Thank you for trying Sticky AMP!!

'নারীর চিত্ত জয়ের বাসনা কবির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ'

নেত্রকোনার কাশবনে নির্মলেন্দু গুণ। ছবি: খালেদ সরকার
>

বাংলাদেশের পাঠকনন্দিত কবি তিনি, তাঁর অগুনতি কবিতা মানুষের মুখে মুখে। গতকাল ছিল জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণের জন্মদিন। জন্মদিনের দুই মাস আগে গেল ২০ এপ্রিল কবির সঙ্গে তাঁর জন্মশহর নেত্রকোনা যাওয়ার পথে প্রথম আলোকে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন তিনি। ছাপা হলো সেই কথোপকথনের নির্বাচিত অংশ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ 

আলতাফ শাহনেওয়াজ: অনেকেই যা পারে না, আপনি সেটি করে দেখিয়েছেন। কবিতার জন্য নিজের ইচ্ছাধীন এক জীবন কাটাচ্ছেন। কবিতা বা শিল্প কার জন্য—মানুষের জন্য শিল্প নাকি শিল্পের জন্য শিল্প, শিল্প আগে না জীবন আগে?

নির্মলেন্দু গুণ: শিল্পের জন্য মানুষের জীবন বিসর্জন দেওয়া লোভের প্রকাশ। এটি অমরত্বের লোভ। এই লোভ মানুষের থাকতেই পারে। তবে সেটিকে মানবিক গণ্ডি অতিক্রম করতে দেওয়া উচিত নয়। তাজমহল নির্মাণের করুণ ইতিহাস তো আমরা জানিই। শ্রমিকদের হাত কেটে নেওয়ার যে মধ্যযুগীয় বর্বরতা, সেটি শিল্পের সঙ্গে মিশে একাকার হয়েছে। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্স গির্জার ইতিহাসও একই। জার সব শ্রমিকের হাত কেটে নেন। রাজা-বাদশাহদের আচরণ একই। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এত সুন্দর শিল্পের সঙ্গে এসব মানুষেরাই জড়িত থাকে। শাহজাহান মমতাজের জন্য তাজমহল বানিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ব্যক্তিজীবনে তিনি কী করেছেন? হারেমে ৪০০ দাসী নিয়ে পড়ে থেকেছেন। অন্যকে অত্যাচার করে শিল্প, তাতে আমার বিশ্বাস নেই।

আলতাফ: কবি হবেন—এমন ভাবনা কি জীবনের প্রথম থেকেই ছিল?

গুণ: বিষয়টি এমন নয়। কবি যে হওয়া যায়, এই বিশ্বাসই আমার ছিল না। বড় কবিদের পাশে যে আমার নাম বসবে বা বসতে পারে, এমনটি ভাবিনি। প্রথম দিকে গ্রাম্য কবিদের কবিতা সংগ্রহ করতাম। মাঝেমধ্যে নিজেও লিখতাম। সেগুলো ভাইবোনকে শোনাতাম। তারা বেশ প্রশংসা করত।

আমার সম্পর্কে পাড়া-প্রতিবেশীদের ধারণা ছিল খুব খারাপ। খুব ভালো মানের চোর ছিলাম আমি—টাকা, ফল—এগুলো চুরি করতাম। কাজের মধ্যে কেবল ডাকাতিই বাকি ছিল। কিন্তু একসময় ডাকাতির মামলায়ও আমি ফেঁসেছিলাম। মামলাটি মিথ্যা ছিল অবশ্য। আমাদের পার্শ্ববর্তী এক গ্রামে ডাকাতির ঘটনায় এক ডাকাত ধরা পড়েছিল। সেই ডাকাত বর্ণনা দিয়েছিল একজন বেঁটে আর লম্বা লোক তাকে ভাড়া করেছিল। আমি তো লম্বা ছিলাম তাই দারোগা সাহেব—আমরা তাঁকে চৌধুরী দারোগা নামে ডাকতাম—ভাবলেন আমিই সেই লম্বা লোক। এরপর আমার নামে মামলা দিয়ে দিলেন তিনি।

চৌধুরী দারোগার সঙ্গে একসময় আমার সম্পর্ক ভালো ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কাজ করায় আমাদের মধ্যে বিভেদ ঘটে। এরপর তিনি প্রায়ই আমাদের বাড়িতে হানা দিতেন। তত দিনে আমার বড় ভাই ভারতে চলে গিয়েছিলেন। তো, বাবা-মা চাইছিলেন দাদার মতো আমিও যেন ভারতে চলে যাই। তখন পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের জন্য এটিই ছিল সবচেয়ে ভালো সমাধান। এরপর আমার জীবনটি একটি চক্রের মধ্যে নিপতিত হলো। ঘুরলাম এ ঘাট থেকে ও ঘাট।

কবিতার একটি শক্তি আছে, তা আমি কম বয়সেই বুঝেছিলাম। তবে কবি আমি হতে চাইনি, বারংবার চেষ্টা করেছি কবি না হওয়ার। আমি ভালো ছাত্র থাকার চেষ্টা করেছি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে লেটারসহ প্রথম বিভাগে পাস করেছি। তারপর সুযোগ পেয়েও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারিনি। আমার কবি হয়ে ওঠার পেছনে বোধ হয় এই ঘটনাগুলোর অবদান আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে ভর্তি হলাম ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। এতে আমার মন ভেঙে যায়। নিজেকে খুব ছোট, খুব অপমানিত মনে হতো। তখন সিদ্ধি, মদ্য, পদ্য, গণিকা, জুয়া—এগুলোর কাছে নিজেকে সমর্পণ করলাম। ভাবলাম, আনন্দের সাগরে ভেসে আনন্দমোহন নামটি আমি সার্থক করব। আগে থেকেই টুকটাক কবিতা লিখতাম। তবে ওই সময়ই সিরিয়াসলি ভেবেছি যে জীবনে কিছু যদি হতে হয়, আমি কবিই হব।

আলতাফ: প্রথম কবিতা ছাপা হওয়ার কথা মনে পড়ে?

গুণ: আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় খালেকদাদ চৌধুরী সম্পাদিত উত্তর আকাশ পত্রিকায়। এটি প্রকাশিত হতো নেত্রকোনা থেকে। তবে এই কবিতা প্রকাশের আগে আরও অনেক জায়গায় কবিতা পাঠিয়েছি আমি। এর মধ্যে মাসিক রংধনু পত্রিকায় প্রকাশের জন্য কবিতা পাঠিয়েছিলাম। তারপর ঘটল সেই লজ্জার ঘটনা। ঘটনাটির কথা এখন মনে হলে বেশ হাসি পায় আমার।

আলতাফ: কোন ঘটনা? আর কেনইবা সেটি লজ্জার?

গুণ: কলকাতা থেকে আমাদের বাড়িতে বসুমতী, দেশ—এসব পত্রিকা আসত। পত্রপত্রিকা থাকত বাড়ির লাইব্রেরিতে। একদিন সেই লাইব্রেরি ঘেঁটে মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটি কবিতা কপি করে এবং কবিতার ওপরে নিজের নাম বসিয়ে পাঠিয়ে দিলাম রংধনুতে। ভেবেছিলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত—এ আর এমন কোন কবি, কেউই চিনবে না তাঁকে। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমি কি আর জানতাম তাঁর ‘বঙ্গভাষা’ কবিতাটি এত বিখ্যাত। এই কবিতাই কপি করে পাঠিয়েছিলাম। পরে রংধনু পত্রিকার সম্পাদক আমাকে চিঠি লিখলেন। গ্রামের এক ছেলেকে সম্পাদক চিঠি লিখেছেন, এটি বিরাট ঘটনা। চিঠি পেয়ে আমার আনন্দ তো ধরে না। কিন্তু পড়ার পর মনটা দমে গেল। চিঠিতে তিনি লিখলেন, ‘প্রিয় নির্মলেন্দু, এটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের “বঙ্গভাষা” কবিতা। পরেরবার লিখলে নিজে কবিতা লিখে পাঠাবে।’ সম্পাদকের চিঠি অনেক বড় পাওয়া। কিন্তু এটি আমি উদ্‌যাপন করতে পারছি না। কাউকে দেখাতেও পারছি না। দমবন্ধ অবস্থা। সেই চিঠি অনেক দিন জমিয়ে রেখে পরে ছিঁড়ে ফেলি। এই ঘটনার বহু বছর পর ওই সম্পাদকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। আমি তখন তাঁর কাছে পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইলাম। তিনি বললেন, ‘আরে, তুমি নিজেই তো এখন কবি হয়ে গেছ।’

আলতাফ: এখন আপনি আগের মতো আর কবিতা লিখছেন না। কেন?

গুণ: কবিতা লেখার প্রতি সেভাবে কোনো তাগিদ বোধ করছি না। অন্য অনেক কিছু করার আছে। আপাতত কাব্য রচনা থেকে ছুটি নিতে চাই।

আলতাফ: কবিতা থেকে কি ছুটি নেওয়া যায়?

গুণ: যায় তো—যায়! গত চার বছরে আমার মাত্র একটি বই বের হয়েছে। ‘শামসুর রাহমানের জন্য এলিজি’ নামে আমার একটি কবিতা আছে। অনেক বছর আগে শামসুর রাহমান তখন বেশ অসুস্থ, সে সময় আমি লিখেছিলাম কবিতাটি। ওই সময় তাঁর কোনো এক জন্মদিনে এটি পড়েওছিলাম। তো, ওই কবিতা লেখার পর রাহমান ভাইকে বলেছিলাম, রাহমান ভাই, আপনি বেঁচে থাকতেই আমি আপনাকে নিয়ে একটি এলিজি লিখেছি। কিন্তু আপনি ভয় পাবেন না। আপনি যদি কবিতাটি হজম করতে পারেন, তাহলে আরও ২০ বছর বাঁচবেন। ঘটনাচক্রে এই কবিতা লেখার ২০ বছর পরেই শামসুর রাহমান মারা গেলেন। ওই কবিতাটি ছিল এমন: ‘কবিতা আমাকে জাগিয়ে রাখে,/ ঘুমুতে দেয় না। আমাকে সে কষ্ট দেয়/ আমার মেয়ের চোখের জলের মতো।/ আমি তাকে লিখতে চাই না, কিন্তু/ সে আমাকে লেখায়। আমি চাই না/ জন্ম দিতে, আমি জানি জন্মই মৃত্যু।/ কিন্তু সে জন্মাতে চায় আমার মধ্যে...’। এই কবিতার সুরেই বলি, কবিতাকে এখন আমি আর জন্ম দিতে চাই না। কবিতা লিখতে চাওয়া আর না চাওয়ার মধ্যে একটি পার্থক্য আছে। কবির চিন্তা-প্রক্রিয়ার ভেতরে কবিতা তো থাকেই। অনেক ক্ষেত্রে এটি অভ্যস্ততার ব্যাপারও হয়ে ওঠে। তবে কবিতাকে লিখিত আকার দেওয়ার জন্য কবির ইচ্ছাও থাকতে হয়। আগে আমার মধ্যে আরও বড় কবি হওয়ার, পাঠককে মুগ্ধ করার একটা তাগিদ ছিল। এটা থেকে আমি মুক্তি পেয়েছি।

মুক্তিটা পেয়েছি যখন থেকে বারহাট্টায় নিজের গ্রামে আমি কাশবন তৈরি শুরু করি, তখন থেকে। এটা তো কবিতার পক্ষেরই কাজ। সামাজিক কাজ। কাশবনে আমি স্কুল করেছি। শৈলজা সংগীত বিদ্যালয় নামে সংগীত শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান করেছি। পাঠাগার গড়ে তুলেছি। তা ছাড়া নেত্রকোনা শহরের পার্শ্ববর্তী মালিনী নামের স্থানে গড়ে তুলেছি আরেকটি প্রতিষ্ঠান—কবিতাকুঞ্জ। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিদের বই থাকবে এখানে। কাব্যামোদীরা কবিতা নিয়ে গবেষণা করবেন। বর্তমানে এখানে বিভিন্ন ভাষার ১ হাজার ৫০০ কবির কবিতার বই সংগ্রহ করা হয়েছে। শুধু কবিতাকে ঘিরে আমরা এক অনন্য আয়োজন করতে চাই এখানে। আমি এখন এসব কাজে ব্যস্ত। কবিতা লেখার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি এই কাজগুলো।

আলতাফ: আপনি কি তবে আপনার শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো লিখে ফেলেছেন?

গুণ: এই কথাও লেখা আছে আমার কবিতায়। আমার কবিতার একটি পঙ্‌ক্তি এমন: ‘আমার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো আমি লিখে ফেলেছি।’ এখন মাঝেমধ্যে আমার এমনও মনে হয় যে যা লিখেছি, এর চেয়ে বেশি লিখলে অপচয় হবে। রবীন্দ্রনাথ এত বেশি লিখেছিলেন, তার পক্ষে একটি যুক্তি ছিল যে তাঁর আগে বাংলা সাহিত্যের অবস্থা অতটা সমৃদ্ধ ছিল না। রবীন্দ্র-পরবর্তী সময়ে যদি কেউ মনে করে, রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে যেতে হলে আমাকে ২৬ খণ্ড লিখতে হবে, তাহলে সেটি খুবই ভুল হবে বলে আমার ধারণা। কবিতার সম্পদ আহরণের চেয়ে এটি বিলিয়ে দেওয়াই এখন বড় বিষয় বলে মনে হয় আমার কাছে।

আলতাফ: এই যে কাশবন ও কবিতাকুঞ্জ—এই প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলেছেন, এসবের পেছনে অবচেতনে একধরনের অমরত্বের বাসনা কি কাজ করে?

গুণ: তা তো অবশ্যই করে। কবিতাও তো অমরত্বের বাসনা থেকেই লেখা। নশ্বর জীবনকে একটা অবিনশ্বর রূপ দেওয়ার প্রয়াস সব সময়েই থাকে। জীবনের মূল তাড়না এটাই। মানুষ সামাজিক কর্ম, জনহীতে যত কাজ করে, সবই তার গ্রহণযোগ্যতাকে বৃদ্ধির মানসেই করে।

আলতাফ: আপনার যে কবিতাগুলো মানুষের মুখে মুখে ফেরে—যেমন ‘হুলিয়া’ বা ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’—এসব কবিতায় একটি গল্প আছে। আবার বাংলা কবিতার আদির দিকে চোখ ফেরালেও দেখতে পাই গল্প। চর্যাপদ-এর ভেতরে যেমন টুকরো টুকরো গল্প আছে, গল্প রয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর মধ্যেও। গল্পতেই কি তবে বাংলা কাব্যের প্রাণভোমরা নিহিত?

গুণ: ভালো একটা বিষয় ধরেছ। এটি আমি এভাবে ভাবিনি। হ্যাঁ, যে কবিতার ভেতরে গল্প থাকে, সেটি সহজেই সবাই মনে রাখতে পারে। আমি মনে করি, প্রতিটি জিনিসের ভেতরে আদিতে গল্পই ছিল। তবে গল্পকে স্মরণীয় করে রাখতে একটা মাধ্যম আবিষ্কার করেছিল মানুষ—অন্ত্যমিল যুক্ত পদ্য। আমার ‘হুলিয়া’ কবিতাটি লেখার পর হাসান (আবুল হাসান) ওটা ছিঁড়ে ফেলেছিল। কারণ, সে যে নন্দনতত্ত্বের অনুসারী, এটি তেমন ছিল না। পাশাপাশি বোধ হয় খানিকটা ঈর্ষাও কাজ করেছিল। কিন্তু ও যে আমার কবিতাটি ছিঁড়ে ফেলল, এতে কিন্তু আমি একটুও খেপিনি। কারণ জানতাম যে আমি ওটা আবার লিখতে পারব। পুরো কবিতাটি গল্পের মতো করে বলা ছিল তো। পরে আমার মনে হয়েছে, ‘হুলিয়া’র প্রথমটির চেয়ে দ্বিতীয় লেখা—এখন যেটি সবাই পড়ে—সেটিই বেশি ভালো হয়েছে।

আলতাফ: আপনাদের প্রজন্মের আবির্ভাব গত শতকের ষাটের দশকে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এই আন্দোলনের আঁচ বেশ ভালোভাবেই লেগেছিল আপনাদের কবিতায়। আপনার প্রজন্মের কবিদের কবিতার মূল্যায়ন করতে বলা হলে কী বলবেন?

গুণ: এক উত্তাল সময়ে কবিতা লিখতে এসেছিলাম আমরা। এখনকার বাস্তবতার সঙ্গে তখনকার দেশীয় প্রেক্ষাপট যেমন মিলবে না, একইভাবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটও মিলবে না। তবে এটুকু বলতে পারি, সময় আমাদের দিয়ে অনেক কিছু লিখিয়ে নিয়েছিল। আর মূল্যায়নের যে পদ্ধতিগত দিক—মানে যে প্রক্রিয়ায় মূল্যায়ন করা হয়, তাতে আমার আস্থা নেই। তাই কে কত বড় কবি, কে কত ছোট—এটি আমি বিবেচনা করতে পারি না। পরবর্তী যুগের লেখক, পরের যুগের পাঠক এসে আমাদের মূল্যায়ন করবেন। আমরা যেমন এখন মধ্যযুগের কবিতা মূল্যায়ন করি।

আলতাফ: অজস্র প্রেম এসেছে আপনার জীবনে। প্রেম নিয়ে আপনার ভাবনা কেমন?

গুণ: প্রেম নিয়ে আমি বেশি কথা বলতে চাই না। প্রেমে প্রথম আর শেষ বলে তো কিছু নেই। এ এক অন্তহীন প্রক্রিয়া। পরস্পরের প্রতি আকর্ষণই সৃষ্টির মূল রহস্য। নারী ও পুরুষের প্রতি আকর্ষণ না থাকলে তো সৃষ্টির কোনো জায়গা থাকে না। আর মানুষের মধ্যে মিলনের যে আকাঙ্ক্ষা, তা হলো সৃষ্টিকে সম্ভব করে তোলার জন্য তাদের ভেতরকার তৃষ্ণা। সবকিছুর মূলে রয়েছে কাম। আমাদের প্রাচ্যে কামশাস্ত্র নামে একটা শাস্ত্রই তৈরি হয়েছে। সেখানে ৬৪ কলা, নারীর গোত্রবিভাগ প্রভৃতি আছে। আদতে প্রেমের ব্যাপারটা হচ্ছে সেই কামকে সুন্দরভাবে পরিবেশন করা। নারীর চিত্ত জয়ের বাসনা কবির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ, আমার দিক দিয়ে সেটা এখনো চলমান। এটা সুন্দরের কাছে কবির আত্মসমর্পণেরই একটি পর্যায় বলে আমি মনে করি।

আলতাফ: সেই বাসনায় আপনি সফল নিশ্চয়ই?

গুণ: এক অর্থে বলা যায়, যেহেতু কবিতার মধ্যকার ভালোবাসার আকুতি নারীদের স্পর্শ করেছে।

আলতাফ: এবার আরও একটু ব্যক্তিগত বিষয়-আশয় জিজ্ঞেস করি। নীরা লাহিড়ী নামের এক চিকিৎসককে বিয়ে করেছিলেন আপনি, কিছুকাল পরে সেই বিয়ে ভেঙেও গিয়েছিল। পাঠকদের অনেকেই আপনার জীবনের এই পর্বটি সম্বন্ধে জানতে চান।

গুণ: এসব নিয়েও খুব বেশি বলতে আমি আগ্রহী নই। নীরার সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হয়, তখন তিনি সবে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। আমার কবিতার ভক্ত ছিলেন। ভেতরে-ভেতরে আমি এমন একজনকে খুঁজছিলাম, যিনি আমার কবিতাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসবেন। যখনকার কথা বলছি, সে সময় শামসুর রাহমানের কবিতার কথাই সবাই বলে। তো আমি ভাবলাম, এমন একজনকে আমার দরকার, যিনি বলবেন আমার কবিতা শামসুর রাহমানের চেয়ে ভালো। হ্যাঁ, এই কথা শোনার জন্য আমার মধ্যে যে আগ্রহ ছিল, সেটা নীরার মাধ্যমে পূর্ণ হয়েছিল। তারপর ১৯৭৭ সালে আমাদের বিয়ে হয়। পরে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা করেন।

আলতাফ: কত দিন স্থায়ী হয়েছিল আপনাদের দাম্পত্য জীবন?

গুণ: আমাদের দাম্পত্য জীবন খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বিষয়টি যদিও আপেক্ষিক। অনেকেরই এর চেয়েও কম স্থায়ী হয়েছিল। যেমন ধরা যাক পাবলো নেরুদা, তিনি জীবনে তিনটি বিয়ে করেছিলেন।

আলতাফ: আপনাদের বিচ্ছেদ হলো কেন?

গুণ: আমাদের মধ্যে কিছু ভুল-বোঝাবুঝি ছিল।

পরাধীন চিত্ত নিয়ে বড় হওয়ার চেয়ে স্বাধীন চিত্ত নিয়ে ছোট থাকাটাকেই বেশি পছন্দ করি আমি। আমার একপ্রকারের স্বাধীন মনোবাসনা ছিল, এখনো আছে। আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। স্বাধীনতা আমার পরম আকাঙ্ক্ষিত ছিল। এমনকি প্রথম কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে আমি লিখেছিলাম, ‘আমার বাবার মতো সবাই যদি আমাকে স্বাধীনতা দিত।’ আদতে আমি স্বাধীনতাকামী। স্বাধীনতা আমার আরাধ্য। বিয়ের পর কিছু বিষয়ে আমাদের মধ্যে মতভেদ তৈরি হলো। একসময় নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই আমরা আলাদা হলাম।

আলতাফ: একজন কবির জন্য তো স্থিতিও দরকার? আপনি স্থিত হলেন না কোথাও...

গুণ: প্রাত্যহিকতার মধ্যেও কিন্তু একটা স্থিতি আছে। আজ যেমন আমি আমার নিজের বিছানায় ঘুমাতে পারব না। এটা আমার মধ্যে একটা অস্বস্তির ভাব তৈরি করে। আমি অনেক ফাইভ স্টার হোটেলে থেকেছি। তবে সেখানে আমার স্বস্তি কম। আমার নিজের কাঁথা, নিজের বিছানা, নিজের ফ্যানের মধ্যে স্বস্তি বেশি। জায়গাটা আমার নিজের। আমার স্থিতি আমার মতো। বাইরে থেকে তা বোঝা যায় না।

আলতাফ: অনেকটা পথ পেরিয়ে এলেন। এখন কি মৃত্যুচিন্তা আসে?

গুণ: মৃত্যু নিয়ে আমার দর্শন হচ্ছে, আমি জন্মের প্রয়োজনে বড় হয়েছিলাম, আবার মৃত্যুর প্রয়োজনে ছোট হচ্ছি। মৃত্যু আসবেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, মৃত্যু যদি দস্যুর মতো এসে প্রাণ কেড়ে নেয়, তাতে মন সায় দেয় না। মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুত, তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে আমার আপত্তি নেই। তবে মৃত্যু যেন মৃত্যুর বেশেই আসে, বন্ধুর মতো আসে। 

নির্মলেন্দু গুণেকবিতা

বিদ্যুৎচরণেষু

তোমার পদশ্রীর ত্বকের লাবণ্য থেকে

বিচ্ছুরিত আলোর উল্লাসে

যখন ঝলসে যেতে বসেছিল

আমার দুই চোখের কর্নিয়া,

তখন বিদ্যুৎ-সন্ধানে

তোমার নমনীয় হাঁটুর ভাঁজে

এবং বজ্রচেরা জঙ্ঘার আকাশে

আমি স্থাপন করেছিলাম

আমার চুম্বনের প্রিয় টারবাইনগুলি।

বাংলাদেশের ভাগ্য খুব ভালো।

আমার চুম্বনে আমার প্রিয়ার

যুগল পায়ের লাল পদ্মগুলি

ফুটেছে সহাস্যে, সহস্র দল মেলে।

সৌরবিদ্যুতের মতো জ্বলে উঠেছে

আমাদের এলইডি বাল্বগুলি।

তোমাকে চুম্বন করার মধ্য দিয়ে আহরিত

১০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এখন

আমাদের ন্যাশনাল গ্রিডে যুক্ত হয়েছে।

আমি যদি ভুল না বুঝে থাকি—

মহামতি কার্ল মার্ক্স প্রেম থেকে

এ রকম কিছু সামাজিক কল্যাণই

প্রত্যাশা করছিলেন।

তোমার শ্রীরাধাচরণ এখন আমাদের

বিদ্যুতের প্রধান উৎস।

কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র

এখন আমাদের না হলেও চলে। 

 ১৮ জুন ২০১৮, নয়াগাঁও