Thank you for trying Sticky AMP!!

যেসব ভাষণ সমাজের দর্পণ

ইব্রাহীম খাঁ। এই মনীষীকে নিয়ে একটি বক্তৃতা আছে বইটিতে। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

বরেণ্য শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামানের ১০টি বক্তৃতার সংকলন সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি। বিভিন্ন উপলক্ষে এই বক্তৃতাগুলো তিনি দিয়েছিলেন ২০০৭ থেকে ২০১৮ সাল সময় পরিসরে। সবই স্মারক বক্তৃতা। উপস্থিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ নয়, প্রবন্ধাকারে লিখিত। বক্তৃতাগুলোর শিরোনাম ‘বাংলার মুসলমানের পরিচয়-বৈচিত্র্য: অষ্টাদশ শতাব্দী অবধি’, ‘বিশ শতকের বাঙালি মুসলমান সমাজ: ইব্রাহীম খাঁর বাতায়নে’, ‘হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’, ‘রোকেয়ার এক বিস্মৃত অনুসারী’, ‘বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সময়’, ‘তাজউদ্দীন আহমদ: অনুকরণীয় মানুষ’, ‘খান সারওয়ার মুরশিদ ও তাঁর মূল্যবোধ’, ‘মুর্তজা বশীর: মানুষ ও শিল্পী’, ‘বাংলাদেশের সংবিধান ও তার বাংলা ভাষ্য’ এবং ‘আমরা কি এক সংকটের মুখোমুখি?’। প্রতিটি বক্তৃতার শিরোনাম থেকে তাৎক্ষণিকভাবে আলোচিত বিষয়ের গভীরতার পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে পাঠক হিসেবে আকর্ষণ বোধ না করে পারা যায় না।

বক্তৃতা বা প্রবন্ধ যা–ই হোক, পড়তে গিয়ে যখন দেখা যায়, চলিত বিষয়কেই একেবারে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা হয়েছে, তখন তার রচনাকারের প্রতি অবনত হতেই হয়। এ বইয়ের প্রথম বক্তৃতা ‘বাংলার মুসলমানের পরিচয়-বৈচিত্র্য: অষ্টাদশ শতাব্দী অবধি’–তে দৃষ্টান্তের পর দৃষ্টান্ত তুলে ধরে আনিসুজ্জামান বাংলার মুসলমানের বিবর্তনের ধারা ও তার পরিচয়ের বহুমুখীনতাকে সংক্ষিপ্ত হলেও গভীরভাবে এঁকেছেন। পরিশেষে তিনি এই উপসংহার টানছেন এই বলে যে ‘আত্মপরিচয়ের বহুত্ব উত্তেজনা বা সংকটের কারণ হতে পারে, যদি আমরা একটিমাত্র পরিচয় সম্বল করতে চাই, অথবা বর্গগুলোকে গুলিয়ে ফেলি। উনিশ শতকে বাংলার মুসলমান তেমনি সংকটে পড়েছিল তার বাঙালি সত্তা ও মুসলমান সত্তা নিয়ে, যদিও তার কোনো কারণ ছিল না। মনে রাখতে হবে যে বাসস্থান ও বৈবাহিক মর্যাদার মতো ধর্মীয় পরিচয় পরিবর্তনশীল, তবে উদ্ভব ও ভাষাগত পরিচয় অপরিবর্তনীয়। আমরা সে পরিচয় কীভাবে ব্যবহার করি, তা নিয়ে অনেক কথা হতে পারে, তবে এটুকু বলা দরকার যে পরিচয়ের বহুত্ব কিছুতেই অবজ্ঞেয় নয়।’ এই উচ্চারণ গভীরভাবে ভাবিত করে।

শিক্ষাবিদ ইব্রাহীম খাঁর আত্মজীবনী বাতায়ন নিয়ে অনুপম আলোচনার অবতারণা করেছেন আনিসুজ্জামান। বক্তৃতার শিরোনাম ‘বিশ শতকের বাঙালি মুসলমান সমাজ: ইব্রাহীম খাঁর বাতায়নে’। উল্লিখিত জীবনী থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতির মাধ্যমে তখনকার চলমান সমাজের প্রকৃত ছবি তুলে ধরেছেন তিনি। বাতায়ন নামের আত্মজীবনীতে তৎকালীন সমাজের মাতবর শ্রেণির বিচার–আচার, বহু বিবাহের বহুল প্রচলন, পর্দাপ্রথা, শরিয়তের কড়া শাসন, গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন, সমাজে নারীর অবস্থান, রাজনীতি, একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে নিজের ভূমিকা, চুয়ান্নর নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে অকপটে কথা বলেছেন ইব্রাহীম খাঁ। ফলে তাঁর আত্মজীবনী হয়ে উঠেছে কালের স্বচ্ছ দর্পণ।

এ বইয়ের ‘হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’, ‘রোকেয়ার এক বিস্তৃত অনুসারী’ বক্তৃতা দুটি যেমন কৌতূহল জাগানিয়া, তেমনি ‘বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সময়’ শীর্ষক ভাষণের ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর সুবাদে এই মহান পুরুষের নানা পর্বের জীবনকথা।

‘তাজউদ্দীন আহমদ: অনুকরণীয় মানুষ’ শিরোনামের স্মারক বক্তৃতার মাধ্যমে আনিসুজ্জামান তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং তাঁর সংগ্রামবহুল রাজনৈতিক জীবন ও দর্শনের কথা। বাদবাকি ভাষণগুলো—‘খান সারওয়ার মুরশিদ ও তাঁর মূল্যবোধ’, ‘মুর্তজা বশীর: মানুষ ও শিল্পী’, ‘বাংলাদেশের সংবিধান ও তার বাংলা ভাষ্য’ এবং ‘আমরা কি এক সংকটের মুখোমুখি’—এগুলোর পাঠ পাঠক হিসেবে বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে নিয়ে যায় আমাদের, একে অতুলনীয় ছাড়া আর কীই-বা বলা যেতে পারে! বিশেষত শেষ প্রবন্ধটি জঙ্গিবাদের উত্থান সম্পর্কে আমাদের নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে।

এ বইয়ে স্থান পাওয়া আনিসুজ্জামানের প্রতিটি ভাষণ আমাদের প্রবন্ধ সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ার দাবিদার। যেসব বিষয় তাঁর ভাষণের অন্তর্গত, তার প্রায় চুলচেরা বিশ্লেষণ পাঠকমাত্রকেই ভাবনার সঙ্গী করবে। বইটির বহুল প্রচার কামনা করি।

সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি: দশটি বক্তৃতা

আনিসুজ্জামান

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: এপ্রিল ২০১৯, ১৪৪ পৃষ্ঠা, দাম: ৩০০ টাকা।