Thank you for trying Sticky AMP!!

কোলাজ: প্রথম আলো

চলে যাচ্ছে ২৩: কতটা শক্তির সঞ্চার হলো

শিল্প–সাহিত্যের সালতামামি হয় না, হলেও তা হয় ব্যক্তির ধারণার ভিত্তিতে, মানের প্রশ্নে ও এর নিষ্পত্তিতে। অর্থনীতি অথবা স্বাস্থ্য খাতে পরিমাণটা মাপা হয়, অঙ্ক আর সংখ্যার হিসাব নানা ছকে ফেলে উন্নতি-অবনতির রেখাচিত্র আঁকা হয়, শিল্প–সাহিত্যে যা অপ্রাসঙ্গিক। ফেব্রুয়ারির মেলায় কয়টা বই বিক্রি হলো অথবা বছরজুড়ে কয়টা চলচ্চিত্র মুক্তি পেল, তার হিসাব পাঠক-দর্শক বাড়া-কমার একটা খতিয়ান দেয় বটে, কিন্তু তাতে সাহিত্য-চলচ্চিত্রের উৎকর্ষ-অনুৎকর্ষের জাব্দা খাতা তৈরি হয় না। তা ছাড়া বিষয় যেখানে সৃজনশীলতা, বারোমাসি খোপে ফেলে তা বিচার করাটা কঠিন।

তারপরও নানা ক্ষেত্রের বছরওয়ারি শুমারি (নাকি সামারি) করার যে চলটা আছে, তার চর্চায় ২০২৩ সালের দিকে নেত্রপাত করার অনুরোধে সাড়া দিতে হলো; এবং আমার নিজস্ব অভিমতের ভিত্তিতে শুমারি-সামারির একটা মুখবন্ধ দেওয়া গেল। আমি নিশ্চিত তরুণ কোনো লেখক-গবেষককে কাজটি করলে আমার ধারণার সঙ্গে তাঁর ধারণার অনেক অমিল হতো। আমি আশাবাদী মানুষ, ভালোটা প্রথমেই চোখে পড়ে। ২০২৩ সালে কয়েকজন তরুণ লেখকের গল্প–উপন্যাস পড়ে আমার মনে হয়েছে, নতুন পথ তৈরি হচ্ছে। নতুন বিষয় খোঁজা হচ্ছে, কেউ কেউ পেয়ে যাচ্ছেন এবং সেগুলো প্রকাশের জন্য শৈলী বা স্টাইলের বৈচিত্র্যও তাঁরা অনুসন্ধান করছেন। জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ হচ্ছে (অপ্রয়োগও), অতিপ্রাকৃতিক, ফ্রয়েডীয় ‘আনক্যানি’র ব্যবহার বাড়ছে। গল্প–উপন্যাস পাঠককে ধরে রাখছে, কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে এখনো বড় কিছু করার চেষ্টা চোখে পড়ছে না। কবিতার ক্ষেত্রে ষাটের বৈচিত্র্য, সত্তর-আশির অথবা শূন্য দশকের একাগ্রতাটা তেমন চোখে পড়েনি। অনেকেই ভালো কবিতা লিখছেন, কয়েকজন (আবারও তরুণেরাই বেশি) চিত্রকল্পে, প্রকাশে নতুনত্ব এনেছেন। কিন্তু অনেক দিন থেকে কবিতাকে ‘গোত্রের ভাষা-ভাবনা বদলে দিতে এসেছি’—এ রকম ঘোষণা দিতে শুনিনি।

দৃশ্যমাধ্যম মন দখল করে নিলে চমকটা গুরুত্ব পায়; মুদ্রিত মাধ্যমের দিনে চমকের বদলে চোখটা থাকত গভীরতায়। দৃশ্যমাধ্যমে অতলস্পর্শী হওয়ার সুযোগটা করে নিয়ে হয়। আমাদের সাহিত্যে দৃশ্যমাধ্যমের প্রভাবটা যেন বাড়ছে, সমস্যাটাও দেখা দিচ্ছে। লিখিত নাট্যসাহিত্যের দিন কি শেষ হয়ে গেল? বছরে কয়টা নাটক মঞ্চায়িত হয়? তবে মাঝেমধ্যে ভালো নাটক মঞ্চে নামছে। উৎকর্ষের চেষ্টাটা জারি আছে, দেখতে পাচ্ছি। সমস্যা হচ্ছে, নাটক মঞ্চায়নের খরচ বাড়ছে, কিন্তু পৃষ্ঠপোষকের সংখ্যা প্রায় শূন্যে। চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদান থাকলে মঞ্চনাটকে কেন থাকবে না! থাকলে ভালো নাটক ঢাকার বাইরেও অনেক হতো।

চলচ্চিত্র দীর্ঘদিন একটা বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে গেছে। ঢালিউডি মারদাঙ্গা ছবি, পারিবারিক ছবি, বিকল্প ধারার ছবি—এ রকম নানা বিভাজনে পড়ে শক্তি ক্ষয় হয়েছে চলচ্চিত্রের। ভালো নির্মাতারা সব সময় সংখ্যায় অল্প, কিন্তু এই কয় বছরে তরুণ নির্মাতা-পরিচালকেরা যে শুধু চমৎকার কিছু চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন, তা নয়; পুরোনো বোঝাপড়াটার একটা ইতিও টেনেছেন। আমি মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আর অমিতাভ রেজার কাজ খুব পছন্দ করি, কিন্তু এই এক–দুই বছরে সেই তালিকায় তরুণ আরও অনেকে জায়গা করে নিলেন। চলচ্চিত্র নিয়ে আমি আশাবাদী। তবে টিভি নাটকের দিন যে এক অর্থে ফুরিয়ে গেল (এখন ঈদের নাটকের আশায় কেউ কি বসে থাক?) তার কী হবে? এখন ওটিটি ইত্যাদি নানা প্ল্যাটফর্মে নাটক হয়, দু–একটা নাটক দেখে মনে হয়েছে, ভবিষ্যৎটা বুঝি এই নতুন মাধ্যমে।

গানের শ্রোতা হিসেবে আমি আনন্দ পাই যখন তরুণেরা (আবার!) চমৎকার সব গান উপহার দেন। কোক স্টুডিও বাংলার গানগুলোই ধরা যাক। কিছু গান তো রীতিমতো সাড়া ফেলেছে। আরও ফেলবে। তরুণ শিল্পীরা চর্চার গুরুত্বটা বোঝেন, হয়তো সাধনারও। ভবিষ্যতে গানের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধি বাড়বে, আমি নিশ্চিত। চিত্রকলায়, ভাস্কর্যেও আমি প্রচুর নতুন কাজ দেখেছি, পুরোনো ‘ইজমের’ চর্চা থেকে শিল্পীরা বেরিয়ে এসে পুরোনোকে নতুন করে দেখছেন, নতুনকে আরও নতুন করে। ঢাকা আর্ট সামিট, এশীয় দ্বিবার্ষিক এবং চারুকলা আর শিল্পকলার প্রদর্শনীগুলো আমাকে আশান্বিত করে।

আমার বিশ্বাস, পারমাণবিক চেইন-রিঅ্যাকশনের জন্য যেমন ‘ক্রিটিক্যাল ম্যাস’–এর প্রয়োজন, তেমনি শিল্পসাহিত্যে আরও বড় কিছু করার জন্য—বৈপ্লবিক না হলেও—প্রয়োজন আবশ্যিক এক শক্তিসমগ্র, মেধা আর একাগ্রতার একটা ঘনত্ব। এটি পরিমাপযোগ্য নয়, তবে এর তেজ টের পাওয়া যায়। আমাদের শিল্পসাহিত্যে এটি আমি তৈরি হতে দেখছি। হয়তো বেঁচে থাকলে তার বিস্ফোরণটা দেখব। তবে আপাতত ওই ঘনত্বের প্রতিফলন যে প্রতিবছরই অল্প অল্প বাড়ছে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। অনেকটা সেই টেকটোনিক প্লেটের মতো। যত সক্রিয় থাকবে, তত মানুষকে জাগিয়ে রাখবে।


সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:কথাসাহিত্যিক; শিল্প সামালোচক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক