Thank you for trying Sticky AMP!!

সরলতা আর বাস্তবতার জাদু

খালি হাতে ট্রাকের পিছারি টেনে ধরে রাখল যে, ‘...সে এক কিম্ভূত প্রাণী। তার মতো ঢ্যাঙা, এত লম্বা, এমন শুকনা আর এহেন কালো মেয়েমানুষ আর হয় না। বুক নাই, নিতম্ব নাই, পেট নাই, পিঠ নাই।...’ কিংবা সেই লোকটার কথাই ধরি, অদ্ভুত এক অনুসরণকারীর চোখ থেকে পালাতে গিয়ে যে খুন হলো, তারপর ঘরে ফিরে দেখল সেই অনুসরণকারীই খুলে দিচ্ছে দরজা! আর ওই পরিবারটার কথাও তো ভাবতে হয়, আয়নায় যারা দেখতে পাচ্ছে না নিজেদের! মনে হয়, এমনও ঘটে নাকি? মনে হয়, জাদুবাস্তবতা। তবে পরিস্থিতি আর পরিবেশ বিবেচনায় নিলে বোঝা যায়, এসব আসলে বাস্তবতারই ভিন্ন পাঠ।

আপাত-অবাস্তব এমন সব বাস্তবতা রূপায়ণে কথাশিল্পী মশিউল আলম বিশেষ পারঙ্গম। তাঁর ব্লগার ও অন্যান্য গল্প বইটাও সেই অভিজ্ঞ কলমেই লেখা। পরিণত বর্ণনা আর সংলাপে গল্পগুলো যেন ছবি হয়ে উঠেছে। অথবা বলা যায়, ঘটতে থাকা ঘটনা থেকে সুবিধাজনক দূরত্বে দাঁড়িয়ে সুচিন্তিত ক্লিকে তোলা ছবি এসব।

নানা সময়ে লেখা এমনই ১০টা গল্পের সংকলন এই বই, যার পাতায় পাতায় ‘নুড়িপাথর, কাঁকর, ময়লা কাগজ আর খোলামকুচি’ মেশা কালো মাটি এবং ঝাঁ-চকচকে আলিশান কংক্রিটে ফুটে উঠেছে বাস্তবেরই বাংলা। তাতে চরেও বেড়ায় সংকট ও সংগ্রামে কল্পনা ও রিউমারে টলে ওঠা স্বাভাবিক মানুষ। অর্থাৎ সাধারণ যাপনের জীবনই গল্পগুলোর ভিত্তি। তবে তা-ই অসাধারণ সব দৃশ্যপট আর চিন্তার উদ্রেক ঘটায়।

আবহ ও চরিত্র স্থানিক হওয়া সত্ত্বেও বইয়ের কিছু গল্পের দৃষ্টি ও দর্শন ভীষণভাবে বৈশ্বিক। ভাঙনোন্মুখ সোভিয়েত রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ বয়ান ‘পানপর্ব: ১৯৯১’ যেমন সম্পূর্ণ ভিন্ন মাটিতে গড়ে উঠলেও মননে ও মগজে এর চরিত্রগুলোকে দূরের মনে হয় না। আবার ঠিক উল্টো কথা বলতে হয় ‘এটা নাবিলা’র ক্ষেত্রে। ঢাকার বল্গাহীন দূষণ আর অনিয়ন্ত্রিত যাপনই এর প্রেক্ষাপট, তবু পড়ার সুযোগ হলে বিশ্বের বহু দেশের পাঠকই ভাবতে পারেন গল্পটা তার শহর নিয়েই লেখা! 

>

ব্লগার ও অন্যান্য গল্প
মশিউল আলম
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯
১৩৫ পৃষ্ঠা, দাম: ২৮০ টাকা।

বইয়ের সবচেয়ে ভাবনাজাগানিয়া গল্প, ‘কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না’। ‘বাবা, আর বুড়া হয়ো না প্লিজ, তার চেয়ে বরং তুমি এখন মরে যাও।’—হালকা চালে বলে ফেলা কথাটা যেন বুকে বিঁধে যায়! তারপর জামিল, তার বাবা, আর ছেলে খোকন—তিন প্রজন্মকে এক সুতোয় বেঁধে দিয়ে যে চরকা লেখক ঘুরিয়ে দেন, তা-ও রীতিমতো ভয়ানক! ভয়াল একাত্তরের অসহনীয় বাস্তবতার সাক্ষীও হতে হয় ‘বিহারি বাবুলাল’ পড়তে পড়তে। নামগল্পে আবার গায়ে লাগে অবিস্মরণীয় শাহবাগ আন্দোলনের নানামুখী ভাপ ও তাপ।

চেনা-অচেনা মানুষের এসব গল্পই খুব নির্মোহ ও নিরাসক্ত ভঙ্গিতে গড়েছেন লেখক। তীক্ষ্ণ তাঁর অন্তর্দৃষ্টি; স্বর অনুচ্চ, সুরটাও অনাড়ম্বর। তাতে নেই কোনো জমক, অযথা চমকও নেই; নেই তথাকথিত কোনো ‘ঘোর’। ঘটতে থাকা ঘটনাটাই যেন তুলে ধরেছেন তিনি। পাঠক এতে তাই ‘কোনো ফলস হোপও পাবেন না, প্লিজেন্ট লাইও পাবেন না। পাবেন শুধু হেল্পলেস হিউম্যান কন্ডিশন’। ‘ফাতেমা ও তার ছেলে’, ‘উত্তরাধিকার’, আর ‘অনুসরণ’—এসব গল্প পড়তে পড়তে সত্যিই আমাদের হেল্পলেস লাগে, মন কেমন করে।

মনোরম ছাপা, প্রায় নির্ভুল বানান আর সুন্দর প্রচ্ছদ ও বাঁধাইয়ের বইটার ভাষা টান টান। কিছু জায়গায় বর্ণনা যদিও শিথিল; বিশেষত রাস্তাঘাটের নিখুঁত বর্ণনার অতিবিস্তার পীড়া দেয়। একঘেয়ে লাগে বাক্যে বাক্যে একই ধাঁচের ক্রিয়াপদের ব্যবহার। কিংবা ‘মায়া’ গল্পে ‘অনিমেষ’ চরিত্রের মাধ্যমে জোর করেই যেন ধর্মকে টেনে আনা হয়েছে; তার জায়গায় রহিম করিম হলেও গল্পের কোনো হেরফের হতো না। সচেতন পাঠে এমন আরও কিছু খটকা জাগে। লেখকের আগের গল্পগুলোর তুলনায় বেশ কয়েকটা গল্পকে বেশ হালকাও মনে হয়। তবে বই পড়া শেষে এসব মনে থাকে না। বড় হয়ে ওঠে এর সোজা বাক্যে লেখা সরল কথার পেটে জমে থাকা ভাবনাগুলোই। তারাই সঙ্গী হয় পাঠকের; লেখনীর মতোই নির্বিকার ভঙ্গিতে খুলে দেয় নতুন চিন্তার চোখ।