Thank you for trying Sticky AMP!!

হারিয়ে যেতে থাকা অস্তিত্বের বিকল্প আয়না

উধাও, আসিফ নজরুল, প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১৯, ৯৬ পৃষ্ঠা, দাম: ২২০ টাকা।

উপন্যাস দর্শনের বই নয়, ইতিহাসের আকরগ্রন্থ হয়ে ওঠাও এর লক্ষ্য নয়। তবে ভালো উপন্যাসে এই দুই বিষয়ই পাওয়া যায় কখনো কখনো। আসিফ নজরুলের নতুন উপন্যাস উধাও-এর মধ্যেও সমাজের এবং ব্যাপক অর্থ দেশের ইতিহাস ও দর্শনের নানান ‍উপাদান আছে। এর প্রধান চরিত্র বাদল, যার পূর্বপুরুষ পুরান ঢাকার রায়তদের বাড়িতে ধান কুটার কাজ নিয়ে এসেছিলেন, পরে একসময় পুরান ঢাকাতেই স্থায়ী হয়েছিলেন তারা। ধান কুটার কাজ করতেন বলে এই পেশার শ্রমিকদের রায়তেরা কুট্টি বলে ডাকতেন। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে বাদলের ভাষ্য, ‘আশরাফ-আতরাফ আরকি! আশরাফদেরও করুণ পরিণতি হয়েছে শেষে। এখন পুরান ঢাকার আশরাফ-আতরাফ সবাই কুট্টি।’

বাদলের বর্ণনাতেই আমরা জানতে পারি উপন্যাসের কাহিনি। এ আখ্যানের বেশির ভাগই সংঘটিত হয় পুরান ঢাকায়। ফলে পুরান ঢাকাও যেন এখানে একটি চরিত্র!


একদিন আকস্মিকভাবে বকুল নামের এক উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়েকে দেখেই প্রেমে পড়ে যায় বাদল। সে মেয়েটির নাম দেয় ‘বিউটি কুইন’। বাদলের এই প্রেমে পড়া তার জীবনকে খানিকটা বদলেও দেয়। অন্তত বলতে পারি, তার পাল্টে যাওয়াও সেখান থেকেই।

একুশ বছরের বাদল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছে মাত্র দুদিন। মাঝেমধ্যে রহমানের মুরগির দোকানে বসে সে। একদিন রহমানের ক্রেতাদের একজনের বাসায় মুরগি দিতে গিয়ে বাদল আবার বিউটি কুইনের দেখা পায়। জানতে পারে, বিউটি কুইনের আসল নাম বকুল। তার বাবা মারা গেছেন এবং মা মানসিক ভারসাম্যহীন। ফুফাতো ভাই বশির সম্পদের লোভে বকুলদের দেখাশোনা করে।

কাহিনির এ পর্যায়ে বাদলের পরিবারেও ঘটতে থাকে নানা ঘটনা। সেসব ঘটনা জানতে জানতে, পড়তে পড়তে বাদলকে তার পরিবারের বিষয়ে উদাসীন মনে হয়। তবে একসময় পরিবারের প্রতি এই দূরত্বপ্রবণতা সে কাটিয়েও ওঠে, যখন ইয়াকুব কমিশনারের ক্যাডার রকিবুল তার বোনকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে অনেক দিনের জন্য কোথাও নিয়ে যায়।

বাদল আদতে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। শিক্ষা, চাকরি, ক্ষমতাবান পরিবার—কিছুই নেই তার। সে যেন সিসিফাস, বকুলের প্রতি একতরফা প্রেম নিয়ে জীবনের একটা অর্থ পেতে চায়।

কিন্তু এই বাদল একদিন উধাও হয়ে যায়। ‍আর এর সূত্রপাত ঘটে যখন ইয়াকুব কমিশনার বাদলের বন্ধু শফিদের মার্কেট ভেঙে নতুন করে গড়ার প্রস্তাব দেয়। পরবর্তীকালে ইয়াকুব কমিশনার কর্তৃক তাদের মার্কেটে আগুন, বাদলের শফিকে সেই আগুন থেকে উদ্ধার করা এবং তাদের সঙ্গে কমিশনারের অফিসে পাল্টা আগুন দেওয়া—ঘটনার এসব ঘনঘটা উপন্যাসটিকে একটা উত্তুঙ্গ অবস্থানে দাঁড় করায়। কমিশনারের অফিসে আগুন দেওয়ার পরদিনই বাদলকে অপহরণ করে একটা ছোট ঘরে অনেক দিন বন্দী করে রাখা হয়। অপহরণকারীরা তাকে সে বিরোধী দল করে কি না—বারবার এই প্রশ্ন করে। একসময় সেখানে আরেক বন্দী এক মধ্যবয়স্ক মানুষের সঙ্গে দেখা হয় বাদলের। তার কাছ থেকে সে জানতে পারে, বাইরে নাকি তাকে নিয়ে ব্যাপক হইচই হচ্ছে। বাদলকে অপহরণের সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ভয় দেখাতে চেয়েছে। একজনকে উধাও করে দিলে অন্যরা ভয় পেয়ে যায়।’

এরপর একদিন অপহরণকারীরা বাদলকে ছেড়ে দেয়। ছেড়ে দেয় এই শর্তে যে তাদের কথা কাউকে বললেই আবার তাকে ধরে এনে মেরে ফেলা হবে। অবিশ্বাস্য এই মুক্তির আনন্দে অভিভূত হয় বাদল। সে ফিরে আসার পর তার মা হুজুরকে দিয়ে জিনের ঝাড়ফুঁক করান। প্রকৃত সত্য আড়াল করতে মনে মনে সে বলে, জিনই ভালো।

এর মধ্যেই এক শুক্রবারে বকুলের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে—এ কথা জানতে পারে বাদল। অন্যদিকে রকিবুলের কারণে গর্ভবতী হয় তার বোন মিলি। রকিবুলকে ইয়াকুব কমিশনারের মার্কেট উদ্বোধনের দিন ব্যাপক মারধর করে বাদল। মামলা হয় তার নামে। পালিয়ে যায় সে। কিন্তু বকুলের ভাবনা তার পিছু ছাড়ে না। তাই একদিন সে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে পুরান ঢাকায় ফিরে আসে।

তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ফিরে আসার পর বকুলের বিয়ে ভাঙতে যায় না বাদল। সে বলে, ‘না, বকুলের বিয়ে ভাঙতে আমি আসিনি। সেই ক্ষমতা আমার নাই।’ কেননা, তত দিনে উধাও শব্দটির প্রকৃত অর্থ জেনে গেছে সে।

আসিফ নজরুলের বহু অর্থবোধক এই উপন্যাস মানব-মানবীর প্রেমকে ছাপিয়ে উঠে গেছে এমন এক উচ্চতায়, যেখানে মানুষের প্রেমের পরম্পরায় ইতিহাস, রাজনীতি এবং সত্য আর স্বপ্ন জড়িয়ে থাকে প্রবলভাবে।