Thank you for trying Sticky AMP!!

আমার বুবুর নথ

>এ লেখায় আছে এক বোনের কথা। সাদাসিধে এক বোনের গল্প। এমন চেনা কিন্তু অজানা গল্প আমাদের অনেক পরিবারেই আছে।

সহকর্মীটি একরাশ ছবি আমার টেবিলের ওপর মেলে ধরলেন। জাতিসংঘের খ্যাতিমান চিত্রগ্রাহক। কার্যোপলক্ষে কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ ঘুরে এসেছেন। তুলেছেন শ শ ছবি। মূলত প্রতিকৃতি। ভারী সুন্দর ছবিগুলো। কিছু রঙিন, কিছু সাদাকালোয়। আমার দেশের কত মানুষের মুখ। মায়া লাগে, মমতায় আপ্লুত হই এই ভেবে, আমার স্বজন এরা। আমার শিকড় এখানে। এখান থেকেই আমি এসেছি। আস্তে করে ছবিগুলোয় হাত বুলোই। যেন ছুঁচ্ছি আমার দেশকে, স্পর্শ করছি স্বজনদের।

ছবিগুলো দেখতে দেখতে একটা ছবিতে এসে চোখ আটকে যায় আমার। ২০ থেকে ২১ বছরের এক গ্রাম্যবালার ছবি। একটু পাশ ফেরানো ভারী কমনীয় মুখটি। ডুরে শাড়ির আঁচলে হালকা ঘোমটায় ঢাকা ঘনকৃষ্ণ কেশ। কাজলকালো চোখ আর ঠোঁটের লাজুক হাসিটি তাকে আরও মোহনীয় করে তুলেছে। আর সবচেয়ে যা আমার দৃষ্টি কেড়েছে, তা হচ্ছে তার নথটি। আলো পড়ে চিকচিক করছে তার নাকের নথটি। দ্যুতি ছড়াচ্ছে যেন।

আমার ভাবান্তর দেখে একটু অবাক গলায় সহকর্মীটি জিজ্ঞেস করলেন, ‘চেনো একে?’ উত্তর দিলাম ‘না।’ না, চিনি না এই মেয়েটিকে। কিন্তু দেখেছি আর জানতাম এর মতো আরেকজনকে—হালিমা বুবু, আমার বড় চাচাতো বোন। একেবারে এক চেহারা, এক শাড়ি, এক ঘোমটা আর এক নথ। এ কেমন করে হয়?

আমার বাবা আমাদের পরিবারে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছেন, সর্বোচ্চ সনদ পেয়েছেন। তারপর শিক্ষকতা শুরু করেছেন বরিশাল শহরে। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা সব শহরেই—সর্ব অর্থেই আমরা শহরবাসী। কিন্তু চাচা-ফুপু, তার বাইরের বৃহত্তর পরিবারের সবাই থাকতেন আমাদের পিতৃপুরুষের নোয়াখালীর ভিটেতে।

ছুটিছাটাতে প্রায়ই চলে যেতাম গ্রামের বাড়িতে। তারপর শীতের পিঠে, সবাই মিলে হইহল্লা, পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা, নদীতে সাঁতার, খেত থেকে জালি শসা চুরি—স্বাধীনতা আর আনন্দের সব নির্যাসটুকুই তো শুষে নিয়েছি। ভর দুপুরে কাকি বেরোতে দিতেন না। অসুবিধে নেই, বাসা থেকে নিয়ে আসা গল্পের বই পড়ো।

তখন সারা সকাল-দুপুরের অনেক কাজ সেরে হালকা পায়ে আসতেন হালিমা বুবু। মুখে সেই অভ্রান্ত লাজুক হাসি, ঘোমটায় হ্রস্বতা, নথের দুলুনি। টেবিল ধরে দাঁড়িয়ে আমার বইপত্র ওল্টাতেন, নাড়াচাড়া করতেন খাতা-পেনসিল, জানতে চাইতেন স্কুলের গল্প। বাড়িয়ে-ঝাড়িয়ে, আনিয়ে-বানিয়ে কতশত গল্প বলতাম। কী যে তৃষিত চোখে শুনতেন আমার সেসব আবোল-তাবোল কথা। এখন বুঝতে পারি পড়ার বড় শখ ছিল বুবুর। কিন্তু গ্রামে সে সময়ে সম্ভব ছিল না। থাকতে পারতেন না বেশিক্ষণ আমার কাছে, তখনই ভেসে আসত কাকির গলা, ‘হালু, ধানগুন তুইলসতনি, ঝড়ি আইয়ের।’