Thank you for trying Sticky AMP!!

তরুণ সংগ্রামী থেকে বুদ্ধিজীবী-মনীষী

আনিসুজ্জামান

সমসাময়িক তো বটেই! ১৯৫১ সালে প্রবেশিকা, ১৯৫৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক একসঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেন। আমার ক্ষেত্রে ঢাকা আগমন ঘটল এক বছর পর। দুই–দুইবার টাইফয়েড আক্রান্ত হয়ে এই দুর্দশা। পুরোনো বন্ধু নুরুল আলম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সহপাঠী আনিসুজ্জামান, ওয়াহিদুল্লাহ, জহুরুল হক ও চেমন আরার সঙ্গে। তরুণ সংগ্রামীরূপে উদীয়মান তারকা আনিসুজ্জামান, বিভাগীয় অধ্যক্ষ হাই সাহেবের যেমন প্রিয়, তেমনি সাংস্কৃতিক দলপতি হাসান হাফিজুর রহমানের একান্ত আপনজন। ১৯৫৪ সালের এক শিক্ষকের বিদায় সংবর্ধনার ছবিতে ঘটনাচক্রে আমিও তাঁর সঙ্গে পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে। পরিচয় একটু ঘনিষ্ঠা হলো কয়েক মাস পর থেকে, কয়েকবার সওগাত অফিসে সাহিত্যসভায় যোগদানের কারণে।

১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘটল ভাষা আন্দোলনের শেষ ছাত্রবিক্ষোভ। ১৯৫২ সালের আন্দোলনের হিরোদের মধ্যে অন্যতম 'আনিস ভাই'। আমি বরাবর তাঁকে এই নামে সম্বোধন করে আসছি। তিনি কিন্তু আমাকে শুধু 'কোরেশী' অথবা চট্টগ্রামপর্বে 'মঁসিয়' নামেই অভিহিত করতেন। আমার স্ত্রী পারিবারিকসূত্রে তাঁকে 'আনিস চাচা' আর ভাবীকে 'চাচী' বলেই ডাকেন। ১৯৭৬–৭৭ সালে ভাবী আমার ফরাসি কোর্সের মনোযোগী ছাত্রী ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় পারিবারিক সূত্র থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম বিদেশ গমনের ফলে। কিছুদিন পর তিনি মার্কিন মুল্লুকে গেলে আমি ফরাসি দেশে তাঁর খবর পেতে থাকলাম অর্থনীতিবিদ মোজাফফর আহমদের মারফতে।

১৯৬৫ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভের পর একবার দেশে ফিরে আনিস ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভবনে তাঁর কক্ষে বসে বহুক্ষণ দুজনের গবেষণা–ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা হলো। লক্ষ্য করলাম, সেই হ্যাংলা তরুণ সংগ্রামী আর নেই, ড. আনিসুজ্জামান এখন ভারিক্কি বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষক। আরও ক' বছর পর ১৯৬৯–১৯৭৮ আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকর্মী হয়ে গেলাম। তবে আমি তখনো সহকারী অধ্যাপক, আর তিনি সহযোগী অধ্যাপক। তাই পূর্বের মতো আমি তাঁকে 'অগ্রজপ্রতিম' মর্যাদায় অভিষিক্ত রাখলাম। তাঁর প্রথম দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের জন্য আমার প্যারিস থেকে আনীত কনভার্টিবলে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম।

আমরা বিভাগীয় ও বাইরের নানা কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখলাম। খুব কাছাকাছি সময়ে তার ওপর দুটো দায়িত্ব পড়ল। বড় আকারে নজরুল সেমিনার আয়োজন। ঢাকা থেকে কবীর চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, মনিরউদ্দিন ইউসুফ, রাজশাহী থেকে আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও আরো ক'জন যোগ দিলেন তাতে। এরপর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দেশে ফিরলে তাকে সংবর্ধনা জানানোর কাজ। আমি সৈয়দকে নিয়ে ঘোরাফেরায় লিপ্ত।

পরে মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রমে আমরা আত্মনিয়োগ করলাম। আগরতলা থেকে দশ মাইল দূরে একটি ছাত্র হোস্টেলে আমরা পাশাপাশি কক্ষে মাসাধিক ছিলাম। প্রায়ই আমার কক্ষে পরামর্শ–সভা বসত। একসঙ্গে একবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। তারপর কলকাতায় এসে অন্য ধরনের কর্মকাণ্ড। তিনি তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি প্রতিষ্ঠার সভায় আমিও ছিলাম। আনিস ভাই সাধারণ সম্পাদক হলেন। কিছুদিন পর আমাকে কূটনৈতিক দায়িত্বে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো হলো। তিনমাস পর ফিরে এসে আর্কাইভস, বিদেশী সাংবাদিকদের ও আমেরিকান শিক্ষক সাহায্য সংস্থার কাজকর্মে আমরা জড়িয়ে থাকলাম।

যুবা বয়সে আনিসুজ্জামান

এক পর্যায়ে তার ফুফুর বাসায় আমরা বেড়াতে গেলে তিনি প্রস্তাব করলেন, আমার অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হলে নিঃসংকোচে যেন যেকোনো সময়ে ফোন করি। তিনি গাড়িতে দিয়ে আসবেন। ১ ডিসেম্বর ১৯৭১ রাত ২টার দিকে ফোন করে তাঁকে জাগ্রত পেলাম। সমস্যার কথা শুনে রাত তিনটার সময় তিনি আমাদের গোবরা রোড থেকে পার্ক স্ট্রিটে ডা. আনোয়ারার ক্লিনিকে নিয়ে গেলেন এবং স্ত্রীকে রেখে বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন।

সদ্যমুক্ত বাংলাদেশে ফিরে নবোদ্যমে নতুন সিলেবাস বানিয়ে আমরা ডিসেম্বরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়নের কাজে লেগে পড়লাম। কিন্তু তার ওপর পড়ল নানা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব—সংবিধান, শিক্ষা কমিশন ইত্যাদি। এর ওপর বিদেশ যাত্রা, গবেষণা। যোগাযোগ হলো প্যারিসের গবেষণা–জগতের সঙ্গে—জাতীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্র, ইউনেসকো, দক্ষিণ এশীয় গবেষণা কেন্দ্র, ড. ফ্রাঁস ভট্টাচার্য, মিসেস আন্‌মারী ওয়ালীউল্লাহ্‌ প্রমুখের সঙ্গে। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে হলো কর্মঘনিষ্ঠতা ও প্রকাশনার সুযোগ। আনিস ভাই আর আমাদের বাংলাদেশী পণ্ডিত–গবেষক থাকলেন না, হয়ে গেলেন একজন আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবী গ্রন্থকার।

মনে পড়ে, নানা ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি বন্ধু–বান্ধবদের খোঁজ খবর নেন। কীভাবে একবার রাজশাহীতে আমি তাঁর চিঠি পেলাম কলকাতা থেকে। আমাদের প্যারিসের বন্ধু, মুক্তিযুদ্ধে সার্বক্ষণিক স্বেচ্ছাসেবক ড. ইন্দানী রায় মারা গেছেন এবং সে খবরটা যেন ঢাকায় ড. ওয়াহিদউল্লাহকে আমি জানাই।

জীবিতকালে শেষদিন অবধি কী প্রাণবন্ত মানুষটি ছিলেন! বিগত এক বছরের মধ্যে আল মাহমুদ স্মরণসভায় এবং মনিরুদ্দিন ইউসুফ শতবর্ষ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে আমরা দুজন পাশাপাশি মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলাম। কিছুক্ষণ পর পরই তাঁর পর্যবেক্ষণের সুরসিক উপস্থাপনা আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছিল।

সম্প্রতি এই ২৫ ফেব্রুয়ারি আমি সস্ত্রীক দীর্ঘক্ষণ আনিস ভাই আর ভাবীর আতিথেয়তার বলয়ে ছিলাম। কথা ছিল, শিগগিরই আবার দেখা হবে। কিন্তু তার আগেই তিনি চলে গেলেন। তাঁর অমর আত্মা শান্তি লাভ করুক।