Thank you for trying Sticky AMP!!

মকবুলা মনজুর: তোমারি নাম বলব

সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন কথাসাহিত্যিক মকবুলা মনজুর। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।
মকবুলা মনজুর

আমাদের শিল্পসাহিত্যের অন্ধদিনের প্রজ্বলিত মশালগুলো এমনই করে নিভে যাচ্ছে! বাতিঘর যদি আলো নিভিয়ে এমন করে অনন্তের হাত ধরে, তবে আমাদের, বলা যায় নারীসমাজের অযুত স্বপ্নরেখা মুছে যেতে থাকে কি না?

বকুল ফুল ঝরে গেল! এই মড়কের দিনে! জানি, ঝরা বকুলের সুবাস বাসি হলে তীব্রতর হয়। বকুল নামটি আপনার প্রিয় কাছের মানুষদের উচ্চারণে বারবার ধ্বনিত হতো।

পুরুষশাসিত সমাজ যখন নারী প্রগতি, নারী প্রতিভার মূল্যায়ন করতে যারপরনাই কৃপণ, তখন আপন সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ব, প্রতিভা, পরিশ্রমে মকবুলা মনজুর আপা দীপ্যমান। কখনো নত হতে, তোষামোদি করতে জানতেন না। যেন ঝলমলে এক খাপখোলা তরবারি। এ তরবারি নিয়ত নিধন করতে চায় অসত্য ও অসুন্দরকে!

মকবুলা মনজুরের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। জন্মভূমি মুগবেলাই, কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ। বাবা মিজানুর রহমান, মা মাহমুদা খাতুন। সুখ-দুঃখের জীবনসঙ্গী মনজুর হোসেন। তাঁর পারিবারিক পরিবেশ ছিল শিক্ষা–সংস্কৃতির আলোকিত উঠোন। সাত ভাইবোনের মধ্যে বড় ভাই ছিলেন ড. মোখলেছুর রহমান প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্র পরিচালক ইবনে মিজান, লেখক-প্রকাশক আজিজ মেহের। তিন বোনের মধ্যে বড় বোন গৃহিণী, দ্বিতীয় অধ্যাপিকা মোসলেমা খাতুন, মুশফিকা আহমেদ কনিষ্ঠজন। কর্মজীবন শুরু করেন ব্যাংকে। কিছু কাল হলিক্রস স্কুলে। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন ইউনিভার্সিটি উইমেন ফেডারেশন কলেজে অধ্যাপনা করেন। সবশেষে সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় বগুড়া ভি এম গার্লস স্কুলে। পরে টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী স্কুল, রাজশাহী সরকারি কলেজ এবং ইডেন কলেজে স্নাতক ডিগ্রি নেন। কিছু সময় বিরতির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সাপ্তাহিক ‘বেগম’-এ একটানা ২৫ বছর ফিচার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।

মকবুলা মনজুরের সাহিত্যকর্মের তালিকা দীর্ঘ এবং প্রণিধানযোগ্য। নারীর বিবিধ সংকট, কোণঠাসা অবস্থানের তীব্র জখমের দাগগুলো তিনি বারবার তুলে ধরেছেন তাঁর সাহিত্যকর্মে। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ মকবুলা মনজুরের সাহিত্যে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।

মকবুলা মনজুরের উপন্যাসের সংখ্যা ১৮। গল্প সংকলন ৮টি। অনুবাদগ্রন্থ ২টি। কিশোর উপন্যাস ১১টি।

শিশু–কিশোর গল্প সংকলন ১১টি। জীবনীগ্রন্থ ১টি। আর প্রবন্ধ সংকলন ১টি। তাঁর ভাষা ছিল সহজ–সরল, নির্মেদ এবং বেগবান স্রোতের ধারার মতো, পাঠককে যা দিব্যি টেনে নিয়ে যেত গন্তব্যে।

মকবুলা মনজুরের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘কালের মন্দিরা’ বাংলা সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। গ্রন্থটি জাতীয় আর্কাইভ ও গ্রন্থাগার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ পুরস্কার অর্জন করে ১৯৯৭ সালে।

পুরুষশাসিত সমাজ যখন নারী প্রগতি, নারী প্রতিভার মূল্যায়ন করতে যারপরনাই কৃপণ, তখন আপন সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ব, প্রতিভা, পরিশ্রমে মকবুলা মনজুর আপা দীপ্যমান। কখনো নত হতে, তোষামোদি করতে জানতেন না।

কিশোর উপন্যাস ‘ডানপিটে ছেলে’ চলচ্চিত্রায়িত হয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়। তাঁর গল্প সংকলন ইংরেজিতে অনূদিত হয়। তাঁর আরও একটি কিশোর উপন্যাস ‘মহেশখালিতে মুকুট’ এবং ‘কিশোর মহাভারত’ বহুল পঠিত, তবে বহুল আলোচিত নয়!

১৯৮৪ সালে মকবুলা মনজুর বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের সাহিত্য পদক অর্জন করেন। কমর মুশতারী স্মৃতি পদক অর্জন করেন ১৯৯০ সালে। অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার ১৯১৪ সালে এবং তাঁর বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্তি ঘটে ২০০৫।

এ ছাড়া আরও কয়েকটি পুরস্কারে ভূষিত হন সদ্য প্রয়াত স্বনামধন্য মকবুলা মনজুর।

মকবুলা মনজুর গর্বিত এক জননী এবং পরিপাটি একজন গৃহিণীও বটে। চারটি সন্তান তাঁর। প্রথমা কন্যা লিন্ডা দেশে আছেন। বাকি তিন সন্তান জয়, তৈমুর, সুকন্যা প্রবাসে রয়েছেন।

উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে মকবুলা মনজুরের বাসভবনের কাছে ছোট বোনের বাসভবনে গত শুক্রবার ৬টা ১৫ মিনিটে তিনি ভবসংসারের সমূহ মায়া পেছনে ফেলে অনন্তলোকে যাত্রা করেন।

চলে গেলেন বটে, তবে রয়ে গেলেন আমাদের চেতনার দীপ্তি হয়ে। বেশ কয়েক বছর স্নায়ু রোগে ও অন্যান্য অসুস্থতায় শয্যাশায়ী ছিলেন মকবুলা মনজুর। স্মৃতিভ্রম ঘটেছিল তাঁর। মূলত স্থবির হয়ে ছিলেন। লেখিকা সংঘের প্রায় প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই তিনি ছিলেন এক ভরসার নাম। শেষে ছিলেন উপদেষ্টা।

বকুল আপা, আপনি এ দেশের সাহিত্যে অসামান্য অবদান গচ্ছিত রেখে গেলেন। আর নারীদের প্রগতিশীল চিন্তা চেতনায় সমৃদ্ধ করে গেলেন।
কবির দুটি চরণ দিয়ে শেষ করি—

‘তোমারি নাম বলব নানা ছলে...
বলব মুখের হাসি দিয়ে, বলব চোখের জলে।’

অন্য আলোতে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com