Thank you for trying Sticky AMP!!

অলংকরণ

পরবর্তী বসন্তের কথা ভাবা যাক

কেন যে ভাবি নাই পরবর্তী বসন্তের কথা,

সামান্য শোকগ্রস্ত সে

ন্যাড়া ডালগুলো তার কুঁড়ি মেলছে সাধ্যমতো—

এদিক–ওদিক

মাইল মাইল বরফে ও জলে ঝিকিয়ে উঠছে

রোদ—নুহনব

শুকাতে দিয়েছে নৌকা, ক্লোনড পশুপাখি,

হাইব্রিড ধান ও বারুদ!

পরবর্তী বসন্তের কথা ভাবা যাবে তো? নাকি এই ‘নয়া স্বাভাবিক’ দুনিয়ায় আমরা এতই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, ভবিষ্যৎ ইতিমধ্যেই ডিসটোপিয়া হয়ে গেছে! আইসোলেশন, ই-কমার্স আর অনলাইন জীবনব্যবস্থা—সব মিলিয়ে যে জায়গাটুকুতে করোনা আমাদের ঠেলে নিয়ে গেছে, মিশেল ফুকো তাকেই বলেছিলেন ‘হেটেরোটোপিয়া’। তাঁর সময়ে ইন্টারনেট ছিল না। ফলে তিনি হেটেরোটোপিক স্পেইস খুঁজে পেয়েছেন কবরস্থানে, জাহাজে, জেলখানায়, হাসপাতালে কিংবা পতিতালয়ে।

হেটেরোটোপিয়া জিনিসটা কী? ফুকো এ বিষয়ে বিশদ লেখেননি, কিন্তু নানান সময়ে শব্দটি ব্যবহার করেছেন নানান অনুষঙ্গে। তাঁর মতে, হেটেরোটোপিয়া হচ্ছে ‘অন্য’ একটি জায়গা। বোঝাতে গিয়ে আয়নার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন ফুকো। আয়নায় যে ছবি দেখা যায় তা অবাস্তব, ফলে আয়না হচ্ছে ইউটোপিয়া। আয়নার ভেতরে কোনো জায়গা নেই। আবার আয়না হচ্ছে হেটেরোটোপিয়া, কেননা আয়না জিনিসটা নিরেট বাস্তব।

করোনা এমনি একটি হেটেরোটোপিয়ান বাস্তবতা। এর আয়নায় বিম্বিত আমাদের জীবন ভীষণভাবে বেঁকেচুরে গেছে। আমরা ক্রমেই এই বাস্তবতায় নিজেদের মানিয়ে নিয়েছি। কোনো মৃত্যু আজ আমাদের আশ্চর্য করে না। শুরুতে ভীতি ছিল, এখন আমরা নিজেই ভয়ের শরীরে মিশে বিবশ হয়ে গেছি। এই বৈশ্বিক মহামারি গোটা দুনিয়াটাকেই একটা হেটেরোটোপিয়া বানিয়ে নিয়েছে। ফলে, এর ‘অন্যতা’কে প্রতিনিয়ত বুঝে রাখবার জন্য আমাদের সম্মিলিত স্মৃতির ওপর ভীষণ চাপ বেড়ে গেছে। ভয়ের চাপ, জীবিকা হারানোর চাপ আর স্বাভাবিক জীবনের বর্ণমালাগুলোকে মনে রাখবার চাপ—সব মিলিয়ে একটা কঠিন সংগ্রাম। করোনাক্রান্ত মানবসমাজের। এই চাপ আমরা নিতে চাই। কারণ, স্বাভাবিক জীবন যে বিন্দুতে এসে থেমে গিয়েছিল, সেই বিন্দু থেকেই যেন পরবর্তী বসন্তের কথা ভাবা শুরু করতে হবে!

হয়তো এটাই আপনার হেটেরোটোপিয়া থেকে মুক্ত হওয়ার শর্ত। কিন্তু এতখানি প্রিভিলেজ কি জীবন আপনাকে দেবে? আগের জীবন কি আবারও ফেরত পাবেন? সে জীবন ইতিমধ্যেই আপনার হাতছাড়া হয়ে গেছে। সক্রিয় স্মৃতির কবজায় আছে বলে সেই জীবনকে আপনি এখনো লভ্য মনে করছেন। অথচ আপনার সামনে বর্তমান জীবনের সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন: জীবনের চাহিদা মেটাবেন নাকি আইসোলেশনে থাকবেন? চাহিদা মেটাতে গিয়ে আপনাকে রাস্তায় নামতে হয়, উঠতে হয় বাসে, যেতে হয় মিছিলে। দুটো মানসিক উপায়ে আপনি এমনটা করতে পারেন। প্রথমত, অস্বীকারের মাধ্যমে। এই মহামারি আর তার যাবতীয় ক্ষয়ক্ষতির ন্যারেটিভকে বেমালুম অস্বীকার করে আপনার মন। দ্বিতীয়ত, ডিসটোপিয়ার অংশ হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। করোনাকে আপনি তখন আর হেটেরোটোপিয়া ভাবছেন না, অনিবার্য ডিসটোপিয়া মনে করছেন। ফলে শরীরে ভাইরাস বহন না করেও আপনি ক্যারিয়ার। আপনি করোনা-ন্যারেটিভের অংশ হয়ে গেছেন।

না চাইতেই নতুন এক বাস্তবতায় ঢুকে গেছি আমরা—নতুন স্বাভাবিক বাস্তবতা। পরিবর্তিত এই দুনিয়ায় সামনের দিনগুলোতে কীভাবে কাটবে আমাদের জীবন?

গত নয় মাসে বৈশ্বিক জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ এভাবে একটি দৃশ্যমান ডিসটোপিয়ার অংশ হয়ে গেছে। এই নয়া স্বাভাবিক দুনিয়ায় তাঁরা সপ্তাহে তিন দিন অফিস যাচ্ছেন, বেড়াতে যাচ্ছেন, জানাজা কিংবা বিয়েতেও যাচ্ছেন। সামান্য কিছুদিন থমকে থাকা সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান আবার পূর্ণোদ্যমে চালু হয়ে গেল। চালু হয়ে গেল ক্রসফায়ার। নির্বাচনের ঢাকঢোল বাজছে, টেলিসিরিয়ালগুলোর পাত্র–পাত্রীরা মাস্কের আড়ালে আরও মেলোড্রামাটিক হয়ে উঠছে। চলছে ধর্ষণ, চার্জশিট থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে প্রধান আসামি। এগুলো পুরোনো ডিসটোপিয়া, নতুন ডিসটোপিয়ার সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে চলেছে। করোনা একটা ইভেন্ট মাত্র, আমরা আগে থেকেই একটা প্রোফাউন্ড ডিসটোপিয়ার মধ্যে ছিলাম। মাৎস্যন্যায়ের মধ্যেই বেড়ে উঠেছে আমাদের ন্যায়বোধ। করোনা শুধু টোকা দিয়ে বুঝিয়ে দিল সেটা।

কিন্তু পরবর্তী বসন্তের কথা ভাবা যাবে তো? এখনো যথেষ্ট দূরান্বয়ী লাগছে তাকে। সামনে একটা প্রলম্বিত শীতকাল, প্রভূত ভয়ের সঞ্চার করতে করতে এগিয়ে আসছে। সংক্রমণ বাড়বে, ড্রপলেটগুলো শক্তি সঞ্চয় করছে। বিজন শীলের ভিসা নবায়ন হলো না, জাফরুল্লাহ চৌধুরীকেও আর আশার পিদিম হয়ে জ্বলতে দেখছি না। বরং গ্লোব বায়োটেক সংবাদ সম্মেলন করছে। হিউম্যান ট্রায়ালে যেতে চায়!

এই যে প্রভূত আশা আর নিরাশা, ইউটোপিয়া আর ডিসটোপিয়ার মাঝখানে পেন্ডুলামের মতো দুলছে মানবসভ্যতা—এর কারণ ভ্যাকসিন। গোটা পৃথিবীর ছয় শ কোটি লোক দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করছে একটা ভ্যাকসিনের জন্য। ভ্যাকসিন একটা ইউটোপিয়া, ট্রায়াল ফেজে আছে। ইতিমধ্যেই প্রভূত আশার বিনিয়োগ হয়ে গেছে এই আবিষ্কারখানার মধ্যে। যেন কোনো ল্যাবরেটরি ‘ইয়েস’ বলে ফেললেই দুনিয়া থেকে করোনা পালিয়ে যাবে! কে না জানে ব্যাপারটা অত সরলভাবে ঘটবে না। ভ্যাকসিন-বিজ্ঞান যেমন অনিশ্চিত, ভ্যাকসিন-রাজনীতি তার চেয়েও অনিশ্চিত। এক যুগের সাধনায়ও জিকা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার হলো না। আর এদিকে অর্ধেকের বেশি আমেরিকান মনে করেন, তেসরা নভেম্বরের নির্বাচনের আগে করোনার টিকা আবিষ্কৃত না হলে বিনা মূল্যে সেটা পাবেন না তাঁরা। নির্বাচন যেখানে নেই, সেখানে কী হবে?

করোনাময় দুনিয়ায় একটা অদ্ভুত ধরনের সাম্যবাদ এসেছিল। সংক্রমণের বিচারে ধনী–গরিবের ব্যবধান কমে এসেছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গরিব বরং বিস্ময়করভাবে রেয়াত পাচ্ছিল। করোনার আসন্ন ভ্যাকসিন এই সাম্যবাদী হঠকারিতার প্রতিশোধ নেবে। ভ্যাকসিনের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন পৃথিবী ডিসটোপিয়া থেকে মুক্ত হবে, অন্যদিকে আমাদের শ্রেণিবিভক্ত পুরোনো পৃথিবী বিপুল বিক্রমে জেগে উঠবে। বিপুল নিষ্ঠুরতার সঙ্গে সে তার বণ্টনপ্রক্রিয়া সম্পাদন করবে। আসন্ন ভ্যাকসিন-প্রত্যুষে গরিব দেশের ধনীরা কী করবেন? কী করবেন ধনী দেশের গরিবেরা? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যত মধুর গীতই গাক না কেন, পৃথিবীতে করোনার ভ্যাকসিন আসবে ডারউইনের পিঠে চড়ে।

পরবর্তী বসন্তের কথা ভাবতে পারছেন তো? একটা প্রলম্বিত শৈত্যপ্রবাহের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে সে। সারাটা শীতকাল আইসোলেশনে ভ্যাকসিন জপতে জপতে আপনার হাঁপ ধরে যায় যদি? গাড়িবোঝাই জুতা নিয়ে অপেক্ষা করছে একটি লোক। শীতের সন্ধ্যায়। আপনার সামান্য করুণার জন্য। ওর চাকা কাদায় দেবে গেছে ভেবে আপনি যদি সদাশয় হয়ে ওঠেন, বেরোন বাড়ি থেকে, সেই গল্পটার মতো, তখনই সে খপ করে আপনাকে পাকড়াও করে ফেলবে। বলবে, আমি মৃত্যুর দূত, তোর পেছন ঘুরতে ঘুরতে যত জোড়া জুতার তলা ক্ষয়ে গেছে, সবগুলোকে গাড়িবোঝাই করে তোর পেছন পেছন ঘুরছি!