Thank you for trying Sticky AMP!!

কঠিন যোদ্ধার নাম

বাবা এক কঠিন যোদ্ধার নাম। যে যোদ্ধা শত কষ্টের পরও একাই তাঁর পরিবারকে ঠেলে নিয়ে চলেন। কিন্তু পরিবারের বাকিদের কখনোই বুঝতে দিতে চান না যে তাঁর কষ্ট হচ্ছে। বাবারা একেকটি পরিবারের বটবৃক্ষ, যাঁরা কিনা বছরের পর বছর পরিবারের সদস্যদের আগলে রাখেন সব বিপদ-আপদ থেকে। এই বটবৃক্ষের ছায়াতেই তো আমরা বাঁচি।

আমি ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে একটু বেশিই মিশতাম। ফলে ভালোবাসার পরিমাণটাও বাবার দিকেই বেশি থাকতে স্বাভাবিকভাবেই।

এখনো মনে পড়ে, ছোটবেলায় (তখনো স্কুলে যাইনি) রোজ বাবার বাজার থেকে ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকতাম। বাবাকে যে বাজার থেকে কিছু না কিছু আনতেই হবে। ছোটবেলা থেকেই এই চাহিদাটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে পড়ে। কী নিয়ে আসতেন, কখনোই সেটা বড় বিষয় ছিল না আমার কাছে কিংবা কখনো বাবার আনা কোনো জিনিস নিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকিনি। একেক দিন একেক রকম খাবার জিনিস নিয়ে আসতেন বাবা। কলা, কমলা, আপেল, কেক, জুস থেকে শুরু করে বহু খাদ্যদ্রব্য ছিল সেই তালিকায়। বাবা যখন ফিরতেন, এখনো স্পষ্ট মনে আছে, বাবা এসে ফ্রেশ হওয়ার আগেই আমার জন্য আনা খাবারটি আমাকে খাইয়ে দিতেন।

বাবার আরেকটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। আমি কখনো পড়া না পারলে হয়তো তিনি বকা দিতেন কিংবা মাইর! ফলে আমি প্রায়ই কেঁদে বইয়ের পৃষ্ঠা পানিতে ভাসিয়ে দিতাম। যত দীর্ঘস্থায়ী হতো কান্না, বাবার তত মন ব্যাকুল হয়ে উঠত আমার জন্য। তখনই এসে তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কী জানি মন্ত্রের মতো কিছু একটা পড়া শুরু করতেন! স্পষ্ট মনে না থাকলেও মন্ত্রটা এ রকম ছিল কিছুটা, ‘হিরিং বিরিং তিরিং...’। বাবার সেই হাত বোলানো মন্ত্র শুনে আমার মন ভালো হয়ে যেত। কান্না বন্ধ করে আমি আবার পড়ায় মনোনিবেশ করতাম। এটা আমার কাছে এখনো অদ্ভুত এক শক্তি মনে হয়।

প্রতিবছর দুর্গাপূজার সময় সবাই মিলে শপিং করতে যেতাম। আগের রাতে বাবা সবার জন্য লিস্ট করে দিতেন। কার কী লাগবে, তার একটা বাজেট তৈরি করতেন তিনি। লিস্ট অনুযায়ী সবাই সবার নির্ধারিত জামাকাপড়, জুতা, ঘড়ি কিনে নিতাম। ওই লিস্টে কোনো বছরই বাবার নামের অপশনটা থাকত না। সব সময়ই বলতেন, ‘আমার অনেকগুলো শার্ট আলমারিতে পড়ে আছে। জুতা জোড়াও সবেমাত্র কিনেছি!’ কিন্তু নতুনের আনন্দ তো কেবলই নতুন জিনিস দ্বারাই মেটানো সম্ভব। তাই একপ্রকার জোরাজুরি করে আমরা সবাই মিলে বাবার জন্য একটা ভালো শার্ট কিনতাম।

কাপড় কেনা শেষে আমরা ভালো একটা রেস্টুরেন্টে খেতে বসতাম। তখনো বাবা আমাদের সবাইকে দই-মিষ্টি কিংবা বিরিয়ানি খাওয়াতেন। নিজে হয়তো খেতে ভালো লাগছে না বলে চা খেয়ে নিতেন! চা খাওয়ার পর ভালো করে একটা পান গুঁজে দিতেন মুখে। কারণ, পান বাবার অনেক প্রিয়।

>বাবা কখনোই আমাকে ভালোবাসি বলেননি। কারণ, জানি, বাবা ভালোবাসি কথাটা বলতে জানেন না, করতে জানেন। আমিও বাবাকে জড়িয়ে ধরে কখনোই বলিনি, ‘ভালোবাসি, বাবা।’ কিন্তু আমি তো জানি আমি বাবাকে কতটা ভালোবাসি।

এত সব গল্পের ভিড়ে আজ আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। বাড়ি থেকে দূরের একটি শহরে এখনো পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করানোর বদৌলতে হাতে অল্প কিছু টাকা আসা শুরু করল। নিজের রোজগার করা টাকা থেকে বাবাকে কিছু একটা দেওয়ার খুব ইচ্ছা করত। ও রকম ঘটা করে বাবাকে কোনো কিছুই দিতে পারিনি এখনো! কিন্তু শেষ দুর্গাপূজায় আমি আমার নিজের রোজগার করা টাকা দিয়ে বাবাকে একটা সুন্দর ওয়ালেট উপহার দিই। এখন যখন বাবাকে কলেজ থেকে বাড়িতে ফেরার পর পকেট থেকে আমার দেওয়া ওই ওয়ালেটটি বের করতে দেখি, কী যে এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে নিজের মনের ভেতর! ওয়ালেটটির দাম খুব বেশি ছিল না! ৫০০ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু এই ৫০০ টাকা আমাকে যে সুখ এনে দিয়েছে, সেটা ৫০ হাজার টাকায়ও হয়তো আসবে না!

আমার বাবা হয়তো নানান সময়ে নানান কিছু কারণে বিভিন্ন লোকের কাছে কিপটে লোক হয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু আমাদের দুই ভাইয়ের কাছে তিনি সব সময়ই বেহিসেবি।

বাবা কখনোই আমাকে ভালোবাসি বলেননি। কারণ, জানি, বাবা ভালোবাসি কথাটা বলতে জানেন না, করতে জানেন। আমিও বাবাকে জড়িয়ে ধরে কখনোই বলিনি, ‘ভালোবাসি, বাবা।’ কিন্তু আমি তো জানি আমি বাবাকে কতটা ভালোবাসি।

পৃথিবীর সব বাবাই এ রকম নিঃস্বার্থভাবে সংগ্রাম করে চলেছেন, যাতে আমরা ছেলেমেয়েরা ভালো থাকি। তাই হয়তো বলা হয়ে থাকে, ‘পৃথিবীর সব পুরুষ খারাপ, সব জন্মদাতা খারাপ, কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই।’

প্রচার সম্পাদক, সিলেট বন্ধুসভা।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com