Thank you for trying Sticky AMP!!

নজরুলের দুই নারী

নার্গিস

এক নারীকে দীর্ঘ ১৭ বছর অপেক্ষায় রেখেছিলেন কবি নজরুল। গ্রাম্য কিশোরীটি এই দুর্বহ প্রতীক্ষার মধ্যেই দীর্ঘকাল কাটিয়ে পরিণত নারী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা পায়নি। শ্রাবণ মাসে (১৯২১ সাল) ফিরে আসবেন বলে সেই যে গিয়েছিলেন, জীবনে কত 'শাওন আসিল ফিরে, সে ফিরে এল না।' প্রথম প্রণয়িনীর সঙ্গে নজরুলের সম্পর্কটি এ রকমই এক অপূর্ণতার হাহাকারে ভরা।

স্কুলজীবনের কোনো এক অনুষ্ঠানে 'নার্গিসকে লেখা নজরুলের চিঠি'র আবৃত্তি শুনে এই নারীকে নিয়ে কৌতূহল জেগেছিল মনে। তা আর নিবৃত্ত হয়নি তখন। সেই সুযোগও হয়নি। কবি নজরুলের জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে কম-বেশি ধারণা পাওয়া হয়তো সহজ, কিন্তু নার্গিস নামের এক অখ্যাত তরুণীকে চেনাবে কে? বহুকাল পরে, ওই যে সংখ্যাটা, ১৭, এই ১৭ বছর অপেক্ষার পেছনে এক নারীর জীবনের কতটা প্রেম, কতটা ত্যাগ, ক্ষয়ে ক্ষয়ে উজ্জ্বল আর পুড়ে পুড়ে সোনা হয়ে ওঠার ইতিহাস লুকিয়ে আছে, সেটা খুঁজতে গিয়েই পরে 'নার্গিস' নামে উপন্যাস রচনা করি। 

তবে ব্যাপারটা এমন ছিল না যে নার্গিসের জীবনী লিপিবদ্ধ হয়ে আছে কোথাও। থাকার কথাও না। কেন থাকবে, তাঁর তো আলাদা পরিচয়ে নিজেকে চেনানোর সামর্থ্য ছিল না। তাই তাঁকে চিনতে হয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনীর একটিমাত্র অধ্যায় থেকে। সেই অধ্যায়টি আবার রচিত হয়েছে নানাজনের হাতে নানাভাবে। নজরুলের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ ও অভিভাবক মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের বয়ানে নজরুল-নার্গিস সম্পর্ক একটি ষড়যন্ত্রের ফসল। নার্গিসের মামা আলী আকবর খান গভীর অভিসন্ধির অংশ হিসেবে নজরুলকে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর বাড়ি কুমিল্লার দৌলতপুর গ্রামে। সেখানে আলী আকবরের বিধবা বোনের মেয়ে সৈয়দা খাতুনের, যার নাম পাল্টে নজরুলই ডেকেছিলেন নার্গিস, সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কটিও সেই দুরভিসন্ধিরই বাস্তবায়ন।
মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের এই নির্মম সাক্ষ্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছেন দেশের অনেক বিজ্ঞ নজরুল গবেষক। রফিকুল ইসলাম, জিয়াদ আলী, হায়াৎ মামুদ থেকে শান্তনু কায়সার পর্যন্ত সবাই মুজফ্‌ফরের সঙ্গে সহমত।
কেন? কী কারণে এ রকম একটি পরিকল্পনা ফাঁদলেন নার্গিসের মামা আলী আকবর খান? কেন বাড়িতে ডেকে এনে তাঁকে ভাগনির সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার এই মতলব? কারণ, তাঁদের মতে, নজরুল 'সোনার ডিম পাড়া হাঁস।' তাঁকে নিজের কবজায় রেখে তাঁর বই প্রকাশের একচ্ছত্র অধিকার নিয়ে বিত্তবান হওয়ার ফন্দি ছিল আলী আকবরের মনে। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের 'কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা' গ্রন্থটি প্রকাশের পর থেকে নজরুল জীবনীর এক খলনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেন আলী আকবর। কিন্তু এ প্রশ্ন তখন কেউ তুলল না, নজরুল দেশজোড়া খ্যাতিমান বটে, নজরুলকে নিয়ে আবেগের জোয়ারে ভেসে যাওয়া ভক্ত-অনুরক্ত মানুষের ভিড়ে প্রকৃত পাঠক কজন? নজরুলের বই প্রকাশ করে রাতারাতি ধনী হওয়ার পরিকল্পনা আলী আকবরের মনে আসবে কেন? বই বিক্রি থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন কি নজরুলের জীবনে আদৌ ঘটেছিল? তাঁর পেছনের প্রকাশকেরা সারি বেঁধে অপেক্ষা করতেন, এমন কোনো তথ্যও তো ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যায় না। বরং এক-দুই শ টাকার বিনিময়ে বইয়ের স্বত্ব বিক্রি করার জন্য নজরুল দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, এই নির্মম বাস্তবতাই তো বিভিন্ন জীবনী গ্রন্থ থেকে পাই।
আসলে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকেই আলী আকবর চরিত্রটিকে এমন খলনায়ক হিসেবে এঁকেছেন মুজফ্‌ফর। নানা ঘটনার অনুষঙ্গে নজরুল-নার্গিসের মধ্যে চিরবিরহের সম্পর্কটিরও পেছনে আছে এই বিদ্বেষ। আর কুমিল্লার সেনগুপ্ত পরিবারের ইন্ধনও তাতে যুক্ত হয়েছিল কি না, এই সংশয় তো আছেই।
নার্গিসের ঠিকুজি খুঁজতে গিয়ে পেলাম মাঠপর্যায়ের কিছু লেখক ও গবেষকের লেখা, যাঁদের সেই অর্থে লেখক হিসেবে তেমন যশ, খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা নেই, কিন্তু তাঁরা অনেক আন্তরিক। ওই অঞ্চলের (কুমিল্লা) বাসিন্দা বলে তাঁদের সংগৃহীত তথ্যও অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য।
'নার্গিস' উপন্যাসটি লিখি ২০১৪ সালে। এর মধ্যে ষষ্ঠ মুদ্রণ প্রকাশিত হয়েছে। সন্দেহ নেই, আমাদের জাতীয় কবির জীবন নিয়ে পাঠকের কৌতূহল এখনো সমান জাগরুক। পাশাপাশি নার্গিস নামের এক গ্রাম্য কিশোরীর বঞ্চনার ইতিহাস জানতে চেয়েছেন পাঠক। বিয়ের রাত ফুরাবার আগেই দয়িতাকে কেন ছেড়ে গিয়েছিলেন কবি? গবেষকের নিষ্ঠা ও ঐতিহাসিকের সততা নিয়ে কোনো লেখক এই মানবিক সম্পর্কের উন্মোচন করুক, এটাই চেয়েছেন পাঠক। জানতে চেয়েছেন নার্গিস নামের এক গ্রাম্য মেয়ের রূপান্তরের কাহিনি, ভালোবাসা যাকে আগুনে পোড়া খাঁটি সোনা করে তুলেছিল।
'নার্গিস' উপন্যাসটি প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় কিছুটা সংক্ষিপ্তাকারে, পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। আমার লেখকজীবনে কোনো লেখা নিয়ে এ রকম প্রতিক্রিয়া আমি পাইনি। বেশির ভাগই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে লেখকের প্রতি একধরনের কৃতজ্ঞতাও যেন। যেন কৃতজ্ঞতা? বুঝলাম, নার্গিসের প্রতি একটা ভালোবাসা ও মমতা তৈরি হয়েছে পাঠকের মনে। এই নারীর প্রতি লেখকের একটা পক্ষপাত হয়তো তাঁরা অনুভব করতে পেরেছেন।
২০১৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত পত্র-পত্রিকায় নার্গিসের বেশ কিছু গ্রন্থ সমালোচনা বেরিয়েছে। এখনো ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে 'নার্গিস'-এর পাঠ-প্রতিক্রিয়া দেখি।
একবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে ফোনে যোগাযোগ করেছিলেন জয়শ্রী ভট্টাচার্য নামে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি, নিজেও পরিচালনা করেছেন একটি বা দুটি ছবি। তিনি 'নার্গিস' নিয়ে তাঁর মুগ্ধতার কথা জানান। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চান এই উপন্যাস নিয়ে। সেই জয়শ্রী ঢাকায় এসেছিলেন। আমি ঘটনাচক্রে তখন ঢাকায় ছিলাম। একটি রেস্তোরাঁয় দেখা হলো। দেখলাম একটি স্কেচবুকে উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের চেহারা-পোশাক ইত্যাদির ছবি এঁকে রেখেছেন। বলাবাহুল্য তাঁর এই প্রস্তুতি দেখে খুবই ভালো লেগেছিল। পরে ঢাকা থেকে আমি ফিরে এলাম চট্টগ্রামে, জয়শ্রী গেলেন কুমিল্লায়। কুমিল্লা থেকে রাতে তাঁর ফোন পেলাম, 'ঝিঁঝির ডাক শুনতে পাচ্ছেন?'
বললাম, 'হ্যাঁ।'
জয়শ্রী হেসে বললেন, 'আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি নার্গিসের দৌলতপুর গ্রামে। নার্গিসকে খুঁজছি, নজরুলকে খুঁজছি...।'
সৃজনশীল লোকজন একটু পাগলই হয়। জয়শ্রীকেও সেই পাগলামিতেই পেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ছবিটা কেন হলো না, অবশ্য জানি না।
চট্টগ্রামে প্রথমা প্রকাশনের একটি বিক্রয়কেন্দ্র ছিল। তার পাশেই 'গ্রন্থনিলয়' নামের আরেকটি বইয়ের দোকান। ওই দোকানের স্বত্বাধিকারী সুভাষ দে (লেখক ও সাংবাদিক) একদিন ঠাট্টা করে প্রথমার কিশোর বিক্রয়কর্মী সোহেলকে দেখিয়ে বললেন, 'ওকে দিয়ে তো বিক্রিবাট্টা ভালো হবে না।'
বললাম, 'কেন দাদা?'
আরে, কালকে দেখলাম, দুপুরে এককোণে বসে একটা বই পড়ছে আর চোখের পানি মুছছে। কোন বই পড়ছিল জানেন?
কোনটা?
'নার্গিস'।
ভাবি, এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী আছে?
চট্টগ্রামে একবার মানবাধিকার বিষয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়েছিলাম সাংবাদিক হিসেবে। প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি উপস্থিতি স্বাক্ষরের কাগজটি হাতে নিয়ে হঠাৎ বললেন, 'আপনাদের এখানে বিশ্বজিৎ চৌধুরী কে?'
হাত তুলে বললাম, 'আমি?'
আপনি নার্গিস বইটির লেখক?
বললাম, 'জি।'
তিনি আমাকে দাঁড় করালেন, উপস্থিত সকলের সামনে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। সবাই করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করলেন আমাকে। এই ক্ষুদ্র লেখকজীবনে এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে!
'নার্গিস'-এর সাত বছর পর লিখেছি নজরুলের জীবনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নারী, তাঁর অচরিতার্থ প্রেম ফজিলাতুন্নেসাকে নিয়ে আরেকটি উপন্যাস 'কবি ও রহস্যময়ী'। কী কাকতাল! নজরুল-নার্গিস পর্বের সাত বছর পর ফজিলাতুন্নেসার প্রেমে পড়েছিলেন কবি, আর 'নার্গিস' উপন্যাসের সঙ্গে আমার এ উপন্যাসের রচনাকালের ব্যবধানও সাত বছরই। নার্গিস রচনাকালে বিভিন্ন বইপত্র ঘাঁটতে গিয়ে নানা চরিত্রের ভিড়ে ফজিলাতুন্নেসাকে আলাদা করে চোখে পড়েছিল আমার। এ দুটি মেয়ের চেহারা, আদল ও মানসিক গড়নের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। কর্মজীবনের সাফল্যের বিবেচনায় একের সঙ্গে অন্যের তুলনা চলে না। নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় বাংলার চিরকালীন এক সাধারণ গ্রামে। আর ফজিলাতুন্নেসাকে তিনি প্রথম দেখেন ঢাকা শহরের একটি সাহিত্য সম্মেলনে, যেখানে প্রবন্ধ পাঠ করেছেন এই বিদূষী নারী। নার্গিস সুন্দরী গ্রাম্য বালিকা, আর ফজিলত শ্যামাঙ্গী যুবতী। একজনের চেহারায় রূপ ও লাবণ্য, অন্যের চেহারায় মেধার দীপ্তি। নজরুলের যশ ও খ্যাতির সামনে বিহ্বল নার্গিস, তাঁর প্রেম ও আকাঙ্ক্ষার সামনে প্রতিরোধ গড়ে তোলার তেমন সামর্থ্য কোথায় তার? কিন্তু ফজিলাতুন্নেসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী। ঢাকার ইডেন কলেজ ও কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে ডিস্টিংশন নিয়ে পাস করে আসা মেয়ে। তিনি নজরুলের গুণমুগ্ধ বটে, এমনকি কমলা রঙের চাদর পরা রক্তাভ আয়তনেত্র ও কাঁধ পর্যন্ত ঝাঁকড়া চুলের সুঠামদেহী লোকটার প্রবল পৌরুষ তাঁকে আকৃষ্টও করে বটে, কিন্তু নিজের আবেগের নিয়ন্ত্রণ তার নিজেরই হাতে। ভেসে যাওয়ার আগে কোথায় দৃঢ় পায়ে দাঁড়াতে হয়, এটা তার ভালো করেই জানা। তাই নজরুল তার প্রেমে উদ্‌ভ্রান্ত হলেন বটে, ফজিলাতুন্নেসা ব্যাপারটাকে সামলালেন দক্ষ হাতে। দ্বিধাগ্রস্ত হননি, তা নয়। কী করে সম্ভব, নজরুল ইসলাম তখন দেশ তোলপাড় করছেন তাঁর গানে-কবিতায়, বক্তৃতায়-জাগরণের বাণীতে। এমন সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব! কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রত্যাখ্যাত হলেন নজরুল। এই প্রত্যাখ্যানের বেদনা তাঁর বহু কবিতা ও উৎকীর্ণ।

ফজিলাতুন্নেসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী]

ফজিলাতুন্নেসার জীবনকে উপন্যাসে তুলে আনা শুধু শ্রমসাধ্য বললে যথেষ্ট হয় না, অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব বলেও মনে হয়েছে আমার। একজন বিদূষী নারী, যাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপই প্রথার বিরুদ্ধে। টাঙ্গাইলের করটিয়া গ্রাম থেকে কলকাতা হয়ে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ এক কঠিন সফর। গণিত শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। মৌলবাদীদের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমিয়েছিলেন সুদূর ইংল্যান্ডে। এমন একজন নারী আত্মজীবনী তো নয়ই, এমনকি ডায়েরিও লিখে যাননি। তাঁকেও আবিষ্কার করতে হয় নজরুল জীবনীরই একটি অধ্যায় থেকে। কিন্তু সেখানে শুধু দুজনের সম্পর্কটুকু, পূর্ণাঙ্গ নারীটিকে পাওয়া তো যায় না। লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল। তাঁর বই পড়ে কিছুটা চিনলাম। কিন্তু সেখানেও নজরুল প্রসঙ্গটাই ঘুরে ফিরে আসে। 'বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ' নামের ঢাউস একটি সংকলনেও দু-একটি পৃষ্ঠা বরাদ্দ ছিল ফজিলাতুন্নেসার জন্য। সৈয়দ আলী আশরাফ সম্পাদিত 'নজরুল জীবনে প্রেমের এক অধ্যায়' নামের একটি সংকলনে নজরুলের আটটি চিঠি পাওয়া গেল। সাতটি চিঠিই কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা। কিন্তু তার ছত্রে ছত্রে ফজিলাতুন্নেসার কথা। বিরহী যক্ষের মতো হাহাকার। দুর্লভ সংকলন, করাচি ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বেরিয়েছিল সেটি। সব মিলিয়ে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গিয়েছিল। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন তথ্যের জন্য ফোন দিয়েছি বাংলা একাডেমিতে কর্মরত তরুণ কবি ও লেখক পিয়াস মজিদকে। পিয়াস নানা কাগজপত্র দিয়ে সাহায্য করেছে।
শেষে ফজিলাতুন্নেসার খোঁজে টাঙ্গাইলের করটিয়া গ্রামে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম একবার। খুবই ফলপ্রসূ ছিল সেই যাত্রা। ফজিলতের বাড়িটি দেখা হলো, কাছের-দূরের কিছু আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলাপ করে মোটামুটি পরিবার-পরিজন সম্পর্কেও ধারণা হলো। আর বইয়ে কথোপকথন বা সংলাপের ভাষা হিসেবে টাঙ্গাইলের ভাষা ব্যবহার করতে পারলাম প্রথম আলোর টাঙ্গাইল প্রতিনিধি কামনাশীষ শেখরের সহযোগিতায়।
'কবি ও রহস্যময়ী' প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল সংক্ষিপ্তাকারে। বই আকারে বেরোল তার দ্বিগুণের বেশি কলেবরে। এক মাসের মধ্যেই এর দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হওয়ায় বোঝা গেল, এই বইটিও পাঠককে টেনেছে। অবশ্য গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে ও পরে পত্র-পত্রিকা ও ফেসবুকে এ-সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়া দেখেই এটির পাঠকপ্রিয়তা সম্পর্কে আঁচ পেয়েছিলাম।
এই করোনাকালে গৃহবন্দী মানুষেরা অনেকেই বইপত্রে মনোযোগী হয়েছেন। এ কারণেই হয়তো প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ ফেসবুকে 'কবি ও রহস্যময়ী' সম্পর্কে তাঁদের অনুভূতি জানাচ্ছেন লেখককে।
গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগেই ঈদসংখ্যায় লেখাটি পড়ে কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন এই উপন্যাস সম্পর্কে। লেখাটির প্রশংসা করেও তথ্য সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়াই জানিয়েছিলেন এই বিশিষ্ট কথাশিল্পী। প্রায় মধ্যরাতে ফজিলাতুন্নেসার ঘরে নজরুলের প্রবেশ, তাঁকে প্রেম নিবেদন ও চুম্বনে উদ্যত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি প্রশ্ন করেন, এই ঘটনার কোনো দালিলিক প্রমাণ আছে কি না। একমাত্র ফজিলাতুন্নেসার লেখাই হতে পারে এর দালিলিক প্রমাণ, এই দাবি করেনও তিনি। আমাদের শ্রদ্ধেয় অগ্রজের প্রশ্নের উত্তরে আমি জানিয়েছিলাম, ফজিলাতুন্নেসাকে উপহার দেওয়া একটি গানের খাতা এখনো নজরুল একাডেমিতে রক্ষিত আছে। সেখানে সন-তারিখ (২৪.২.২৮) ও সময় উল্লেখ করে নজরুলের হাতের লেখা কবিতা পাওয়া যায়। এতে নজরুলের কোনো একটা আচরণে যে ফজিলাতুন্নেসা চরম ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় নজরুলের কবিতাতেই—'দিনের আলোকে ভুলিও তোমার রাতের দুঃস্বপন/ ঊর্ধ্বে তোমার প্রহরী দেবতা, মধ্যে দাঁড়ায়ে তুমি ব্যথাহতা/ পায়ের তলার দৈত্যের কথা ভুলিতে কতক্ষণ?'—এই পঙ্‌ক্তিগুলো পড়ে কি বোঝা যায় না, কৃতকর্মের জন্য নজরুল ব্যথিত ও অনুতপ্ত? তাহলে সেই রাতে তিনি কী এমন করেছিলেন, যার জন্য তিনি লজ্জিত ও অনুতপ্ত।
এ ছাড়া নজরুল যে সেই রাতে ফজিলাতুন্নেসার বাড়িতে গিয়েছিলেন এবং সকালে প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরে এসেছিলেন, সে কথা তো কাজী মোতাহার হোসেনের (ঢাকায় যাঁর বাড়িতে নজরুল অতিথি হিসেবে ছিলেন) লেখাতেই উল্লেখ আছে। এতটা ইঙ্গিত পেয়েও ঔপন্যাসিক নজরুলের প্রেম নিবেদনের কথাটি লিখতে পারবেন না—এমন কঠিন শর্ত যদি আরোপ করা হয়, তাহলে ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে উপন্যাস লেখার অধিকার বা স্বাধীনতাই কোনো লেখকের থাকবে না।


'কবি ও রহস্যময়ী' উপন্যাসে প্রায় এক শ বছর আগের সময় ও সমাজকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। একটা অতীত ভ্রমণও হয়ে গেল পাঠকের। আর খ্যাতিমান মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন, প্রত্যাখ্যানের বেদনা, সর্বোপরি লাভ অ্যান্ড হেট রিলেশনের রহস্য উন্মোচনের চেষ্টাও ছিল। বড় মানুষের ছোট ত্রুটি থেকে হয়তো জীবনের অসহায়ত্ব ও সীমাবদ্ধতার দিকটাও উপলব্ধি করতে পারব আমরা।