Thank you for trying Sticky AMP!!

আমার কবিতা মানুষ মনে রাখবে এটা আমি বিশ্বাস করতাম না

পঞ্চাশ-উত্তর বাংলা কবিতার বিশিষ্ট নাম শহীদ কাদরী। আজ এই কবির মৃত্যুদিন। ২০১০ সালে নেওয়া এই কথোপকথনে তিনি বলেছেন কবিতা নিয়ে তাঁর একান্ত ভাবনার কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আদনান সৈয়দ

শহীদ কাদরী (১৪ আগস্ট ১৯৪২—২৮ আগস্ট ২০১৬)।
প্রশ্ন

আপনার মাত্র চারটি কাব্যগ্রন্থ। অন্য কবিদের তুলনায় লিখেছেন অনেক কম। কেন আর লেখেননি?

শহীদ কাদরী: বলতে পারো একধরনের অলসতা। টাকাপয়সার অভাব থেকে আমি কখনোই লিখিনি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমি বড় কবি হব, এটাও আমার মাথায় কখনোই আসত না। আরেকটা বিষয় মনে ভাবতাম যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুধীন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ—এসব বড় কবির পাশে আমি কবিতা লেখার কে?

প্রশ্ন

আপনার কবিতা যে কখনো জনপ্রিয় হবে এবং আপনি যে একজন জনপ্রিয় কবি হবেন, তা কখনো ভাবেননি?

শহীদ: না, কখনোই না। আমার কবিতা মানুষ মনে রাখবে, এটা আমি কখনোই বিশ্বাস করতাম না।

প্রশ্ন

বিউটি বোর্ডিংয়ের একসময়ের সেরা আড্ডাবাজ খালেদ চৌধুরীর ভাষায়, আপনি, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমানসহ অনেকেই কবিতায় নতুন কিছু নিয়ে আসার জন্য দিনরাত ভাবতেন। এত স্বপ্ন দেখার উৎসাহ কোথায় পেতেন?

শহীদ: আমি আমার কথা বলতে পারি, আমাদের বাসায় ভাইয়া প্রচুর পড়াশোনা করতেন। বিশেষত ইংরেজি সাহিত্য। তাঁর পড়াশোনা দেখে আমিও উৎসাহ বোধ করতাম। আরেকটা বিষয় হলো, ভেতর থেকে এক ধরনের তাগিদ কাজ করত এই রকম যে—পড়তে হবে এবং পড়ব। এই বোধ থেকেই প্রচুর পড়তাম। তবে আড্ডাও এর পেছনে কাজ করত। আমাদের আড্ডা হতো শিল্পসাহিত্য নিয়ে। কোনো একটা বিষয় নিয়ে রাতের পর রাত আমাদের আড্ডা হতো। সে করণে প্রচুর পড়াশোনাও করতে হতো আমাদের। টমাস মানের বিখ্যাত উপন্যাস ম্যাজিক মাউনটেইন-এর কথা এখানে উদাহরণ হিসেবে আসতে পারে। ওই বইয়ে পাহাড়ের চূড়ায় একটা নিরাময়কেন্দ্রের কথা আছে, যেখানে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীরা পৃথিবীর সব বন্ধন ছিন্ন করে আসে। এরপর সেখানকার ডাইনিং রুমে রোগীরা সবাই বসে একেকজন একেকটি তত্ত্ব উপস্থাপন করে। আমরাও আড্ডায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্ক জুড়ে দিতাম। তাতে লাভ হতো আমাদেরই। পড়াশোনার জন্য হলেও আড্ডার প্রয়োজন আছে।

প্রশ্ন

কবিতার ক্ষেত্রে ব্যাকরণ মেনে চলাটা কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কী মনে হয় আপনার?

শহীদ: কবিতার ক্ষেত্রে নিজস্ব একটা ব্যাকরণ তো মানতে হবেই। তবে শুধু ব্যাকরণই কি সবকিছু? কবিতাটা হলো কি না, সেটা বিবেচনায় আনতে হবে সব সময়। সে জন্য আমি মনে করি, কবিতার যে নিজস্ব একটা সংগীত আছে, একটা তাল আছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শব্দের যথাযথ ব্যবহার, ছন্দ, মাত্রা, বিষয়বস্তু, তাল—সব মিলিয়েই একটা কবিতা দাঁড়ায়। তবে এ কথা আমি বিশ্বাস করি যে কবিতা হচ্ছে একজন কবির অন্তরাত্মার ফসল। কবির মনোজগৎ তাঁর কবিতায় প্রকাশিত হয়।

প্রশ্ন

মালার্মে কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন যে কবিতা শব্দ দিয়ে লেখা হয়, ভাব দিয়ে নয়। একজন কবির পক্ষে এ কথা মেনে নেওয়া কতটুকু যৌক্তিক?

শহীদ: কবিতা মানেই শব্দ, শব্দের গাঁথুনি আর বিভিন্ন রং-বেরঙের উপমার খেলা। শুধু ভাব বা আইডিয়া দিয়ে কোনো কবিতা হতে পারে না, যদি না সেখানে শব্দকে যথার্থভাবে সুরের সঙ্গে মিশিয়ে উপস্থাপন করা হয়। কবিতার প্রতিটি শব্দের ধ্বনি শ্রুতিমধুর হতে হবে। কবিতার সেই অন্তসার সংগীতকে শুনতে হলে তৈরি করতে হবে সেই রকম একটা কান। কবিতার মূল আবেদন শুধু শব্দ দিয়ে হয় না। অডেনের মতে, আইডিয়া হচ্ছে পেরেকের মতো, যেখানে কবিতা সেই পেরেকে ঝুলে থাকবে। যখন আমরা কোনো বস্তুকে দেখে একাত্মতাবোধ করি, তখনই আমাদের তীব্র নান্দনিক প্রকাশ ঘটে। কবিতা সব সময়ই এমন হতে হবে যে এটা যদি কোনো স্লোগানও হয়, তারপরও যেন কবিতার মতো মনে হয়।

প্রশ্ন

তাহলে আপনি বলছেন যে শুধু শব্দ দিয়েই একটা সুন্দর কবিতা হতে পারে? আইডিয়া বা ভাবনাচিন্তার কি কোনো ভূমিকা নেই?

শহীদ: অবশ্যই আইডিয়ার একটা জায়গা আছে। অনেক বিখ্যাত কবি শব্দের অর্থ প্রকাশের চেয়ে অর্থকে গোপন করার পক্ষপাতী ছিলেন। এলিয়ট মনে করতেন, কবিতার নিগূঢ় অর্থ বের করার দায়িত্ব পাঠকের। কবি কোনোভাবেই কবিতার অর্থ সম্পূর্ণভাবে পাঠকের জন্য উন্মুক্ত করে রাখবেন, এলিয়ট তার পক্ষে ছিলেন না। বরং ভাবতেন, কবিতাটা পাঠকের সামনে ফেলে রাখলে পাঠকই কবিতাটির নিগূঢ় ভেতরের সত্যটাকে বের করে আনবেন।

প্রশ্ন

৩০ বছর হয়ে গেল বাংলাদেশের বাইরে আছেন আপনি। দেশের কথা মনে হলে কেমন লাগে?

শহীদ: যেদিন থেকে দেশ ছেড়েছি, সেদিন থেকেই দেশকে অনুভব করি। আমার এক ভারতীয় ডাক্তার বন্ধু বলতেন, ‘টাকাপয়সা তো অনেক করেছি, কিন্তু রাত হলেই দেশের জন্য কেঁদে কেঁদে বালিশ ভেজাই।’ সত্যি, দেশে অভাব আছে, অনটন আছে, তারপরও দেশ তো দেশই। নিজ দেশের চেয়ে আর কি ভালো দেশ কোথাও আছে? এই আমেরিকাতেও বাংলাদেশের মতো অবিরাম বর্ষা হয়, কিন্তু বাংলাদেশের বর্ষার মতো এত সুন্দর বর্ষা পৃথিবীর আর কোথায় দেখতে পাব? বাংলাদেশের বর্ষা মানেই দেখতে পাই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কাগজের নৌকা পানিতে ভাসাচ্ছে, প্যান্ট গুটিয়ে মানুষজন রাস্তা পার হচ্ছে। এই দৃশ্যগুলো কল্পনা করলে আমার কাছে উৎসবের মতো মনে হয়। বাংলাদেশের আকাশ সুন্দর, বাংলাদেশের বৃষ্টি অনেক বেশি সুন্দর।