বাবা, তোমাকে বলা হয়নি
কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কয়েক দিন পরপর আমার চশমার কাচ ভেঙে যায়। খুব সাবধানে ব্যবহার করলেও চশমা ভেঙে যাওয়া কোনোভাবেই আটকাতে পারি না।
চোখের দূরদৃষ্টিজনিত সমস্যায় ২০১৪ সালে এসএসসি পরীক্ষার কিছুদিন আগে থেকে চশমা পরা শুরু করি আমি। আর তখন থেকে চশমা ভাঙাও শুরু হয়। প্রতিবার ভাঙলে মাকে বলি, সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ বকাও খাই। এ কারণেই সব সময় ভয়ে ভয়ে দিন কাটে। একদিন কোচিং থেকে ফিরে লক্ষ করলাম, মা ভেঙে যাওয়া কাচের শোপিচটা আঠা দিয়ে আটকিয়ে আগের মতো করে ফেলেছে। তারপর থেকে চশমা ভাঙলে বকা খাওয়ার ভয়ে কাউকে বলি না। আঠা দিয়ে আটকিয়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যবহার করি। তবে বাইরে নিয়ে যাই না, কাচে জোড়ার দাগ দেখলে অনেকে হাসাহাসি করতে পারে, এ জন্য। একদিন সন্ধ্যায় পড়তে বসে খেয়াল করলাম, চশমার কাচে আঠা দিয়ে জোড়ার কোনো দাগ নেই। অনেক ভেবেও কোনো যুক্তি খুঁজে পেলাম না। কারও কাছে শুনব সে সুযোগও নেই, শুনতে গেলে সবাই রাগ করবে। তাই আর কারও কাছে শুনিনি।
এ ঘটনাকে আমি আমার জন্য ঈশ্বরের তৈরি মিরাকল হিসেবেই মেনে নিলাম। এরপর থেকে যতবার চশমা ভাঙে, আমি একই কাজ করি আর আমার সঙ্গে ওই একই ঘটনা ঘটে।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে বাড়ি থেকে চলে আসি পড়াশোনার জন্য। এখনো একইভাবে চশমা ভাঙে, তবে এখন আর আঠা দিয়ে লাগাই না। হাতখরচের টাকা বাঁচিয়ে কাচ পরিবর্তন করে নিই। তবে যতবারই নতুন চশমা চোখে দিই, ততবারই মন খারাপ হয়, কাচের জোড়ার দাগগুলো উধাও হওয়ার কারণ জানতে না পারায়। অনেকবার ভেবেছি কারও কাছে ঘটনাটা বলি। কিন্তু বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, উপরন্তু হাসাহাসি করবে—এ ভাবনা থেকে কাউকে বলা হয়নি।
সম্প্রতি করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়ি এসেছি। বাড়ি আসার কিছুদিন পর বোনের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে চশমা ভেঙে গেছে। দোকানপাট বন্ধ, ঠিক করার কোনো সুযোগ নেই। বেশ কষ্ট পাচ্ছি, চশমা না থাকায়। ঈদের পর দোকানপাট খুললে বাবা নতুন চশমা এনে দিলেন। চশমা না থাকার কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার চেয়ে আমার ভয় হচ্ছে বেশি, এই বুঝি আবার ভাঙল। পনেরো দিন পর আমার ভয়ই সত্যি হলো। ছাদে ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে চশমার কাচ ভেঙে গেল। যেহেতু দোকানপাট ঠিকমতো খুলছে না, তাই আগের মতো আঠা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যবহার করা শুরু করলাম। হঠাৎ চশমাটা খুঁজে পাচ্ছি না। কারও কাছে যে শুনব, সে সুযোগও নেই। কারও হাতে পড়লেই বুঝে ফেলবে চশমা ভেঙে গেছে। তাই চুপচাপ নিজের মতো খুঁজে যাচ্ছি। দুদিন পর বিকেলে ছাদ থেকে নিচে নেমে রুমে ঢুকতে যাব, এমন সময় খেয়াল করলাম বাবা টেবিলের ওপরে রাখা চশমার খাপটা খুলে কিছু রেখে গেলেন। আমি চশমার খাপ খুলতেই দেখলাম, চশমার কাচে কোনো জোড়ার দাগ নেই। আর তখনই আমার ইচ্ছা হচ্ছিল ছুটে গিয়ে বাবাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরি, কিন্তু কেন জানি না আমার পা একটুও এগোল না। শুধু নিঃশব্দে দুচোখ থেকে জল পড়তে লাগল।
পৃথিবীর সব বাবার মতো আমার বাবাও খুব অদ্ভুত একজন মানুষ। প্রয়োজনে কোনো কিছু চাইলে বাবা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’, কিছুই বলেন না। কিন্তু প্রয়োজনের আগেই চোখের সামনে হাজির করেন। বাবা কখনোই আমাদের ভাইবোনের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না। আমরা যখন কোনো প্রতিযোগিতায় জিততে পারি না বা পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল করতে পারি না, পরিবারের সবাই আমাদের কিছু না কিছু বললেও বাবা কিছু বলেন না। বাবা সব সময় একটা কথা বলেন, জীবনের প্রতিটা দিন নতুন সম্ভাবনার, নতুন সুযোগের, তাই প্রচেষ্টা থামানো যাবে না। এবার হয়নি, পরেরবার নিশ্চয়ই হবে। তবে আমরা বুঝতে পারি, আমাদের ব্যর্থতায় বাবা ভেতরে-ভেতরে খুব কষ্ট পান।
চশমার কাচে জোড়ার দাগ মোছার মতো আমার জীবনের অনেক মিরাকলের স্রষ্টা আমার বাবা। আমার গর্ব ও অহংকার। পৃথিবীতে এই মানুষটাকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে কখনো তা বলা হয়ে ওঠেনি। হয়তো সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা যে মানুষের প্রতি থাকে, খুব সহজে তাকে ভালোবাসার কথা বলা যায় না। কিন্তু অবুঝ মন খুব যন্ত্রণা করে, মাঝেমধ্যে চিৎকার করে বলতে চাই, বাবা, তোমাকে ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি।
কেশবপুর, যশোর।
অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com
আরও পড়ুন
-
মানুষের হাত-পা কেটে নিজেই ‘অস্ত্রোপচার’ করতেন মিল্টন সমাদ্দার: ডিবি
-
দ্বিতীয় টি–টোয়েন্টি: টস জিতে ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ, অপরিবর্তিত একাদশ
-
সেই ৫ মে রাতে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ ঘিরে কী ঘটেছিল
-
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব ঢাকা আসছেন বুধবার
-
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থীরা কী চান, ফিলিস্তিনি বিডিএস আন্দোলন কী