Thank you for trying Sticky AMP!!

'দেশভাগ না হলে হয়তো আরও ভালো লিখতে পারতাম'

আবুল হোসেন (১৫ আগস্ট ১৯২২—২৯ জুন ২০১৪)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
>আজ কবি আবুল হোসেনের মৃত্যুদিন। চল্লিশের দশকে শীর্ষ বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। ২০১২ সালের ১৬ আগস্ট কবির এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল তাঁর ধানমন্ডির বাসায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শ্যামল চন্দ্র নাথ

শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনার প্রথম লেখা তো কৃষ্ণনগরে থাকা অবস্থায় প্রকাশিত হয়।
আবুল হোসেন: প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পড়া অবস্থায়, আমাদের স্কুল ম্যাগাজিনে। তখন আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি।
শ্যামল: এরপর কলকাতায় চলে এলেন। কলকাতা-জীবন নিয়ে সবিস্তারে যদি বলেন...
আবুল: আমার সৌভাগ্য কলকাতাকে আমি আমার প্রথম জীবনেই পেয়ে গেছি। সেই সময় কলকাতাই ছিল বাংলা সাহিত্যের তীর্থভূমি। মাধ্যমিক শেষ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়তে গেলাম আমি। তারপর হয়ে গেলাম ওই কলেজের রবীন্দ্র সম্পাদক। ওখানে যাওয়ার পর প্রেমে পড়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্বয়ং চোখে দেখা, জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে পরিচয়, দেখা-সাক্ষাৎ—সব মিলিয়ে কিংবা কবিতার রুচিবোধ বদলে যাওয়া, এসব কি আর কলকাতাকে না পেলে হতো! আজীবন শহরে মানুষ হয়েছি আমি। ছোট-বড় যা-ই হোক, সব শহরের চেহারা ও মেজাজÑগ্রাম থেকে ভিন্ন। গ্রামে প্রায় কখনো থাকিইনি। গ্রামীণ জীবনও তেমনভাবে ভেতর থেকে দেখার কখনো সুযোগ হয়নি। সত্যি বলতে কি, গ্রাম আমাকে তেমন আকর্ষণও করেনি। দুটো কি তিনটের বেশি কবিতা হবে না আমার, যার পটভূমি গ্রাম। মনের সংবেদনশীলতাটা যখন সবচেয়ে বেশি, সেই সময়টা আমার কেটেছে কলকাতায়। কলকাতাই ছিল তখন এ উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শহর। এর ভেতরে ডুবেছিলাম আমি। নাগরিকতা বলতে তো শুধু ইট, কাঠ, পাথর, কংক্রিটের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, হোটেল, ট্রাক, বাস, মোটর গাড়ি, ট্রেন, ইলেকট্রিসিটি বোঝায় না। নাগরিকতাটা হলো মনের—গ্রামের মন থেকে যা ভিন্ন, সেটা ধরা পড়ে বক্তব্য,Ñবিষয় ও ভঙ্গি, কথা বলার ধরন আর উপমা ও চিত্রকল্পে।
শ্যামল: আপনার প্রথম দিককার কবিতায় এই ছাপ আছে।
আবুল: আমার প্রথম দিকের যে কবিতাগুলো মানুষজনের চোখে পড়েছিল—‘ডাইনামো’, ‘ট্রেন’, ‘ডি এইচ রেলওয়ে’, ‘ঘোড়সওয়ার’, ‘বাংলার মেয়ে’—এগুলো কি কলকাতায় বা শহরে না থেকে লেখা যেত? অনেক দিন আগে একটা কবিতায় বলেছিলাম, ‘প্রচুর পয়সা কখনো চাইনি, বিত্তের পিছে ছুটতে যাইনি।’ মোট কথা মানবিকতাবোধকেই জীবনের সার বস্তু বলে গ্রহণ করেছি আমি। শহরের বৈচিত্র্য, বৈষম্য, ঐক্য-অনৈক্য, সংগতি, শৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলার মধ্যে বেড়ে না উঠলে কি এ বোধে পৌঁছাতে পারতাম?
সেই ছত্রিশ/সাঁইত্রিশ সাল থেকে আমি আধুনিক কবিতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমি যদিও সুরেলা কবিতা লিখি না, কবি সম্পর্কে আমার নিজের ধারণা দানা বেঁধে ওঠার পর থেকে অন্তত সে রকম আর লিখিনি, তবু আমি ভুলিনি যে সব ভালো কবিতায় ছন্দ, ধ্বনি, অনুপ্রাস অপরিহার্য, কিন্তু বেশি মিষ্টি কবিতা ভাবালুতায় ভরে থাকে। আমরা যখন লিখতে শুরু করি, তখনকার কবিরা তা ভুলে বসেছিলেন। অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে।
শ্যামল: রবীন্দ্রনাথের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন আপনি...
আবুল: সেই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে আমারও অনেক দিন লেগেছিল। তবু খুব ছোটবেলা থেকেই লিখতে শুরু করেছিলাম বলে রবীন্দ্রনাথের বলয় থেকে যখন বেরিয়ে এলাম, তখনো আমার বয়স খুব কম। সেই সাহস পেয়েছিলাম তিরিশের কবিদের কাছ থেকে; তাঁদের সান্নিধ্যে। এ সব তো আমার কলকাতার স্মৃতি, Ñভুলি কেমনে! তাঁদের সেই নতুন কবিতার আন্দোলন, আধুনিক বাংলা কবিতা, তখন সবে দানা বেঁধে উঠেছে। মফস্বল শহর থেকে কলকাতায় এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে ঢুকেছি। সেই কলেজ থেকে সমর সেন বেরিয়ে গেছেন কি বেরোননি। তাঁর লেখা নিয়ে খুব মাতামাতি হচ্ছে তখন। অধ্যাপকেরা পছন্দ করছেন না। সুবোধ সেনগুপ্ত, সোমনাথ মৈত্র, গৌরী ভট্টাচার্যরা রবীন্দ্রনাথেই ডুবে আছেন। ক্বচিৎ নজরুলের নাম করেন।
শ্যামল: আপনি একবার প্রেসিডেন্সি কলেজের ম্যাগাজিনে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন। মনে পড়ে?
আবুল: পড়বে না কেন। আমি কলেজের ম্যাগাজিনে গদ্য কবিতাকে দুয়ো দিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখলাম। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেই সরাসরি আক্রমণ। ‘রবীন্দ্রনাথ ও গদ্য কবিতা’ নাম দিয়ে মাসিক মোহাম্মদীতে দুই সংখ্যায় দীর্ঘ আলোচনা লিখি। সেই পাকামোর কথা ভাবলে আজ হাসি পায়। তবে মোদ্দা কথাটা কিন্তু একেবারে ভুল ছিল না। লেখাটা রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়েছিল। ‘মোহাম্মদীর লেখকে’—এই শব্দবন্ধের উল্লেখ করে গদ্য ছন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন প্রবাসী পত্রিকায়। সে সময় আমি গদ্য কবিতাকে গাল দিচ্ছি বটে, কিন্তু সমর সেন মনের ভেতর ঢুকে তাঁর কাজ করে গেছেন। গদ্য কবিতা তো রবীন্দ্রনাথ কত আগেই লিখেছেন। এর থেকে সমর সেন একেবারেই আনকোরা। তাঁর ভাষা, ছন্দ, বলার ভঙ্গি রবীন্দ্রনাথ থেকে যোজন যোজন দূরে। এ কবির কবিতায় কাব্য ছিল, কাব্যকল্পনা ছিল না। তাঁর গদ্য কবিতা যে কীভাবে সমগ্র বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, সে স্বীকৃতি তাঁর জোটেনি। তবে আমি কারও মতো লিখিনি। নিজের কথা নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করেছি। আমার কাছে আমার কলকাতা পর্বকেই নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বলে মনে হয়। কারণ, দেশভাগ না হলে আমি হয়তো আরও ভালো লিখতে পারতাম—এই আক্ষেপ কি মুছে ফেলা যাবে? 

শ্যামল: আপনার পরিবারে কি লেখালেখির আবহ ছিল?
আবুল: না। তবে আমার বাবার গানের শখ ছিল। কিন্তু সেই সময়ে গান গাওয়া ছিল না-জায়েজ কর্ম। ১৯৭১ সালে ২৪ এপ্রিল বাগেরহাটে পাকিস্তানিরা সৈন্যরা আমার বাবাকে মেরে ফেলে। আমি তখন সরকারি চাকরি করতাম। বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন। আর আমার ছোট ভাই আমজাদ হোসেন একসময় পাকিস্তানের মন্ত্রী ছিলেন। যত দূর মনে পড়ে, বাবাকে নিয়ে আমি একটা কবিতাও লিখেছিলাম।
শ্যামল: আপনার জীবনে সবচেয়ে কষ্টকর ঘটনা কোনটি?
আবুল: আমার মা ও স্ত্রীর চলে যাওয়া। আমাকে একা করে স্ত্রী চলে গেল ১৯৯৪ সালে। চলে যাওয়ার আগে সে অনেক কথা লিখে গিয়েছিল আমার ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে, যা তারা খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছে। আমি অনেক ভালোই আছি বলা যায়। এ ছাড়া বাবার কথা বেশ মনে পড়ে। এর বাইরে এমন কোনো কষ্ট আমি পাইনি।
শ্যামল: কবি হিসেবে আপনার গড়ে ওঠার পেছনে কাদের বেশি ভূমিকা ছিল, আপনার সাহিত্যিক ঋণ কাদের কাছে?
আবুল: ঋণের কোনো শেষ নেই। বাংলা ও ইংরেজি কবিতার একটা বড় অংশের কাছে আমি ঋণী। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক প্রফুলচন্দ্র, ড. সুবোধ সেনগুপ্ত, তারকানাথ সেন, ড. রাধাগোবিন্দ বসাকসহ আরও অনেকেই রয়েছেন। সবার নাম এখন মনে পড়ছে না। এ ছাড়া সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা আলাদাভাবে বলতে হবে। তাঁর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন সাহিত্যালোচনায় সময় পার করেছি। তবে আমি সবচেয়ে ঋণী আবু সয়ীদ আইয়ুবের কাছে। তাঁর কাছ থেকে পেয়েছিলাম রুচি।
শ্যামল: আপনার বিবেচনায় চল্লিশ দশকে আপনার সমকালীন কবিদের মধ্যে কে বা কারা গুরুত্বপূর্ণ?
আবুল: সুকান্ত ভট্টাচার্য ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তাঁরা অনেক ভালো লিখেছেন।
শ্যামল: সমসাময়িক কবি হিসেবে কাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন?
আবুল: সমর সেনকে। ওঁর চেষ্টা ছিল কবিতাকে কতটা নিরাভরণ করা যায়। ওঁকে খুব উঁচু দরের কবি বলে মনে করি আমি। সমর সেন যখনই বুঝতে পারলেন, তাঁর বলার আর কিছু নেই, তখনই থামিয়ে দিলেন কবিতা লেখা। এটা কিন্তু সবাই পারে না।
শ্যামল: দেশ, আনন্দবাজার, যুগান্তর, অরণি, পূর্বাশা, নবযুগ বুলবুল—এ রকম নানা বিখ্যাত পত্রিকায় লিখেছেন আপনি। সাহিত্য মানের বিচারে কোন পত্রিকাকে এগিয়ে রাখবেন?
আবুল: হ্যাঁ, অনেক পত্রিকা ও সাময়িকীপত্রে আমি লিখেছি। তবে আমার কাছে দেশকেই সেরা মনে হয়েছে। এর সাহিত্য মান অনেক উঁচু। আক্ষেপের কথা হলো, এখন তো আর পড়া হয় না।
শ্যামল: কবিতায় বিশেষভাবে কথ্যরীতির ব্যবহার করেছেন আপনি। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, যে সময় আপনি এ রকমভাবে ব্যবহার করেছেন, তখন কিন্তু কাব্যিকতার জোয়ার। কবিতায় কথ্যরীতি ব্যবহারের নেপথ্য কারণটি বলবেন?
আবুল: কাব্যিকতাকে আমি ঘৃণা করি। কারণ, বাংলায় একটা কাব্যিক ভাষা গড়ে উঠেছিল, যা সাধারণ মানুষের ভাষা থেকে অনেকখানি ভিন্ন। কবিতায় আমি এই কৃত্রিমতা বর্জন করতে চেয়েছি। কবিকে আমি বিশেষ জীব বলে কখনো ভাবিনি। কবিও সমাজের অন্যান্য লোকের একজন। আমি নিজের পথটা খুঁজতে চেয়েছিলাম। কাব্যের একটা প্রচলিত ভাষা আছে, যে ভাষায় বা রীতিতে লিখলে সহজেই কবিখ্যাতি পাওয়া যায়, কিন্তু সেই সোজা সড়কে চলতে ইচ্ছে হয়নি আমার। অনেক পাঠক ভাবেন, আমি কেবল গদ্য কবিতা লিখি, মজার বিষয় হলো, আমার গদ্য কবিতা খুব কম। কথ্যরীতি ব্যবহার করে বাংলা কবিতা ক্রমেই সাধারণ লোকের কাছাকাছি আসতে পারবে। তাই আমি কথ্যরীতির প্রতি মনোযোগ দিয়েছি।
শ্যামল: নিজের লেখা কোন কবিতা আপনার খুব প্রিয়?
আবুল: নির্দিষ্ট একটি প্রিয় কবিতা আমার নেই, নিজের লেখা অনেক কবিতাই আমার অনেক প্রিয়। আমার কবিতার মধ্যে প্রায় সবারই ভালো লেগেছে ‘ডি এইচ রেলওয়ে’। যেটা আবদুল মান্নান সৈয়দ এই বঙ্গে প্রথম আলোচনা করেছে। আদতে আমি তো কবিতা নিয়ে অবিরাম কাজ করি, লিখে যাওয়ার পরে সেগুলো নিয়ে কাটা-ছেঁড়া করি, এমনকি পত্রিকায় ছাপা হয়ে যাওয়ার পরেও কাজ করি এবং বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়ার পরেও কাজ করি। সে জন্য নিজের অনেক কবিতাকে আমি মনে করি এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে তার থেকে একটি শব্দও বদল করা যাবে না।
শ্যামল: দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন। তবে কবিতা এত কম লিখেছেন কেন?
আবুল: আগে অনেক লিখতাম। কম লেখার পেছনে কাজ করেছে আবু সয়ীদ আইয়ুবের সতর্কতা। আইয়ুব বলতেন, এত লেখেন কেন? বেশি লিখলে কি লেখা ভালো হয়? আমাকে তিনি বলেছিলেন, কোনো লেখা কখনো পুনরায় বলবেন না। একবার যা লিখেছেন তা আর লিখবেন না। এই বলে জীবনানন্দ দাশের উদাহরণ দিলেন। যা হোক, এখন তো আর লিখতেও পারছি না। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে।
শ্যামল: বুকের ভেতরে যে ধারণা লালন করে একদা কবিতা লিখতে শুরু করেছেন, জীবনের এই শেষ পর্যায়ে এসে দৃষ্টিভঙ্গিতে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে?
আবুল: ছেলেবেলায় যখন লিখতে শুরু করি, কবিতার ভাষা, ছন্দ, মিল, বিষয়—এসব নিয়ে তেমন চিন্তাভাবনা ছিল না। লিখতে ভালো লাগত—এই-ই যথেষ্ট। অনেক বিষয়েই লিখেছি তখন। পরে অনেক ভেবেচিন্তে কবিতাকেই বেছে নিলাম। আমি মানুষের মুখের ভাষার প্রেমে পড়ি। এতে অপ্রত্যাশিত লাভ হলো—কবিতা সহজ-সরল হয়ে গেল।