Thank you for trying Sticky AMP!!

উপনিবেশ মারা গেছে, নাকি ভূত হয়ে বেঁচে আছে

বেঙ্গল শিল্পালয়ের গ্যালারিতে ঢালী আল মামুনের ‘অসম্মতির মানচিত্র’ প্রদর্শনী দেখছেন দর্শকেরা

বেঙ্গল শিল্পালয়ের গ্যালারিতে ঢালী আল মামুনের ‘অসম্মতির মানচিত্র’ প্রদর্শনীটিতে ঢুকলে মনে হতে পারে, আপনি একটি ক্ষুদ্র, প্রাণবন্ত জাদুঘরে ঢুকেছেন। শিল্প উপভোগের রসযোগের পাশাপাশি এখানে জ্ঞানযোগ রয়েছে কিঞ্চিৎ বা বিস্তর। ছবি, চলচ্ছবি, মূর্তি, মানচিত্র, সচল ভাস্কর্য ইত্যাদি মিলিয়ে এক জমজমাট ভানুমতীর খেল এখানে জমিয়ে তুলেছেন শিল্পী। এই জাদুঘরসুলভ শিল্প প্রদর্শনীটির মূল ভাব বস্তু হলো উপনিবেশ। 

ঢালী আল মামুন বহুদিন ধরেই উপনিবেশ নিয়ে কাজ করে চলেছেন। কিন্তু এখনো কেন উপনিবেশ? ব্রিটিশ উপনিবেশ তো আমরা ৭৬ বছর পেছনে ফেলে এসেছি। যাঁরা একদা ইংরেজের প্রজা ছিলেন, সেই সব দাদা-দাদি নানা-নানি ক্রমে গত হচ্ছেন। আর বাংলাদেশে উপনিবেশ জমানা নিয়ে স্মৃতির চর্চাও তত জোরালো নয়, যতটা পাকিস্তানি আমলের ২৩ বছর নিয়ে। 

উপনিবেশ আসলেই মারা গেছে, নাকি ভূত হয়ে বেঁচে আছে, প্রশ্নটির জবাব অত সরল নয়। বাংলায় উপনিবেশের পত্তন যিনি করেন, সেই রবার্ট ক্লাইভের পোষা কচ্ছপ, যার নাম আদিত্য—মারা গেছে এই সেদিন, ২০০৬ সালে কলকাতার আলীপুরে। খোদ ক্লাইভের মূর্তি দিব্যি শোভা পাচ্ছে বিলেতের ডাউনিং স্ট্রিটের কাছেই, ব্রিটিশ ফরেন অফিসের সামনে। আর সর্বোপরি, উপনিবেশি শিল্পবিপ্লবের জের ধরে আখেরি পুঁজিবাদের জমানায় জলবায়ু পরিবর্তন যখন দুনিয়াজুড়ে প্রাণের আবাস ধ্বংস করে ফেলছে, তখন উপনিবেশের ভূত যে বেঁচে নেই, তা কে বলতে পারেন।  

প্রবাদ আছে, ‘এক গাঁয়ের কুকুর, আরেক গাঁয়ের ঠাকুর’। উপনিবেশি রাজা যাঁর মূর্তি রেখেছেন ঠাকুর হিসেবে, আমাদের শিল্পী তাঁরই এক মূর্তি বানিয়েছেন কুকুররূপে। 

চলমান প্রদর্শনীতে ঢুকলেই দেখবেন, একটি রেললাইনের ওপর মূত্রত্যাগ করছে একদল কুকুর। আর এই কুকুরগুলোর শরীরে রবার্ট ক্লাইভের মুখ বসিয়েছেন শিল্পী। নাম লেখেননি অবশ্য, ক্লাইভের মুখ দেখলেই বোঝা যায়। 

উপনিবেশের রাজপুরুষের ‘কুকুরদশা’ দেখে অনেক দর্শকই শিউরে উঠেছেন। মানুষকে কুকুর বা পশুরূপে পর্যবসানের ভাষা নিয়ে তাঁরা বিপন্ন বোধ করছেন। মানুষকে কুকুর-শাবক বলে গালি দেওয়া আমাদের পথে-প্রান্তরের ভাষায় বহুল চর্চিত বটে। তবে বৃহদার্থে, মানুষের পশুকরণ মূলত যুদ্ধের ভাষা। এ প্রসঙ্গে মনে পড়বে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর ইউরোপীয় ক্লাবের নোটিশটি, ‘কুকুর ও নেটিভদের প্রবেশ নিষেধ’। 

মানুষের ঠাকুরকরণ মূলত তাকে সমাজের ঊর্ধ্বে স্থাপন করা, আর কুকুরকরণ তাকে সমাজের অধোভাগে, পায়ের তলায় স্থাপন করা। সুতরাং সার্বভৌম ক্ষমতা, তথা ঠাকুরত্বের সঙ্গে কুকুরত্বের মেরু বৈপরীত্যমূলক আত্মীয়তা গভীর। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ‘নর হলো রাজনৈতিক প্রাণী।’ এই রাজনীতি মানুষের কাজ হলেও তা প্রায়ই মানুষের সমাজকে চিড়িয়াখানায় রূপান্তরিত করে। সেখানে মানুষকে বরাহ, নেকড়ে, শৃগাল, সিংহ, ছাগল, কুকুর ইত্যাদি প্রতীকে অবসিত করা হয়, আমাদের দেশের রাজনীতির সমকালীন চিহ্নশালায় (আর্কাইভ) যার বিস্তর নজির পাওয়া যায়। 

বলা দরকার, খোদ ইংরেজরাই ক্লাইভকে তুলনা করেছিল শকুনের সঙ্গে। জীবনের শেষ সময়ে ক্লাইভ অনেকটা ধিক্কৃত হয়েছিলেন বাংলার সম্পদ লুট করার জন্য। তখন তাঁকে বলা হয়েছিল লর্ড ভালচার বা শকুনরাজা। কথা হলো, ক্ষমতা যদি নিত্য মানুষকে পশুতে পর্যবসিত করে তখন প্রশ্ন ওঠে, খোদ মানবতা কি রাজনীতির বিষয় হয়ে উঠতে পারে? মানবিক মর্যাদা, মানবাধিকার বা মানবতাবিরোধিতা রাজনীতির বিষয় হয়ে উঠলে বিষয়টি কেমন হয়? 

ঢালী আল মামুন অবশ্য তাঁর শিল্পভাবনায় নিছক আদমকেন্দ্রিকতায় সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি গাছের কাছে, প্রাণের কাছে গিয়েছেন। মানুষ ও প্রকৃতির ইতিহাসের সঙ্গে সাম্রাজ্যের ইতিহাসকে একসূত্রে গেঁথে বুঝতে চেষ্টা করেছেন। 

প্রদর্শনীর এক প্রান্তে বৈদ্যুতিক শক্তিতে ঘুরছে এক সারি সেপাই। তাদের যেন চেনা গেল প্লাস্টিক-পূর্ব যুগে শিশুদের প্রিয় খেলনা ‘তালপাতার সেপাই’রূপে। অনেকে বলেন, পলাশীর যুদ্ধের পরে বাংলায় এই তালপাতার সেপাই খেলনার আবির্ভাব। উদ্ভব যে সময়েই হোক, তালপাতার সেপাই শাসনকর্মী সেপাই—পুলিশের নির্বীর্যকরণের বাচিক প্রতীক হিসেবে হাজির হতে পারে বটে। ক্ষমতার ফৌজি কর্মীদের নিয়ে আমমানুষের মশকরার প্রতীক হিসেবেই এই তালপাতার সেপাইয়ের হাজিরা, জানাচ্ছেন শিল্পী। এই মশকরার বিপরীতে রয়েছে এক সারি মানবখুলি, যার ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মার্কা আর তাঁতের নকশার যুগপৎ আরোপণ সওদাগরি সাম্রাজ্যের গভীর হিংসাত্মকতার ত্রাসজাগানিয়ারূপ হাজির করে।     

এসব সচল বা নিশ্চল ভাস্কর্যের পাশাপাশি রয়েছে গোলাকার চিত্রকর্ম, যাতে শিল্পী মোগল ক্ষুদ্রচিত্র থেকে শুরু করে কালীঘাটের পট, জীবদেহের বৈজ্ঞানিক অ্যানাটমি, উপনিবেশি আইকনোগ্রাফি বা জয়নুলের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালার নানা সুরতের ভেতর দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বরাটের বাস্তবতাকে উপস্থাপন করেছেন। চিত্রকর্মগুলোকে গোলাকার পটভূমিতে স্থাপন করা নিয়ে ঢালী আল মামুনের ভাষ্য, ‘আমাদের নকশিকাঁথা তৈরির যে প্রক্রিয়া; অর্থাৎ নারীরা একসঙ্গে গোল হয়ে বসে সব প্রান্ত থেকে সেলাই করেন, আমার এই কাজকে সেটিরই একটি সূত্র বা “রেফারেন্স” হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। যখন দর্শক দেখবেন, তাঁরাও গোল হয়ে সবদিক থেকে দেখতে পারবেন।’ 

প্রদর্শনীতে ঢুকলেই দেখবেন, একটি রেললাইনের ওপর মূত্রত্যাগ করছে একদল কুকুর। আর এই কুকুরগুলোর শরীরে রবার্ট ক্লাইভের মুখ বসিয়েছেন শিল্পী

একই সঙ্গে এই গোলাকারকে আপনি ভাবতে পারেন সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের সাকার, সলিমুল্লাহ খান যাকে বলেন ‘গোলকধাঁধাঁ’। 

আলোক প্রক্ষেপণের মাধ্যমে দৃশ্যমান সচল চিত্রগুলোও গোলাকার পটভূমির। সেখানে দৃশ্য ও চরিত্রগুলো ঘুরে ঘুরে চলে। শিল্পী বেশ জোরসে বলেছেন যে এই গোলাকারের মধ্য দিয়ে তিনি সরলরৈখিক সময়ের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই ইঙ্গিত গুরুত্ববহ। জীবনানন্দের মতো মহাকালিক ও অণুকালিক, মহাকায় ও অণুকায়ের মাপ বদল করার মধ্য দিয়ে শিল্পী হয়তো এখানে অতীত ও সমকাল, মানবিক সময় ও প্রাণবিক সময়, রাজনৈতিক ভূগোল ও ভুবনের ভূগোলের ভেদরেখা লঙ্ঘন করেছেন।   

উপাদানের ক্ষেত্রে ছবি ও ভাস্কর্যে চা, মসলা, পাট ইত্যাদির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে শিল্পী চার্লস স্যান্ডারস পার্স-কথিত ছবি (আইকন), প্রতীক (সিম্বল) আর আলামত (ইনডেক্স), তিন ধরনের চিহ্নই আমল করেছেন। আলামত বা ইনডেক্স আমাদের চিহ্নের ছুতায় চিহ্নিত পদার্থের একেবারে কাছে নিয়ে যায়। এত কাছে নিয়ে যায় যে শুনতে পাই কোনো কোনো দর্শক এসব চা কিংবা মসলা খুঁটিয়ে দেখার পাশাপাশি খুঁটেও দেখেছেন যে আসলেই সেগুলো চা কিংবা মসলা কি না। শিল্পের সঙ্গে দর্শকের মিথস্ক্রিয়ারই এক নিবিড় চেহারা এই খুঁটিয়ে দেখা ও খুঁটে দেখা।  

এই চিন্তাময়ী, তত্ত্ববোধিনী শিল্পকলা দেখতে গিয়ে আপনার মনে পড়বে মান্যবর হেগেলের কথা, যিনি বলেছিলেন, শিল্পকলা যুগে যুগে প্রতীকায়ন আর মানবায়ন পার হয়ে প্রবেশ করেছে ভাবগত বা রোমান্টিক জমানায়। হ্যাঁ, হেগেলও উঁকি দিচ্ছেন ঢালী আল মামুনের প্রদর্শনীর এক ভাঁজে। ইতিহাসের খলনায়ক না হলেও ইতিহাসবাদের খলনায়ক হিসেবে তাঁকে হাজির করেছেন ঢালী। যেনবা আখেরি আধুনিকতার জমানায় একপ্রকার পরা-হেগেলিয়ানা দিয়েই উপনিবেশি-আধুনিকতার হেগেলের শ্রাদ্ধ করলেন শিল্পী।

প্রদর্শনীটি চলবে ২৬ মার্চ পর্যন্ত।