সুলতানের অস্পষ্ট পিকাসো-দালি
আজ বরেণ্য চিত্রকর এস এম সুলতানের জন্মদিন। সম্প্রতি এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক লটি হোক লন্ডনে সুলতানের প্রদর্শনী নিয়ে নতুন কথা বলেছেন, যা তৈরি করেছে বেশ চাঞ্চল্যও।
কয়েক দশক ধরে এস এম সুলতানকে নিয়ে প্রকাশিত প্রায় সকল নথিপত্রে লেখা আছে, ১৯৫০ সালে লন্ডনে শিল্পীর ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল। হ্যাম্পস্টিডে ভিক্টোরিয়া এমব্যাংকমেন্টের সেই প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের এই বরেণ্য শিল্পী সুলতান অংশ নেন পাবলো পিকাসো, সালভাদর দালি, পল ক্লি, অঁরি মাতিসদের মতো শিল্পীদের সঙ্গে।
তথ্যটা প্রতিষ্ঠিত, তবু এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক লটি হোক ঘটনাটির গভীরে দেখার চেষ্টা করেছেন। তিনি এমন কিছু আবিষ্কার করেছেন, যেটা কয়েক দশকের একটা বিশ্বাসকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে।
প্রথমত, হ্যাম্পস্টিড ও ভিক্টোরিয়া এমব্যাংকমেন্ট লন্ডনের দুটো ভিন্ন জায়গা। দুই জায়গাতেই ছবির প্রদর্শনী হতো অবশ্য। দুটোই ছিলো উন্মুক্ত ধরনের। প্রদর্শনীতে কোনো কিউরেটর থাকত না, খোলা আকাশের নিচে যে কেউ এসে ছবি দেখাতে পারত। তৎকালী‘ন দ্য ম্যানচেস্টার গার্জিয়ান’ (বর্তমানে ‘দ্য গার্জিয়ান’) পত্রিকা লিখেছিল, ‘ভিক্টোরিয়া এমব্যাংকমেন্ট গার্ডেনে খোলা আকাশের নিচে যে প্রদর্শনী হয়, সেটা কোনো শিল্পীদের সংগঠন আয়োজন করে না, করে লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিল। একটা ন্যূনতম শিল্পের মান বজায় রাখার দিকে তাদের কোনো খেয়াল নেই, সবার জন্যই তারা প্রদর্শনী উন্মুক্ত রেখেছে। ফলাফলটাও অনুমেয়—অল্প কিছু সহনীয় চিত্রকর্ম সেখানে একরাশ অর্থহীন ছবির বন্যায় ভেসে গেছে...’ (১২ এপ্রিল, ১৯৫৬)।
হ্যাম্পস্টিড ও ভিক্টোরিয়া এমব্যাংকমেন্ট—দুই জায়গাতেই সুলতান ছবি প্রদর্শন ও বিক্রি করেছেন, এই সম্ভাবনা বিশ্বাসযোগ্য। বন্ধু খান আতাউর রহমান ও ফতেহ লোহানীর সঙ্গে তিনি লন্ডনের টিউব স্টেশনে ছবি বিক্রি করতেন, এই কথাও হাসনাত আবদুল হাইয়ের লেখা ‘সুলতান’ নামের বইতে আছে। কিন্তু পিকাসো-দালিদের প্রসঙ্গ এসেছিল কোথা থেকে?
এর উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে ১৯৮৭ সালে ঢাকার গ্যেটে ইনস্টিটিউটে সুলতানের যে প্রদর্শনী হয়, সেটাকে উপলক্ষ্ করে একটা পুস্তিকা বের করা হয়েছিল। সেখানে লেখা ছিল, ‘...তাঁর [সুলতানের] চিত্রকর্ম আধুনিক শিল্পগুরু পিকাসো, দালি, ব্রাক, ক্লিদের সঙ্গে প্রদর্শিত হয়।’
এমন আরেকটা উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৯১ সালে হাসনাত আবদুল হাইয়ের লেখা ‘সুলতান’ বইয়ে। সেই বইতে সুলতান বলছেন, ‘ওই প্রদর্শনী (হ্যাম্পস্টিড কিংবা ভিক্টোরিয়া এমব্যাংকমেন্টের প্রদর্শনী) দেখে এক ইংরেজ ভদ্রলোক আমাদের বললেন, তিনি আমার দুটা ছবি লেস্টার গ্যালারিতে দেখাতে চান। সেখানে কিছুদিন পর একটা আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী হতে যাচ্ছে। ...১৯৫০ সালে লেস্টার গ্যালারির এক্সিবিশনে পিকাসো, ডাফি, পল ক্লি, মাতিস আর দালির ছবির পাশাপাশি আমার ছবিও দেখানো হলো।’
এই সূত্রকে ভিত্তি করে লটি হোক লেস্টার গ্যালারির পুরোনো ক্যাটালগ ঘেঁটে দেখেছেন। সেই সময় লেস্টার গ্যালারির প্রদর্শনী বেশ বিখ্যাত ছিল। কেবল গ্যালারি কর্তৃপক্ষ থেকে নির্বাচিত শিল্পীরাই সেখানে ছবি দেখানোর সুযোগ পেতেন। সুলতানের ‘ইংরেজ ভদ্রলোক’ আসলে লেস্টার গ্যালারির কোনো হর্তাকর্তা—এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
১৯৫০-৫৫ সালের নথিপত্র ঘেঁটে লটি দেখেন, এই কয়েক বছরে পিকাসো-দালি-মাতিসদের একসঙ্গে প্রদর্শনী হয়েছিল, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। লেস্টার গ্যালারির প্রদর্শনীতে পিকাসো ও পল ক্লি ছিলেন বটে, কিন্তু আলাদাভাবে।
ভিন্ন আরেকটি প্রদর্শনীতে ছিলেন এস এম সুলতান। সেটি ১৯৫০ না, ১৯৫২ সালের জুলাই মাসে। প্রদর্শনীর নাম ছিল ‘আর্টিস্ট অব ফেইম অ্যান্ড প্রমিজ, পার্ট ১’। এটি তৎকালীন লন্ডনের সবচেয়ে সম্মানজনক প্রদর্শনীগুলোর মধ্যে একটা। প্রতিবছর দুই পর্বে প্রদর্শনীটা হতো। এটা ছিল এক ধরনের মিশ্র প্রদর্শনী। বিভিন্ন শিল্পীর চিত্রকর্ম-ভাস্কর্য থাকত সেখানে।
সুলতানের একটা ছবিই সেই মৌসুমে প্রদর্শিত হয়েছিল—‘উইন্টার’, ‘পাটনি’ শিরোনামে।
এরপরও, পিকাসো-দালির সঙ্গে সুলতান কখনোই প্রদর্শনী করেননি—এ কথা জোর দিয়ে বলা অসম্ভব। তবে এমন কোনো প্রদর্শনী যদি হয়েও থাকে, তার কোনো নথিগত অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। লন্ডনে সুলতান তাঁর যে দুজন বন্ধুর সঙ্গে থাকতেন—খান আতাউর রহমান ও ফতেহ লোহানী—তাঁরা কেউই বেঁচে নেই।
ফলে অনেক হারানো ইতিহাসের মতো পিকাসো-দালির সঙ্গে সুলতানের প্রদর্শনীর বিষয়টাও হয়তো অস্পষ্টই থেকে যাবে।
সূত্র: লটি হোক ও সানজুকটা সান্ডারসনের ‘জার্নিং থ্রো মডার্নিজম: ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্রানজিটস অব ইস্ট পাকিস্তানি আর্টিস্টস ইন পোস্ট ইমপেরিয়াল লন্ডন’, হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘সুলতান’।
অন্য আলোয় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com