Thank you for trying Sticky AMP!!

‘যত বড় পালোয়ান হও, কারেন্টের সাথে মস্তানি করবা না’

‘যত বড় পালোয়ান হও, কারেন্টের সাথে মস্তানি করবা না’—একটা রাইসমিলের বৈদ্যুতিক মিটারবক্সের ময়লা গায়ে কয়লা দিয়ে ভাঙা ভাঙা অক্ষরে লেখা এই উপদেশবাণী ছোটবেলায় পড়েছিলাম।

এর অনেক দিন পরের ঘটনা। একদিন দেখি, দশাসই দেহের এক লোক দাপাদাপি করছেন। চার–পাঁচজন জোরে জোরে তাঁর শরীর ডলে–কষে কলাইশাকের আঁটির মতো দলাইমলাই করছেন। শুনলাম, বাঘের সঙ্গে ফাইট করা দেহের সেই লোক ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে ধমকে সরিয়ে দিয়ে মস্তানি কায়দায় লাইটের হোল্ডারের নাটবল্টু টাইট দিতে গিয়েছিলেন। তারপর কারেন্টের বাড়ি খেয়ে আছাড়িপিছাড়ি করছেন। আর লোকজন তাঁর আধমরা শরীরটাকে এমনভাবে মালিশ করছেন, মনে হচ্ছে এক্ষুনি সেই বিশাল বডি ডেডবডি হয়ে যাবে। সেই লোকের দশা দেখে মিটারবক্সে লেখা বাণীর মর্মার্থ আমার কাছে পানির মতো সোজা হয়ে গিয়েছিল। বুঝেছিলাম, কারেন্টের সঙ্গে মস্তানি চলে না। কারেন্টে ধরা ভূতে ধরার চেয়ে ভয়ের ব্যাপার।

পানির মতো কারেন্ট ওরফে বিদ্যুতেরও দুটো নাম আছে। একটা নাম জীবন, অন্য নাম মরণ। ওয়াসার সাপ্লাই ওয়াটার বন্ধ হয়ে গেলে বোঝা যায় ‘পানির অপর নাম জীবন’। সাঁতার না জানা লোক নদী বা পুকুরে ডুবলে বোঝা যায় ‘পানির অপর নাম মরণ’। আর ঠা ঠা গরমে বিদ্যুৎ না থাকলে এবং কাউকে কারেন্টে কট করলে বিদ্যুতেরও ‘জীবন–মরণ’ নামের মাহাত্ম্য টের পাওয়া যায়। এই মুহূর্তে সারা দেশে চলমান লোডশেডিং পাবলিকের হৃদয়ে যে ব্লাডশেডিং ঘটাচ্ছে, তার তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে।

২.

থার্মোমিটারের পারদ আর মানুষের মেজাজ—এই দুই জিনিস খালি ওঠে আর নামে। ওঠানোর কাজটা করে গরম। নামানোর কাজ করে ঠান্ডা। জ্বরে জরজর বগলের তলের গরমে থার্মোমিটারের পারদ চড়চড় করে চড়ে। জ্বর ছাড়লে শরীর প্রথমে ঘামে, তারপর পারদ তরতর করে নামে। আর ঠা ঠা গরমে নরমসরম লোকেরও মেজাজ চরমে ওঠে; ঠান্ডা না পড়লে নামে না।

ঠান্ডার জন্য ফ্যান–এসির দরকার হয়।

সমস্যা হলো, লাইট যেমন এমনি এমনি জ্বলে না; ফ্যান–এসিও তেমন এমনি এমনি চলে না। তাদের চালাতে হয়। তাদের যিনি চালান, তাঁর নাম বিদ্যুৎ। যে বিদ্যুৎ আসমানে বিনা পয়সায় চমকায়, তা দিয়ে বড়জোর দু–এক খিলি পদ্য লেখা যায়; তা দিয়ে ফ্যান–এসি চলে না। ফ্যান চালানোর বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়। তার জন্য লাগে কয়লা বা ডিজেল কিংবা গ্যাস। এসব আবার জামদানি শাড়ির মতো ‘লোকাল’ জিনিস নয়; এসব বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আমদানিতে ডলার লাগে। ডলার পাঠালে জ্বালানি আসে, না পাঠালে জ্বলুনি আসে।

অনেক দিন পরে ঘরে ঘরে সেই জ্বলুনি এসেছে। ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে। তাই নিয়ে খবরের কাগজে বড় বড় হেডিং হচ্ছে। গরমের চোটে মাঝরাতে কেউ কেউ বিছানা–বেডিং নিয়ে ছাদে ঘুমাচ্ছে। ‘তোমার হাতপাখার বাতাসে’ তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না। কারণ, বাতাস নিজেই ‘গরম হাওয়া’ হয়ে গেছে। গায়ে জামাকাপড় রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। জলে–স্থলে–অন্তরিক্ষে লজ্জা–শরম বিসর্জন দেওয়া গরম। গরমে সেদ্ধ হতে হতে হাবা লোকও নিজেকে ‘সিদ্ধপুরুষ’ ভাবা শুরু করেছে।

এই গরমে গরম লোক তো দূরের কথা, বহু নরম লোকেরও মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। গরম কাটাতে তাঁরা মাথায় পানি ঢালতে গোসলখানায় ঢুকছেন। ঢুকে দেখছেন, কলে পানি নেই। কারণ, কারেন্ট নেই। তাই মোটর ছেড়ে পানি ছাদের ট্যাংকে তোলা যাচ্ছে না। ফেসবুকে দেশবাসী আদার ব্যাপারীর মতো বিভিন্ন মহাদেশ থেকে কয়লার জাহাজ আসার খবর নিচ্ছেন।

গ্রামে লোডশেডিংয়ের দশা এখন মূলত শনির দশা। সেখানে শনি থেকে শুক্র বিদ্যুতের সকাল–সন্ধ্যা হরতাল চলছে। দোকানদার, মুটে–মজুর, চামার–কামারের ব্যবসায় করোনা মহামারি যে লালবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, এই লোডশেডিং সেই বাতি বদল করে ঘন কালো বাতি ধরিয়ে দিয়ে গেছে। চামার–কামারের মতো খামারিরাও দাপাচ্ছেন। গরমের মধ্যে লোডশেডিং হওয়ায় খামারের মুরগি দাপাতে দাপাতে মরে যাচ্ছে। ‘টুকুরটাকুর সদাই বেইচ্যা কয় ট্যাকা কামাই’ করা লোকেরা এখন আলোতে তাকালেও অন্ধকার দেখছেন, আঁধারে তাকালেও অন্ধকার দেখছেন। একেবারে ‘লাভ ইজ ব্লাইন্ড’ টাইপের অন্ধত্বমেশানো ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ অবস্থা তৈরি হয়েছে।

গত কয়েক দিনে গরম হাওয়ায় নরম মাথায় মনে হচ্ছে, ঠা ঠা গরমের মধ্যে কারেন্ট না পেয়ে লোকের মাথা যেভাবে গরম হয়েছে, তাতে তারা নিজেরাই এখন হাজার ভোল্টের ‘কারেন্ট’ হয়ে আছেন। তাঁদের গায়ে লেখা আছে, ‘যত বড় পালোয়ান হও, কারেন্টের সাথে মস্তানি করবা না’। কিন্তু সেই লেখা কি কারেন্টওয়ালারা পড়তে পারছেন?