Thank you for trying Sticky AMP!!

ইতিহাস পড়তে পড়তে...

জাহানারা

[এটি শুধু একটি ফ্যান্টাসি মাত্র। ইতিহাস পড়তে পড়তে মাঝেমধ্যে কল্পনার লাগাম ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে]

১.
হারেমে তার রাজকীয় মহলের কক্ষ থেকে দারাশুকোকে বেরিয়ে যেতে দেখল জাহানারা। প্রিয় সহোদরের দীর্ঘ শালপ্রাংশু দেহটা নিষ্ক্রান্ত হতেই খোজারা আস্তে-ধীরে বন্ধ করে দিল বিশাল স্বর্ণের পাত মোড়া রত্নখচিত দরজার কপাট।

এক মাস হলো নিজের প্রাসাদ থেকে আগ্রা দুর্গে হারেমের এই মহলে অন্তরীণ হয়ে আছে সে। পিতা শাহেনশাহ শাহজাহান অসুস্থ। কিন্তু সবচেয়ে আদরের এবং কাছের হয়েও তার কাছে যাওয়ার আজ আর অনুমতি নেই তার। উপলক্ষ নিকোলাস ব্যালেন্টাইনকে লেখা তার চিঠি। আহ্‌, কী কুক্ষণেই ওই কথাগুলো লিখেছিল সে, ‘পুরুষের আকাঙ্ক্ষা আর চাহিদা এমন অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে কেমন করে জানব আমি’, আসলে কথাগুলো অনুজ আওরঙ্গজেবের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর মনোভাব জানার প্রচেষ্টা হলেও এর আসল অন্তর্নিহিত উপলব্ধি করা চিঠি পড়ে চট করে সম্ভব না কারও পক্ষেই।

রাত তৃতীয় প্রহর অতিক্রান্ত। ঘুরে খোলা বাতায়নের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় জাহানারা। রাতের গভীর এই ক্ষণে সেই গোয়ালিয়র থেকে এক দুঃসংবাদ বয়ে এনেছে দারা। আব্বাহুজুরের অসুস্থতার সুযোগে দক্ষিণ থেকে আওরঙ্গজেব গুজরাট থেকে মুরাদ আর বাংলা থেকে শাহ সুজা নাকি রওনা দিয়েছে আগ্রার দিকে, সশস্ত্র এবং সৈন্যবাহিনীসমেত।

‘আওরঙ্গজেব’, বলেছিল দারা। ‘সেই উসকাচ্ছে সবাইকে।’
কিন্তু কেন? দারাকে জিজ্ঞাসা করেছিল সে।
‘আমাকে ঘৃণা করে সে, তার চোখে আমি ধর্মদ্রোহী।’
ভাইয়ের সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়েছিল জাহানারা। সুলায়মান শুকো পূর্ণ যুবক, সিপারও প্রায় তা-ই। তবুও প্রাক্‌-যৌবনের নিষ্পাপ লাবণ্যে ভরপুর দারার মুখ।
‘ওভাবে ভেবো না, আসলে মোল্লারা ক্রমাগত কান ভারী করে চলেছে তার।’
শুনে হেরেছিল দারা, স্মিত কিন্তু করুণ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল তার উজ্জ্বল চোখ।
‘ভুল বলছ তুমি’, বলেছিল সে, ‘তাকে চালায় এমন মোল্লা হিন্দুস্থানে কেন, সারা দুনিয়ায় পয়দা হয়নি আজ পর্যন্ত। ইসলাম সম্পর্কে তার যে গভীর প্রজ্ঞা তা আর কোনো মোল্লারই নেই হিন্দুস্থানে। ধর্মের কঠোর অনুশাসন ছাড়া আর কিছুই নেই তার অন্তরে।’
দারার হতাশায় বলা কথাগুলো যেন বাতাসে ভাসছে এখনো। অস্তমিত চাঁদের আলোয় দূরে উদ্ভাসিত তাজমহল। বাতাসে ভাসছে প্রাসাদের বাগানে ফোটা জেসমিন আর গোলাপের সুবাস। ভাবনাগুলো নানা রঙের ছেঁড়া সুতোর মতো উড়ে যাচ্ছে একটা থেকে আর একটায়।

মোগল সাম্রাজ্যের প্রভাবশালী এক শাহজাদী

নিকোলাস ব্যালেন্টাইন। কেমন আছে সে? সাতি-উন-নিসা জানিয়েছে, সুরাটে ইংল্যান্ডগামী জাহাজের জন্য অপেক্ষমাণ সে। হয়তো এর মধ্যে পেয়েও গেছে জাহাজ।

আর কি দেখা হবে কোনো দিন? চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে শাহজাদি জাহানারা। মোগল সাম্রাজ্যের একমাত্র কুমারী সম্রাজ্ঞী; যদিও সেই মর্যাদা থেকে অনেকটাই অবনতি ঘটেছে তার। তার মা আর্জুমান্দ বানুর সিলমোহরসংবলিত অঙ্গুরী এক গোপন রাজকীয় আদেশে অপসারিত হয়েছে তার কাছ থেকে। নিকোলাসকে চিঠিতে লেখা ওই কথাটা কি শুধু উত্তরে কান্দাহারে পরিচালিত আওরঙ্গজেবের ব্যর্থ যুদ্ধযাত্রার ফিরিস্তি আর চাপা স্বভাবের অনুজের গোপন অভিলাষ বের করে আনার প্রচেষ্টা? নাকি পুরুষ হিসেবে নিকোলাস কী ভাবে, কী ভাবছে, সেটাও জানতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল তাতে?

কেন সে লিখল কথাগুলো? সেই অভিযোগই তো আজ সন্ধ্যায় প্রকাশিত হয়েছে রৌশনারার তীব্র শ্লেষমিশ্রিত কথায়। না, জবাব দিতে পারেনি সে, করতে পারেনি প্রতিবাদ। আজ এই ক্ষণে বারুদ আর রক্তের গন্ধ যখন বাতাসে ভাসছে, শাহজাদির মন তখন ভেসে চলে যায় অতীতে সুবে বাংলার দুর্গম জঙ্গলের ধারে। নূরজাহানের প্ররোচনায় দাদু জাহাঙ্গীরের জারি করা মৃত্যুপরোয়ানা মাথায় নিয়ে সে আর তার পরিবার তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে সুবে বাংলার কর্দমাক্ত পথে-জঙ্গলে। সঙ্গে বিশ্বস্ত ছায়ার মতো গভীর নীল চোখের ইংরেজ লোকটা। দীর্ঘদেহী কাঁধ ছাপানো সোনালি চুল বেণিবদ্ধ। তাদের তুলনায় দুই পোচ সাদা গায়ের চামড়া রোদে পুড়ে লালচে।

‘ওটা কি ফুল নিকোলাস?’ বনের পাশে বিশাল এক সরোবরে ফুটে থাকা অনেকটা পদ্মের মতো সাদা ফুলগুলো দেখিয়ে বলেছিল দ্বাদশী জাহানারা। স্থানীয় নাম ‘শাপলা’, জবাব দিয়েছিল নিকোলাস।

‘কী সুন্দর,’ গালে আঙুলের ডগা ছুঁইয়ে বিস্ময় প্রকাশ করতেই ‘আপনার চাই, শাহজাদি?’ শুধিয়েছিল নিকোলাস, তারপর জবাবের অপেক্ষা না করেই গায়ের বেনিয়ান খুলে নেমে পড়েছিল জলে।

সেদিন সেই অজানা সুন্দর ফুলগুলো তাদের রাজকীয় পালকির সিল্ক আর রেশমে মোড়া গদির ওপর বিছানো ছিল কোলের কাছেই। পালকির রেশমি পর্দার ফাঁক দিয়ে তাদের অঙ্গরক্ষক সৈনিকদের পাশ দিয়ে সাদা ঘোড়ায় চলতে থাকা নিকোলাসকে উঁকি দিয়ে দেখত সে। আর অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রীতে একটা মিষ্টি প্রশ্রয়ের হাসি নিয়ে তার দিকে চেয়ে থাকত তার আম্মিজান মুমতাজ মহল। আহা, সেই দিনগুলো কী কষ্টে আর তকলিফ গেছে তাদের জীবনে। তার পিতা তখন বাদশাহ নন। শুধু হিন্দুস্থানের শাহেনশাহর বিদ্রোহী শাহজাদা খুররম। সেই দিনগুলোয় তাদের পাশেপাশেই ছিল ইংরেজ লোকটা। তার কাছে দারাশুকো শিখত ইংরেজি ভাষা, সেই সঙ্গে তারা দুই ভাইবোন গভীর আগ্রহে জানতে চেষ্টা করত ইংল্যান্ড নামের অচিন সমুদ্রপারের সেই দেশের সমাজ-ধর্ম-সংস্কৃতি চালচলন।

মাঝেমধ্যে শাহ সুজাও বসত তাদের সঙ্গে। কিন্তু মেজ রাজপুত্রের অলসতাই ছিল সবচেয়ে আগ্রহের বিষয়। দেখত আওরঙ্গজেবকে অস্ত্রশিক্ষা দিচ্ছে লোকটা। গভীর অধ্যবসায় নিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপে দীর্ঘ সময় নিয়ে একাগ্রতায় অস্ত্রশিক্ষার ধাপগুলো পার করে যাচ্ছে ছোট্ট রাজকুমার। অবসরে ছোট্ট মুরাদের জন্য ছুরি দিয়ে কাঠ কুদে খেলনা বানাত নিকোলাস। মোগল হারেমের চিরাচরিত বাধা নিষেধ থেকে অনেক দূরে অদ্ভুত রকম স্বাধীন ছিল তাদের জীবন।

রোশনারা বেগম

২.
তাড়া করা মোগল বাহিনীকে এড়াতে দুর্গম জঙ্গুলে পথ বেছে নিত তারা। গভীর বনের কোলে ফাঁকা কোনো জায়গা পানীয় জলের উৎস ঘেঁষে শিবির পড়ত তাদের। বিকেলের আলো মরে আসার আগেই এদিক-ওদিক ঘুরতে যেত তারা। সে, সঙ্গে দারাশুকো, শাহ সুজা দুজন, কোনো দিন তার সঙ্গে এই দুই ভাইয়ের যেকোনো একজন, আবার কখনো সে একলাই। সব সময়ই তাদের অঙ্গরক্ষক হতো নিকোলাস। খুররম আর আর্জুমান্দ স্থানীয়দের কারও চেয়ে কেন জানি এ ব্যাপারে বেশিই বিশ্বাস করত এই ভিনদেশিকে।

সেদিন দারা-সুজা কেউ নয়, সে আর নিকোলাস গিয়েছিল বনের পাশে বয়ে চলা ঝরনা দেখতে। ফেরার পথে কাঁটা-ঝোপ অতিক্রমের সময় তার রেশমি ঘাঘরায় কাঁটা বিধে গিয়েছিল অনেকগুলো। তার পায়ের ওপরে, ডান পায়ের হাঁটুর নিচে ছড়ে গিয়ে রক্তাক্ত হয়েছিল ধারালো কাঁটার ঘষায়। হয়তো বিষ ছিল কাঁটায়। জ্বলুনি শুরু হয়েছিল তীব্রভাবে। পথের পাশে বসে পড়েছিল সে।

‘একটু দেখতে দিন শাহজাদি,’ বলেছিল নিকোলাস। কী করবে বুঝতে পারছিল না জাহানারা। এদিকে বিষাক্ত কাঁটার জ্বালায় ছড়ে যাওয়া জায়গাটা যেন জ্বলছিল দপদপ করে। শেষে সহ্য করতে না পেরে ঘাগরাটা একটু ওপরে তুলে কাটা জায়গাটা বের করে দিতেই উন্মুক্ত হয়েছিল তার পেলব পদযুগল।

গোড়ালিতে সোনার নূপুর আঁটা সেই শেষ বিকেলের আলোয় মোগল রাজকুমারীর নিটোল শুভ্র পদযুগলের সৌন্দর্যের আভায় যেন সোনালি আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল বাংলার দুর্গম বনপ্রান্তর। সেই সৌন্দর্যে নয়, শাহজাদির তকলিফে তীব্র উদ্বেগ ফুটে উঠেছিল নিকোলাস ব্যালেন্টাইনের মুখমণ্ডলে। দ্রুত আশপাশে তাকিয়ে একটা ঝোপের দিকে ছুটে গিয়েছিল সে। কতগুলো পাতা আর লতাগুল্ম ছিঁড়ে এনে বসেছিল তার পাশে। চোখ দিয়ে জল ঝরছিল জাহানারার। এ অবস্থায় শাহজাদির অনুমতির অপেক্ষায় না থেকে হাত বাড়িয়ে আলতো করে তার হাঁটুর নিচে হাত দিয়েছিল নিকোলাস। তারপর বিষ শুষে নেওয়ার জন্য মুখ নামিয়ে ঠোঁট রেখেছিল কাটা জায়গায়। বিষাক্ত কাঁটার জ্বালা কিন্তু সেটা ছাপিয়ে শরম আর শিহরণের একটা স্রোত বয়ে গিয়েছিল সদ্য ঋতুমতী শাহজাদির শরীরজুড়ে।

শাহজাদী জাহনারা

এ কথা কাউকে বলার নয়। প্রকাশ পেলে দুনিয়ার ঐতিহ্যবাহী রাজবংশের সামান্য এই ঘটনাও হয়তো স্থান পেয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায়। তাই সেদিনের সেই ঘটনাটা নিজের হৃদয়ের রত্নঝাঁপিতে গোপন করে রেখেছে সে।

সেই বিকেলের পর সময় এগিয়েছে। মনে আছে সেই ঘোর বর্ষা দিনের কথা। দুটো গোবাহী শকটে তাদের পরিবার। বর্ষার জলে উপচে যাওয়া খরস্রোতা মাতামুহুরী নদী পার হতে হবে তাদের। পেছনে তাড়া করে আসছে মোহাব্বত খানের মোগল বাহিনী। তাদের বাহিনীর কিছু অংশ পেছনে রেখে বড় অংশটা অজিত সিংয়ের নেতৃত্বে সামনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। দারা, সুজা, আওরঙ্গজেব যথারীতি ঘোড়ায় সওয়ার। তাদের সঙ্গে নিকোলাস আর কিছুসংখ্যক অঙ্গরক্ষক। বাকি অঙ্গরক্ষক আর মুরাদকে নিজের ঘোড়ায় নিয়ে পার হয়ে গেছেন আব্বাহুজুর। প্রথম শকটে সে আর সাতি-উন-নিসা, তারা পার হলো ঠিকঠাক। অপর শকটে আম্মি মুমতাজ মহল সদ্যোজাত রৌশনারা আর একজন পরিচারিকা। দুপাশে সৈন্যরা টেনে ধরে আছে রশির শিকল। ঠিক মাঝনদীতে প্রবল স্রোতে হঠাৎই বল্গা ভেঙে কাত হয়ে গেল শকট। মুহূর্তেই স্রোতে ভেসে গেল ষাঁড় দুটো, সেই সঙ্গে নাসরিন নামের পরিচারিকা মেয়েটি। মায়ের কোল থেকে ছিটকে জলে পড়ল রৌশনারা, অপেক্ষা না করেই জলে ঝাঁপ দিলেন তার আম্মিজান। বিস্ফোরিত চোখে সেদিন এপার থেকে তার আব্বাহুজুর আর ওপার থেকে নিকোলাসকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছিল সে। ঘোড়া ছুটিয়ে নদীর স্রোতের দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে দেখেছিল দারা, সুজা, আওরঙ্গজেবসহ অঙ্গরক্ষকদের। সেদিন অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিল তার আম্মি আর রৌশনারা। তার আম্মির বাহুতে আঘাত লেগে ক্ষত হয়েছিল গভীরভাবে। এই ঘটনার পরই ভাগ্যের মোড় ঘুরে গিয়েছিল তাদের। জাহাঙ্গীরের হঠাৎ মৃত্যুতে সহজ হয়ে যায় আব্বাহুজুরের সিংহাসনে আরোহণে পথ। এরপরই নিকোলাস বিদায় নেয় তাদের থেকে। চলে যায় সুরাটে। তাকে ভুলেই ছিল জাহানারা। শুধু মাঝেমধ্যে মনে পড়ত মুখটা। তখন চৌদ্দ না পনেরো চলছে তার। দক্ষিণাত্য অভিযানে তাদের পুরো পরিবার। তীব্র গরমের এক রাতে দুর্গে তার নিভৃত কক্ষে অদ্ভুত এক স্বপ্ন হানা দিয়েছিল তার ঘুমে। দেখেছিল চন্দ্রালোকিত এক প্রান্তরে হীরা আর রুবিখচিত লাল চোলি আর মুক্তা–পান্নাখচিত লাল ঘাগরা পরা সে বসে আছে সাদা ঘোড়ায়। তার পিঠের কাছে ঘোড়ায় বসে আছে দীর্ঘদেহী এক ভিনদেশি যুবক। নিকোলাস ব্যালেন্টাইন। অদ্ভুত এক পুলকে সিক্ত হয়ে ওঠা জীবনে তার সেদিনই ঘটেছিল প্রথম আর শেষবার। না, সেদিনের পর আর কোনো দিন নিজের মনকে প্রশ্রয় দিতে সাহস পায়নি সে।