Thank you for trying Sticky AMP!!

খোন্দকার আশরাফ হোসেন ছিলেন সময়ের দুর্দান্ত সারথি

খোন্দকার আশরাফ হোসেন

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী খোন্দকার আশরাফ হোসেন ছিলেন একাধারে আধুনিক ও ঐতিহ্যমগ্ন কবি, মননশীল প্রাবন্ধিক, অনুসন্ধানী গবেষক, সৃজনশীল অনুবাদক, যুগন্ধর সাহিত্য সম্পাদক, প্রবাদতুল্য শিক্ষক এবং প্রতিবাদী চরিত্র হিসেবে বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিভা। ছিলেন প্রগতিমনস্ক, অসাম্প্রদায়িক, প্রতিবাদী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী ও আধুনিক চেতনার একজন পরিশীলিত মানুষ।

কবিতা ও নন্দনতত্ত্বের ছোটকাগজ ‘একবিংশ’ সম্পাদনার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যমহলে খোন্দকার আশরাফ হোসেন বিশেষ মর্যাদা পেয়েছিলেন। ‘একবিংশ’-এ প্রকাশিত আধুনিকতা ও উত্তর-আধুনিকতাবিষয়ক সমকালীন চিন্তাপ্রবাহ নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ ও অনুবাদ সমালোচক ও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ জন্য সমসাময়িক সাহিত্যমহলে উভয় বাংলায় কাগজটি সমাদৃত হয়। 

ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে বেশ খানিকটা বিলম্বে খোন্দকার আশরাফ হোসেন বাংলাদেশের কবিতার জগতে প্রবেশ করেন আশির দশকে। মধ্য আশিতে প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘তিন রমণীর ক্বাসিদা’ এবং ‘পার্থ তোমার তীব্র তীর’ দুই বাংলার কবি ও সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিষয়ের বিবেচনায় ও আঙ্গিকের নবায়নে উভয় দিক থেকেই তিনি বাংলাদেশের কবিতায় ষাট-সত্তর দশক এবং আশি-নব্বই দশকের সংযোগ সেতু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ১৯৮৫ সাল থেকে তাঁর সম্পাদিত ‘একবিংশ’ তাঁকে সময়ের তরুণ কবিদের একজন বন্ধু ও সহগামী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। আধুনিকতা থেকে ক্রমে উত্তরাধুনিকতার কুহকী চত্বরে যাত্রার পথে তিনি নিজের কবিতার বিষয় ও ভাষাকে পরিবর্তন করেছেন। ১৯৮৪ সালে কবিতার যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি তারুণ্যের ধর্ম বজায় রেখে কবিতায় নিরীক্ষা চালিয়ে গেছেন। মিথের নতুন ভাষ্য বিনির্মাণ এবং নতুন বাক্যবিন্যাস তাঁর কবিতা তখনকার বাংলাদেশের কবিতার ধারায় নতুন মাত্রা সংযোজন করেছিল। তৎসম ও দেশি শব্দের পাশে আরবি-ফারসি, ইংরেজি শব্দ জুড়ে দিয়ে তাঁর নিজের স্বকীয় কাব্যভাষা নির্মাণ করেন। বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই সাবলীল এবং শক্তিমান লেখকের সংখ্যা খুব বেশি নেই আমাদের। এদিক থেকেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ। ‘জীবনের সমান চুমুক’, ‘সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর’, ‘যমুনাপর্ব’, ‘জন্মবাউল’, ‘তোমার নামে বৃষ্টি নামে’, ‘(আয়)না দেখে অন্ধ মানুষ’ এবং ‘কুয়াশার মুশায়েরা’ তাঁর মৌলিক কবিতার বই। ১৯৮৭ সালেই তিনি পেয়ে যান ‘আলাওল পুরস্কার। এ ছাড়া ‘ব্রহ্মপুত্র পদক’, কলকাতা থেকে লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার, ‘জীবনানন্দ পুরস্কার’সহ বিভিন্ন সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মাননা পেয়েছেন।

একাত্তরের রণাঙ্গনের একজন সশস্ত্র গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এসেছে তাঁর কবিতায়। ‘বাউসি ব্রিজ’ ৭১’, ‘সাহেবালী যুদ্ধে গিয়েছিলো’ এবং ‘নোটনের জন্য শোক’-এসব কবিতা মুক্তিযুদ্ধে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর বহন করে।

খোন্দকার আশরাফ হোসেন

সমসাময়িক বৈশ্বিক কবিতা ও সাহিত্যতত্ত্বের অনুবাদ বাংলাদেশের সাহিত্যে তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান। তাঁর সম্পাদিত ‘একবিংশ’র বিভিন্ন সংখ্যায় তিনি এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকার একেবারে হালের কবিতা ও কাব্য আন্দোলনের অনুবাদ উপস্থিত করেছেন এবং অন্য অনেককে দিয়ে সমকালীন বিশ্বসাহিত্যের তাত্ত্বিক প্রবন্ধ ও নতুন ধারার কবিতার অনুবাদ করিয়ে প্রকাশ করেছেন। তাঁর ‘বিশ্বকবিতার সোনালি শস্য’ অনুবাদ গ্রন্থটি সমকালীন বৈশ্বিক কবিতার একটি উল্লেখযোগ্য সংকলন। ‘একবিংশ’র বিভিন্ন সংখ্যায় পোস্টমডার্নিজম বা উত্তরাধুনিকতা নিয়ে লেখা প্রকাশের মাধ্যমে এই ধারণাগুলোর স্পষ্টায়নেও কাজ করে গেছেন তিনি।

অনুবাদে সিদ্ধহস্ত খোন্দকার আশরাফ হোসেন ১৯৮৬ সালেই তিনটি ধ্রুপদি গ্রিক নাটক সফোক্লিসের ‘রাজা ইদিপাস’ এবং ইউরিপিদিসের ‘মিডিয়া’ ও ‘আলসেস্টিস’ অনুবাদ করেন। ‘টেরি ইগলটনের সাহিত্যতত্ত্ব’, ‘ডেভিড অ্যাবারক্রম্বির সাধারণ ধ্বনিতত্ত্ব’, ‘ইউরিপিডিসের আলসেস্টিস’ ও ‘পাউল সেলানের কবিতা’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য অনুবাদগ্রন্থ।‘মডার্নিজম অ্যান্ড বিয়ন্ড: ওয়ের্স্টান ইনফ্লুয়েন্স ওন বাংলাদেশি পোয়েট্রি’ শিরোনামে তিনি যে পিএইচডি গবেষণাটি করে গেছেন, তাও ইংরেজি ভাষায় বাংলাদেশের কবিতার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হিসেবে উল্লেখের দাবি রাখে।

কবিতাচর্চার পাশাপাশি তিনি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখেছেন: রোমান্টিক কবিতা আন্দোলন নিয়ে তাঁর বই ‘রোমান্টিক কবিতার অক্ষদ্রাঘিমা’ কবিতাকর্মীদের কাছে ব্যাপক সমাদৃত। বাংলাদেশের আধুনিকবাদী প্রধান কবিদের নিয়ে মূল্যায়নধর্মী সমালোচনার উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে আছে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘বাংলাদেশের কবিতা: অন্তরঙ্গ অবলোকন’ বইটি। এই বইটি একই সঙ্গে একাডেমিক ও সৃষ্টিশীল ধারার।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্যে তাঁর অবদান অসামান্য। কিন্তু জাতীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেও তিনি তাঁর যোগ্য মর্যাদা পাননি। এমনকি, আমরণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখলেও তিনি উদাসীনতার শিকার হয়েছেন। সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কবি, অসামান্য বিশ্লেষণধর্মী প্রাবন্ধিক ও সমসাময়িক বিশ্বের নতুন ধারার সাহিত্যতত্ত্ব ও কবিতার সৃজনশীল অনুবাদক হয়েও  বাংলা একাডেমি পুরস্কার কিংবা জাতীয় কোনো পুরস্কারে ভূষিত হননি তিনি—এটা আমাদের জন্য ভীষণ আক্ষেপের বিষয়।

কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ৪২ দিনের মাথায় প্রায় আকস্মিকভাবেই ২০১৩ সালের ১৬ জুন তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একজন প্রতিভাবান দ্রোহী ও বহু বিষয়ে বিদ্বান একজন ব্যক্তিত্বকে হারায়। গতকাল ছিল তাঁর প্রয়াণদিবস। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com