Thank you for trying Sticky AMP!!

থিয়েটারচর্চায় হালের ‘সংকট’

ঢাকা থিয়েটার প্রযোজিত বনপাংশুল নাটকের দৃশ্য

গত পাঁচ দশকে ‘স্বাধীনতার অন্যতম অর্জন’ নামে চিহ্নিত হয়েছে থিয়েটার, আমাদের নিজেদের মিলনায়তন হয়েছে, ব্রিটিশ আমলের অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিল হয়েছে, জেলায় জেলায় শিল্পকলা একাডেমির ভবন হয়েছে, থিয়েটারের সঙ্গে সঙ্গে থিয়েটারওয়ালা নাট্যপত্রিকা হিসেবে বেশ চলছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নাট্যকলা বা পরিবেশনবিদ্যা নামে থিয়েটারের করণ-কৌশল পড়ানো হচ্ছে—এমফিল, পিএইচডি হচ্ছে বাংলাদেশের থিয়েটার নিয়ে। গত পঞ্চাশ বছরে পঞ্চাশটি নাটক নির্বাচিত হয়েছে দর্শকদের ভোটে, যার বেশির ভাগ প্রাসঙ্গিক বিষয় ও তারুণ্যের সৃজনভাবনা উপস্থাপন করেছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে শুরু হওয়া ঢাকাই থিয়েটার প্রথমে বৈষম্যের বিরুদ্ধে, তারপর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি সহিংসতা অবসানের জন্য ডাক দিয়েছে। তবে হালের ডাকে ধক কমেছে বলে অনুভূত হচ্ছে। খুঁজে দেখা দরকার এই ধক কমার কারণ কী? 

গত এক দশক বা তার বেশি সময় ধরে থিয়েটারচর্চায় নানা পরিবর্তনের ইশারা টের পাওয়া গেলেও সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা বড় কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সেসব ঘটনা কেন্দ্র করে চলা নাট্যকর্মীদের নানামুখী তৎপরতা বলছে যে বাংলাদেশের থিয়েটারচর্চা খুব গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদলের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছে। 

গত এক বছরে শিল্পকলা একাডেমিকেন্দ্রিক দুর্নীতির অভিযোগ এবং অভিযোগকে ঘিরে নানাবিধ তৎপরতা শিল্পকলা ছাড়িয়ে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনকে বিভক্ত করে গোটা দেশের নাট্যকর্মীদের ‘ভাগের মানুষ’ বানিয়ে ছেড়েছে। অথচ কেউ বলছেন, সংকট আছে। কেউ বলছেন, সংকট নেই। কেউ বলছেন, ফেডারেশনের দরকার নেই। কেউ বলছেন, ফেডারেশন থাক, তবে একটু সারাই করে কাজ চালিয়ে নেওয়া যাক। সংকট কোথায়, সে বিতর্ক সংকটের তর্কের চেয়ে কম নয়। বর্তমান পাঁকের দাগ অতীতের গরিমার মধ্যেই সুপ্ত বলে গত দেড় দশকের ঘটনাক্রম এখানে স্মর্তব্য।

২০০৯ সালে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতি ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে একই ব্যক্তি নির্বাচিত হলেন। স্বার্থের সংঘাত জেনেও স্বল্পমেয়াদি লাভের আশায় গণতন্ত্র বা সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক বিধিবিধানের ন্যূনতম তোয়াক্কা না করে থিয়েটার-সংগঠনগুলো বছরের পর বছর ধরে একই ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে গেছে, যার মাশুল আজ দিতেই হবে। আমাদের একে অপরের প্রতি বিশ্বাস টুটে গেছে। 

হালের আসল ‘সংকট’ তাহলে কোথায়? 

রাজনীতিতে

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি জাতিকে পরিণত করে তুললেও এর অভিঘাতে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে নানা রকম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থান ঘটে, শাহবাগে জেতার শ্লাঘায় আত্মরতিরত থাকায় যা আমাদের কল্পনার আগে ছেয়ে ফেলেছে আমাদের আকাশ। ২০১৩-১৪ সালজুড়ে দেশে প্রগতিশীল মুক্তমনা লেখক-সংস্কৃতিকর্মীরা হামলা-হত্যাকাণ্ড-জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন, যার পেছনে এসব শক্তির এবং তাদের রাষ্ট্রীয় পোষকতার ছায়া লুকানো থাকেনি। রাষ্ট্র আর সরকারের পার্থক্য করতে না পেরে, যেকোনো সমালোচনাকে সরকার বিরোধিতা মনে করে তা থামাতে শক্তি প্রয়োগ করে নাটক বন্ধ করে দিয়েছে যখন, তখনো এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি—সংকট সেখানেও। 

একদিকে রাজনীতিতে কর্তৃত্ববাদিতার থাবায় কথা বলার স্বাধীনতা না থাকা বা রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের লাগামহীন দুর্নীতি, গুম ও নিপীড়ন। অন্যদিকে আঞ্চলিক রাজনীতির খেলায় ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার অবাধ চাষ। হালের থিয়েটারি জবানে-বয়ানে নেই এসবের নির্মোহ পর্যালোচনা। 

ভিন্ন ধর্ম, জাতিসত্তা বা প্রান্তিক মানুষের যৌথতার অধিকার আদায়ের প্রশ্নে সোচ্চার হইনি, থামাতে পারিনি নারীর প্রতি সহিংসতা। নারীপ্রধান চরিত্রের নাটক থাকলেও নারীপ্রধান দলের সংখ্যা কম। যৌথ সংগঠনে নারীর দেখা মেলা এমন কঠিন যে থিয়েটারি আয়োজনের মঞ্চ আলো করেন সার দেওয়া পুরুষ। 

অভিনেত্রীরা মঞ্চের পাশের উইংসে, দলে, আসা-যাওয়ার পথে, রাস্তায়, কর্মক্ষেত্রে নিপীড়নের জীবন বয়ে চলেন। দলেও যুদ্ধ আরেক নন্দন মিথের সঙ্গে—হয় তাঁকে হতে হবে চোখধাঁধানো রূপসী অথবা কেউকেটা কারও মেয়ে, বোন, স্ত্রী বা নিদেনপক্ষে প্রেমিকা। নিজ যোগ্যতায় অর্জনও যদি করেন কিছু, তার কৃতিত্ব দলে থাকা পুরুষ আত্মীয়ের বলে বিবেচিত হয়। বডি শেমিং, স্লাট শেমিং ও ম্যানসপ্ল্যানিং প্রতিদিনের বাস্তবতা। 

থিয়েটারের আঙিনায়

প্রথম কথা হলো, কাদের জন্য থিয়েটার করব? দর্শক কারা? শহরের বড়লোক, মধ্যবিত্ত না গরিব—মনে দ্বিধা রয়েই গেছে। নাটকের দর্শক তৈরি হয়নি আর যাঁরা কখনো নাটক দেখতে পাবেন না, তাঁদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা হয়নি। পেশাদার বিনোদনশিল্পী আর স্বেচ্ছাসেবামূলক সংস্কৃতিকর্মীর মধ্যে কোনটাকে বেছে নেব বা কার অর্থায়নে হবে নাটক, সেসব ঠিক না করে কেবল ঝলমলে মিডিয়া দুনিয়ার প্রবেশদ্বার হয়ে রয়ে গেছি আমরা। নাটকের বিষয়বস্তুতে মেরুদণ্ডের অভাব। আঙ্গিকগত ভাবনা অনুকৃতিতে ভরা। যেটুকু নতুন, তা গিমিকে মোড়ানো চকচকে। কাছে গেলে ফাঁক বড় হয়ে বাজে। পড়ালেখা-বোঝাপড়ার থেকেও অনেক দূরে জনতার সঙ্গে সংযোগ নেই, নিজেরা নিজেদের পিঠ চাপড়ে বুক ফুলাই। 

সমাধান কোথায়

রাষ্ট্রীয় বরাদ্দে সবার অধিকার, যা সরকারের যেকোনো নীতির নিগড়মুক্ত হতে হবে। ক্ষমতার প্রভাবমুক্ত থেকে ফেডারেশন বা শিল্পকলা ভালো দল, নাটক, নির্দেশকদের পৃষ্ঠপোষকতা করবে। সংগঠনে পাঠ, সৃজনশীলতা, সহিষ্ণুতা ও গণতন্ত্রের চর্চা করে স্বাধীন কর্মী তৈরি করে তাঁদের রাজনীতি, অন্য শিল্পমাধ্যম এবং ধারার সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে। চিহ্নিত মূল সংকটগুলোর সঙ্গে প্রত্যেক নাট্যকর্মীর পরিচয় থাকতে হবে এবং তা থেকে উত্তরণের চেষ্টা তাঁদের থাকতে হবে।