খুঁটিতে আটকে অনেকক্ষণ ঝুলে থেকে ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে কর্মরতা ব্রিটিশ শিক্ষিকা এ জি স্টকের চোখে ধরা পড়েছিল ঢাকা শহর, তথা বাংলার ঝোড়ো আবহাওয়ার অভিনবত্ব। খেয়াল করি, তাঁর মনে ঝড়ের নেতিবাচক চিত্রের চেয়ে¯স্নিগ্ধ-প্রাকৃতিক রূপটিই ছাপ ফেলেছিল বেশি। অন্যান্য ইংরেজ লেখকের তুলনায় যা কিনা ঢের ব্যতিক্রমই বলতে হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের প্রাক্কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে তিনি যখন যোগ দেন, তখন প্রায় প্রতি রাতেই ঝড় উঠছে ঢাকায়। ওই সময়ের ঢাকার ঝড় নিয়ে স্টকের সংবেদী অভিজ্ঞতার অনুপম নিদর্শন মেলে তাঁর স্মৃতিগ্রন্থ মেমোয়ারস অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি ১৯৪৭-১৯৫১-এ। সেখান থেকেই একটি উদ্ধৃতি দিয়ে এই নিবন্ধের ইতি টানছি: ‘মেঘের ফাঁকে ফাঁকে বিজলি চমক দিচ্ছে, ক্রমাগত মেঘের গুরুগুরু ধ্বনি শোনা যায়। তারপর হয়তো একটি বাতাস উঠবে, প্রথমে মনে হবে যেন দূরের গাছগুলোর দীর্ঘশ্বাস। ক্রমশ জোরালো হবে, তারপর অগ্রসরমাণ সেনাবাহিনীর মতো বাংলোটার ওপর হামলে পড়বে। তারপর ধীরে ধীরে অজানা গন্তব্যে সরে যাবে।...’ (অনুবাদ: মোবাশ্বেরা খানম)।
বৈশাখের বন্দনা কম হয়নি বাংলায়। নানাজন নানাভাবে দেখেছেন কালবৈশাখীকে। তবে ঔপনিবেশিক আমলে আসা বেশির ভাগ বিলেতি সাহেব ও মেমসাহেব বৈশাখের ঝড়ঝঞ্ঝাকে দেখেছেন নেতিবাচক দৃষ্টিতে। উপরন্তু এ ঝড়-বাতাসকে তাঁরা উদ্ভট সব বর্ণনায় ভারাক্রান্ত করেছেন। কেন ইংরেজদের এমন মনোভাব? এর মূলে হয়তো রয়েছে উপনিবেশের মানুষ ও পরিবেশকে নেতিবাচকভাবে চিহ্নিত করার তাঁদের সাবেকী একচোখা মনোভাব।