Thank you for trying Sticky AMP!!

'একজন লেখকের জীবনে অভাবনীয় যা যা ঘটতে পারে, সেগুলো আমি প্রত্যক্ষ করেছি'

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮-১৯ জুলাই, ২০১২) প্রতিকৃতি: কাইয়ুম চৌধুরী

কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কে মারা যান ২০১২ সালের ১৯ জুলাই। শেষবারের মতো নিউইয়র্ক যাওয়ার আগে নুহাশ পল্লীতে এই কথাসাহিত্যিকের শেষ দিন ছিল একই বছরের ২৫ মে। এ দিনে দিনভর ছবি তোলার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন নাসির আলী মামুন 

নাসির আলী মামুন: আপনি আমাকে বলেছেন, কে যেন আপনাকে সবকিছু দিয়ে যায়। তিনি কে? আপনাকে কী দিয়ে যায়?

হুমায়ূন আহমেদ: সবকিছু দিয়েও মুহূর্তের মধ্যে যিনি নিয়ে যেতে পারেন, তিনি। নিশ্চয়ই তিনি সৃষ্টিকর্তা, গড। আমার যা কিছু প্রাপ্তি, সামান্য সম্মান, লেখালেখি, বন্ধুত্ব—সব তাঁরই। মানুষ শুধু চেষ্টা করতে পারে। অনেকে জীবনভর তপস্যা করেও গন্তব্যে পৌঁছুতে পারে না। একজন লেখকের জীবনে অভাবনীয় যা যা ঘটতে পারে, সেগুলো আমি প্রত্যক্ষ করেছি।

মামুন: পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পুরস্কারটি কিন্তু আপনি পাননি!

হুমায়ূন: কোনটি?

মামুন: বলতে হবে...।

হুমায়ূন: হ্যাঁ। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কুড়িজন লেখকের কথা যদি বলো, দেখবে তাঁদের সবাই ওটি পাননি। তলস্তয় কি পেয়েছিলেন, পাননি! তিনি তো পৃথিবীর সব ভাষায় পঠিত। একজন সৃষ্টিশীল লেখকের প্রাপ্তি শুধু পুরস্কারে আটকে থাকে না। পুরস্কারের পরিকল্পনা থাকলে সাহিত্যিকের জীবন ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে যায়। তিনি যা লেখেন, পাঠক বেশি দিন সেটা গ্রহণ করে না। কিছুকাল পাঠকদের টানতে পারলেও সেটি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আমি তোমাকে এ রকম দুই ডজন লেখকের নাম বলতে পারি, যারা পুরস্কারে মোহগ্রস্ত থাকে, তাদের সাহিত্য হয় পরিকল্পিত।

মামুন: সবাই তো পরিকল্পনা করেই লেখেন?

হুমায়ূন: পরিকল্পনা বা চিন্তা করে লেখে, কিন্তু পরিকল্পিত নয়। পরিকল্পিত লেখা জীবনবিমুখ। পাঠকদের মনে অনুপ্রবেশ করে না। বিদ্যুৎ যখন চমকায়, তখন সবাই দেখে। আর বিদ্যুৎ কীভাবে চমকায়, সেটা বলার দরকার হয় না।

আমার কাছে চরিত্রেরা চলে আসে মিছিলের মতো, অগণিত। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে যেমন ঝরঝর করে বৃষ্টি নামে, তেমনি এটা চলে আসে। কেউ আহ্বান করে আনতে পারে না। একজন সত্যিকার লেখক যত দিন সৃষ্টিশীল থাকে, তত দিন তাকে চরিত্র উদ্ভাবন করতে গবেষণা করতে হয় না।

মামুন: আপনার কাছে চরিত্রেরা চলে আসে?

হুমায়ূন: বললাম তো...। আমার এখন এসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না। চলো হাঁটি।

মামুন: হুমায়ূন ভাই, আরেকটু বসেন। তাহলে আর কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি...

হুমায়ূন: আর সাহিত্য না। এখন না। চলো গাছের সঙ্গে কথা বলি। ওদের কারুকাজ সৃষ্টি...আমাকে তো মাঝে মাঝে লতাপাতা দিয়ে জড়িয়ে ধরে। আমি বুঝি বৃক্ষেরও মায়া জন্মায়। তারাও মানুষ চেনে। এখানকার অধিকাংশ গাছই আমার হাতে লাগানো। ওদের বীজ নিজের হাতে লাগিয়েছি, চারাও ছিল। ধীরে ধীরে আমার স্নেহে ওরা বিকশিত হচ্ছে। আমাকে চিনতে পারছে। আমি কাছে গেলে গাছের ডগাগুলো আমার মুখে-শরীরে নেতিয়ে পড়ে। পশুরা যেমন মনিবকে কাছে পেলে আদর পেতে চায়, গাছেরাও আমার সঙ্গে তা-ই করে। নুহাশ পল্লী আমার জন্য অক্সিজেন। আমার লেখালেখির রসদ এখান থেকে পাই।

মামুন: আপনি তো প্রকৃতির ওপর ভরসা করে অথবা প্রকৃতি নিয়ে লেখেন না।

হুমায়ূন: বলছি তো সাহিত্য নিয়ে এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। বসতে পারছি না, ব্যথা। মনের জোরে খুব সকালে উঠে হাঁটলাম, সমস্ত শরীরে আড়ষ্টতা। ওষুধ, নিয়ম—এই সব নিয়ে আছি। ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে সবাইকে দেখতে আসলাম।

তুমি তো আমার ওজন পার্কের বাসায় (নিউইয়র্কে) গেলে ছবি তুলতে। এখান থেকে প্রায় প্রতি সপ্তাহে আমাকে নুহাশ পল্লীর সব গাছপালার ভিডিও পাঠানো হতো। ঘণ্টাব্যাপী ভিডিও ফুটেজ অসুস্থতার মধ্যে আমাকে সান্ত্বনা দিত, যা ডাক্তাররা দিতে পারত না। আমি তো গাছ-ফুলের সঙ্গে কথা বলার মানুষ। এগুলো ছাড়া আমি বাঁচি কী করে? আজকে সন্ধ্যায় ধানমন্ডির বাসায় ফিরতে হবে। তুমি থাকো, অনেকে আসবে। কয়েক দিন ধরে পরিশ্রম করে গাড়ি আসার রাস্তা তৈরি করা হলো। আজকে অনেক বন্ধু আসবে। দুপুরে একসঙ্গে খাব। দেশে এসে প্রচুর খাচ্ছি। মাগুর মাছের ঝোল, দেশি মুরগি খুব খাচ্ছি। পেছনের পুকুরটায় অনেক মাছ। আজকে ধরতে বলেছি—দিঘি লীলাবতী।

মামুন: ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে...’

হুমায়ূন: জল এসে যায়, নীরবে কাঁদি আমি, চোখে জল আসে।

মামুন: সন্তানদের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে?

হুমায়ূন: হয়নি, ওরা অভিমান করে বসে আছে। বাপের ওপর রাগ। দেখা হবে। আমি তো আরও কয়েক দিন দেশে আছি। ওরা আসবে। ওদের সঙ্গে দেখা হবে। আমি অপেক্ষায় আছি, একসঙ্গে অনেক কান্নাকাটি করব আমরা!

মামুন: আপনার বর্তমান অবস্থা নিয়ে চিকিৎসকেরা কী বলেছেন?

হুমায়ূন: প্রথম অসুখ ধরার পর ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন চিকিৎসকের মতে ধীরে ধীরে সেরে উঠছি। দেয়ালটা শেষ করতে হবে। আরও দুইটা সিনেমা ঠিক করে রেখেছি। শরীরে শক্তি এলে উপন্যাসও লিখব। এবার যাওয়ার পর নিউইয়র্কে আমার ছবির একক প্রদর্শনী হবে। ছবি এঁকে রেখে এসেছি, ফ্রেম হচ্ছে।

মামুন: ছবিগুলো আমি দেখেছি। আমার সামনে নিউইয়র্কের বাসায় হ্যাট পরা অবস্থায় আপনি স্বাক্ষর করলেন, ছবি তুললাম।

হুমায়ূন: কেমো দিলে সব চুল পড়ে যায়। আমার এক বন্ধু হ্যাট উপহার দিল। প্রথম দিকে যখন ডাক্তারের কাছে গেলাম, আমার অসুখটা নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন করলাম। তিনি আনন্দের সঙ্গে উত্তর দিলেন। সবশেষে একটা প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা ডাক্তার, আমি কি বাঁচব?’ তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন, বললেন, ‘না।’ আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। তবে কি এই ক্যানসারেই আমার শেষ। মুহূর্তেই ডাক্তার যখন বললেন, কোনো মানুষই চিরকাল বেঁচে থাকে না। তুমিও থাকবে না। কিন্তু আমার কাজ হলো তোমাকে সুস্থ করে তোলা। আমি স্বস্তি পেলাম। মনে হলো আবার নতুন করে বাঁচতে হবে আমাকে।

নুহাশ পল্লীতে একটি শিশু—অ্যাক্রোলিকে অঁাকা এই ছবিটি হুমায়ূন আহমেদ এঁকেছিলেন ২০১২ সালে, ‘দখিন হাওয়া’য় বসে। জীবনের শেষ দিকে ছবি অাঁকায় দারুণ মজেছিলেন তিনি। ছবিটি পাওয়া গেছে নাসির আলী মামুনের সৌজনে্য।



মামুন:
আপনার অসুস্থ অবস্থায় আঁকা চিত্রকর্মে একাকিত্ব এবং নিঃসঙ্গ প্রভাব ফেলেছে?

হুমায়ূন: একটু খুলে বলো।

মামুন: নিউইয়র্কে আপনার সাম্প্রতিক যে চিত্রকর্মগুলো দেখলাম, সেই ছবিগুলোর প্রায় প্রতিটাতেই আপনি উপস্থিত। একজন নিঃসঙ্গ একাকী বেদনার্ত কেউ। মনে হচ্ছিল আপনার আত্মপ্রতিকৃতি।

হুমায়ূন: আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছি আমি। কিন্তু ছবিগুলো প্রকৃতির সত্য। আমার ছায়া থাকতে পারে।

মামুন: কয়েকটা ক্যানভাস দেখলাম আপনি এঁকেছেন নিজেকে। প্রকৃতির মধ্যে দূরে হ্যাট পরা কে?

হুমায়ূন: হ্যাঁ, ঠিকই বুঝেছ। ওইটা আমি। মানুষ তো আসলে সবকিছুর মধ্যে থেকেও আলাদা এবং একা এবং নিঃসঙ্গ। আমি আগে ছবি আঁকতাম, কিন্তু সাইন করতাম না। সবাই বলতে শুরু করল, এগুলো কার ছবি, কীভাবে বুঝবে। অনেকেই একক প্রদর্শনী করার কথা বলছিল। অনেকটা অনুরোধে এবার মনে হলো আঁকা ছবি দিয়ে করি একটা প্রদর্শনী। এই জুন মাসে এটা হবে নিউইয়র্কে।

আগে অনেক ছবি এঁকেছি, কিছু বন্ধুদের দিয়েছি। আর সব ছবি আমার ‘দখিন হাওয়া’ অ্যাপার্টমেন্টে দরজার সঙ্গে একটা ছোট ঘরে স্তূপ করে ফেলে রেখেছি।

মামুন: অত যত্ন করে আঁকা শিল্পকর্মগুলো ফেলে রেখেছেন কেন?

হুমায়ূন: আমি এমনই! সব নিজের জন্য করেছিলাম। কিছু ছবি আমার ঘরের দেয়ালে বাঁধিয়ে রেখেছি। ছবি এঁকে ওগুলো নিয়ে প্রদর্শনী করতে হবে কেন? আমি কি নিজের খেয়ালে, নিজের জন্য ছবি আঁকতে পারি না?

মামুন: আপনি কেমন ছবি আঁকেন?

হুমায়ূন: আমি যদি সেটা জানতাম! তবে আমি আমার জন্য সবচেয়ে ভালো ছবি আঁকতে পারি। আমার সব ভাইবোন লিখতে পারে, ছবি আঁকতে পারে। আমার মা লিখতে পারেন। আমার ছেলেমেয়েরাও সৃষ্টিশীল।

মামুন: ছেলেমেয়েদের মধ্যে আপনি নিজেকে দেখেন?

ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইরত অবস্থায় জীবনে শেষবার তাঁর প্রিয় নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন আহমেদ, ২৫ মে ২০১২। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম


হুমায়ূন: না, দেখি না। ওরা ওদের মতো করে বিকশিত হবে, এটাই তো আমার প্রত্যাশা। হয়তো ওরা কেউ কেউ আমাকেও ছাড়িয়ে যাবে। নুহাশ প্রস্তুতি নিচ্ছে, সে আমার প্রতিনিধিত্ব করে।

মামুন: আপনি নুহাশ পল্লীকে সৃষ্টি করেছেন, এটা এখন আপনার শিল্পকর্ম!

হুমায়ূন: পিরুজালী গ্রামের এ বাগানটি আমার স্বপ্নের ফসল বলতে পারো। মন খারাপ হলে আমি অনেকবার এখানে চলে এসে আনন্দ বুক ভরে নিয়ে চলে গেছি। এখানকার গাছগাছালি আমার স্বজন, ওরা আসলেই আমাকে চেনে। ভালোবাসে। তাদের আলিঙ্গন আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ঠিকই বলেছ, নুহাশ পল্লী আমার ক্যানভাস, আমার শিল্পকর্ম।

মামুন: আপনি আবার কবে বাংলাদেশে ফিরে আসবেন?

হুমায়ূন: চিকিৎসা চলছে। আমার তো মনে হয় আগামী দু-চার মাসের মধ্যে সুস্থ হয়ে ফিরে আসব। প্রবাসজীবন আমার জন্য সত্যিই কারাগারের মতো। উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাকে দেশের বাইরে অবস্থান করতে হচ্ছে। তবে আনন্দের বিষয় হচ্ছে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাচ্চাদের এবং শাওনের সাহচর্য পাচ্ছি। আমি একা থাকতে পছন্দ করি না, এটা সবাই জানে। আমি যেখানেই যাই, যা-ই করি না কেন, আমার ছেলেমেয়েদের নিবিড়ভাবে ভালোবাসি। ওরাই আমার মধ্যে জীবন সঞ্চারিত করে। অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, থাকবে। তারপরও ওরাই আমাকে ধারণ করে।

মামুন: আপনার পাঠকদের মনে রেখে কোনো বাক্য বলবেন?

হুমায়ূন: আপনাদের জন্য আমি লিখি। আপনারা আমার পাশে না থাকলে আমি হুমায়ূন আহমেদ হতে পারতাম না, এটা আমি বিশ্বাস করি। আমার সঙ্গে সব সময় আপনারা থাকবেন, এটাও বিশ্বাস করি আমি। দ্রুত ফিরে আসব আপনাদের কাছে।

মামুন: হরিণ দেখাবেন বলছিলেন...

হুমায়ূন: বসতে কষ্ট হচ্ছে। একটু হাঁটলে ভালো লাগবে। বিকেলে দেখাব। হরিণগুলো আমাকে দেখলে শসা খেতে চায়। এখন গাছে শসা নেই। মাজহারকে (অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম) বলছি, ছবির বইটা খুব ভালো করে করবে। আবার এসে তোমাকে সময় দেব। আমার শুটিংগুলোতে থেকো। ওখানে অনেকে দেখতে আসে। আমার মায়ের সঙ্গে ছবিটা রেখো। 

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ২৫ মে ২০১২, পিরুজালী গ্রাম, গাজীপুর, ‘নুহাশ পল্লী’।