Thank you for trying Sticky AMP!!

স্মৃতিমেদুর আত্মজৈবনিক উপন্যাস

ইমদাদুল হক মিলনের মায়ানগর আত্মজৈবনিক উপন্যাস। এর নায়ক ১০ বছরের মিলু। তারই বয়ানে এই উপন্যাসের শুরু এবং শেষ। পুরান ঢাকার জিন্দাবাহার লেন থেকে এসে মিলুদের পুরো পরিবার ওঠে গেন্ডারিয়ার একটা অপ্রশস্ত এক কামরার বাসায়। মিলুরা অনেক ভাইবোন। প্রতিবছরই মা সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। তাদের গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডলে। পরিবারের একটা অংশ সেখানেও থাকে। মেদিনীমণ্ডলের স্কুলে পড়ে মিলু। বেড়াতে আসে বাবার চাকরিস্থল ঢাকায়।

মিলু অকপটে বলে গেছে তাদের পরিবারের কথা। নিজের পরিবারসহ চারপাশের যা কিছু সে দেখেছে, তা-ই বলে গেছে নিজের মতো করে।

ঘটনাক্রমে বাবার চাকরি না থাকায় একসময় তারা ভয়ানক দারিদ্র্যের শিকার হয়েছিল। মিলুর বর্ণনায় সেই ঘটনার পাঠ সত্যিই মনকে ছুঁয়ে যায়। সে বলে, ‘সেই বর্ষায় তীব্র অভাব চলছে আমাদের। একদিন রান্না হয়, একদিন হয় না। কোনো কোনো দিন শুধু জাউ খেয়ে থাকি, বউয়া বা লেটকা খিচুড়ি খেয়ে থাকি। ঘরে কিছু নেই। সকালবেলা কোনো কোনো দিন শুধু কয়েক মুঠ আউশ চাল ভাজা।...খুদের জাউ বউয়াও আমাদের কোনো কোনো দিনের খাবার। শাকপাতা, কচুঘেঁচু।’

বাঁচার জন্য বিক্রি করতে হচ্ছে ঘরের পুরোনো জিনিসপত্র, এমনকি জমিজমাও। কিন্তু মিলুর বাবার চাকরি হয়ে যাওয়ার পর সেই কষ্ট থাকে না। আছে সেই বিবরণও।

এই উপন্যাসের শৈলীগত সবচেয়ে বড় গুণ, ছোট্ট মিলু যা দেখে, তা অকপটে বলে। তার মধ্যে কোনো কৌশল নেই। এর মূলে আছে লেখকের নিজের জীবনের দেখা ঘটনা। এ যেন এক সামান্য ছদ্মবেশ। এই ছদ্মবেশই যেমন মায়ানগরকে জীবনী হতে দেয়নি, একইভাবে এটি উপন্যাস হয়ে উঠলেও—মিলনের জীবনকে—তাঁর কৈশোরকালের একটা পর্বকে আড়াল হওয়ার অবকাশ দেয়নি।

মিলু, ঢাকা এবং মেদিনীমণ্ডলে সমানভাবে যাচ্ছে। তবে একটি পর্যায়ে ঢাকাই হয়ে ওঠে উপন্যাসের মুখ্য চারণভূমি। বিংশ শতাব্দীর ছয়ের দশকের সূচনালগ্নের পুরান ঢাকার অলিগলির রূপ-রস-গন্ধ যাঁরা পেতে চান, মিলনের এই আত্মজৈবনিক উপন্যাসের স্বাদ তাঁরা গ্রহণ করতে পারেন। জিন্দাবাহার ছেড়ে মিলুরা যখন গেন্ডারিয়ায় এসে ওঠে, তখন ওর সঙ্গী হয় তারই সমবয়সী মেয়ে লুৎফন। লুৎফন তাকে দেখায় গেন্ডারিয়ার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রেললাইন, রেলগাড়ি। দেখায় ধোলাইখাল। সেই খালকে ঘিরে বয়ে চলা দৈনন্দিন জীবনের ধারা...আরও কত-কী! পুরান ঢাকার এমন কোনো অলিগলি নেই, যা লুৎফন চেনে না। মিলু যেদিন লুৎফনের সঙ্গী হয়, সেদিন, মিলুরই ভাষায়, ‘লৎফন তো হাঁটছে না, ছুটছে। দৌড়াচ্ছে। আমি ওর সঙ্গে হেঁটে পারি না। ইলাস্টিক ঢিলা হওয়া প্যান্ট কোমর ছাড়িয়ে নামছে। ছুটতে ছুটতেই লুৎফন আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। এই মিলু, তর নুনু দেহা যায়। হি হি।’ এ রকমেরই জুটি তারা।

এ রকমের হাসিখুশি, সাহসী যে লুৎফন, মিলুকে বলে বসে, একদিন সে হারিয়ে যাবে। সত্যিই একদিন দেখা গেল যে বড় বোনের বাসায় লুৎফন থাকত, সেখানে সে নেই। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কত দিকে খোঁজা হলো, সন্ধান মিলল না লুৎফনের। মিলুর ভীষণ মন খারাপ। অবশ্য পরদিনই খবর পাওয়া গেল, বোন জামাইয়ের অযাচিত গাল-মন্দ শুনে অভিমান করে নিজের বাড়িতে চলে গেছে লুৎফন। তার আকস্মিক অন্তর্ধান উপন্যাসের পরবর্তী অধ্যায়গুলোকে যেন শূন্যতায় ভরিয়ে তোলে। তবে মিলুর জীবন থেমে থাকে না। এক কামরার বাসা ছেড়ে তারা ওঠে বড় বাসায়। জহুরা নামে একজনের সঙ্গে পারিবারিকভাবে ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছিল তাদের, তার সঙ্গে ওদের গড়ে ওঠে নিবিড় সখ্য। নতুন বন্ধু হিসেবে মিলু পায় আলীকে। সে-ও মিলুকে দেখায় পুরান ঢাকার অনেক কিছু।

১৯৬৪ সালের হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার ঘটনাও মিলুকে স্পর্শ করে। ১০ বছর বয়সী মিলু। শোনা যাক তার প্রতিক্রিয়া, ‘ঢাকার রায়টের কথা দেশে বসে শুনেছি।...রায়ট কথাটাকে তারা বলেন “কাডাকাডি”; অর্থাৎ কাটাকাটি। মোসলমানরা দল বেঁধে বেরোচ্ছে তরোয়াল নিয়ে।...তরোয়ালের কোপে নামিয়ে দিচ্ছে হিন্দুদের কল্লা। হিন্দুরা বেরোচ্ছে রামদা নিয়ে। তারাও রামদায়ের কোপে নামাচ্ছে মোসলমানদের কল্লা। শুনে ভয়ে আতঙ্কে বুজির সঙ্গে আজাদ আর আমারও মুখ শুকাত। আব্বাকে নিয়ে খুব চিন্তা বুজির। গেন্ডারিয়া থেকে লক্ষ্মীবাজারে যায় অফিস করতে। ওই দিকে ম্যালা হিন্দু পাড়া। কোনো বিপদে পড়ে কি না “খোকার বাপ”?’

একসময় মিলুরা চলে যায় গ্রামের বাড়িতে। সমাপ্ত হয় উপন্যাসটি। কিন্তু সমাপ্তির মাঝখানে যে গল্প আছে, তা বড় মায়াভরা। মন কেমন করা।

আন্তরিক ভঙ্গিতে লেখা ইমদাদুল হক মিলনের এই উপন্যাসটি বহুল পঠিত হোক।

মায়ানগর

ইমদাদুল হক মিলন

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১৮

১৬০ পৃষ্ঠা, দাম: ৩২০ টাকা।