Thank you for trying Sticky AMP!!

সৈয়দ মুজতবা আলী

সৈয়দ মুজতবা আলীর যে কষ্টের কথা আমরা অনেকেই জানি না

গতকাল ১১ ফেব্রুয়ারি ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রয়াণবার্ষিকী। জীবনের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন সময়ে নানা রকম দুঃখ পেয়েছিলেন এই রম্যসাহিত্যিক। কী ছিল সেসব দুঃখ?

যে শান্তিনিকেতন তাঁর সাহিত্যজীবনের ভিত গড়ে দিয়েছিল, পরবর্তী জীবনের একটা সময়ে সেই শান্তিনিকেতনই তাঁর মনঃকষ্টের কারণ হয়েছিল। কিছু লোকের অপপ্রচার ও রটনায় তিনি বিব্রত হয়েছিলেন, দুঃখ পেয়েছিলেন। একপর্যায়ে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তাঁর ছাত্র ও শিক্ষকজীবনের নানা স্মৃতি-আনন্দের শান্তিনিকেতন।
পরিবারের লোকেরা ডাকতেন সিতারা, সংক্ষেপে সিতু। কাছের বন্ধুরা কেউ ডাকতেন মুজতবা, আবার ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কাছে কেবলই ‘সৈয়দদা’। গতকাল ১১ ফেব্রুয়ারি ছিল প্রখ্যাত সাহিত্যিক, রম্যরচয়িতা সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রয়াণবার্ষিকী। এ উপলক্ষে ফিরে দেখা যাক, তাঁর শান্তিনিকেতন-জীবনের ঘটনাবলি।

সৈয়দ মুজতবা আলী দেখতে অনেক সুন্দর ছিলেন। চকচকে ফরসা গায়ের রং, বিদেশিদের সঙ্গে ভুল করে মিলিয়ে ফেলতেন অনেকেই। আর কথায়ও ছিলেন খাসা। প্রথম দেখায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘ওহে ছেলে, আমি নিশ্চিত তুমি পূর্ববঙ্গের সিলেটের বাসিন্দা। কারণ, তোমার কথা থেকে তো কমলালেবুর ঘ্রাণ পাচ্ছি!’

মুজতবা আলী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের ছাত্র। ১৯২১ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানকার কলেজ পর্যায়ের ছাত্র ছিলেন। অর্থাৎ মুজতবা ১৭ বছর বয়সে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের বোলপুরের ওই আঙিনায় পা রাখেন। নিজের ২২ বছর বয়সে সেখানে তাঁর অধ্যয়ন শেষ হয়।

এমন সময় শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। অপপ্রচারকারীরা বলতে শুরু করে, মুজতবা আলী আসলে পাকিস্তানের চর। তাঁর পরিবার থাকে পাকিস্তানে। তাঁর স্ত্রী পাকিস্তান সরকারের চাকুরে। তিনি এখানে কেন? এসব রটনা বিশ্বাস করে স্থানীয় অত্যুৎসাহী পুলিশ তাঁর বোলপুরের বাসায় অভিযান চালায় এবং তাঁর পাসপোর্ট জব্দ করে বসে। বিষয়টি শুনে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অত্যন্ত ক্ষিপ্ত মুজতবা আলীকে পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন। সাগরময় ঘোষ পরে এক লেখায় মন্তব্য করেন, যেসব অর্বাচীন লোক সৈয়দদা সম্পর্কে এমন রটিয়েছেন, তাঁরা মানুষটাকে ভালোভাবে জানতেন না। আর অন্নদাশঙ্কর মন্তব্য করেন, এ আমাদের সবার লজ্জা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে অবশ্য সৈয়দ মুজতবা আলীর যোগাযোগ ঘটেছিল কিশোর বয়সে। ১৯১৯ সালে সিলেট সফরে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বক্তব্য দিয়েছিলেন স্থানীয় ছাত্রদের উদ্দেশে। বিষয় ছিল ‘আকাঙ্ক্ষা’। কিশোর মুজতবা চিঠি লিখলেন বিশ্বকবিকে। জানতে চাইলেন, আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করতে গেলে কী করা প্রয়োজন। এক সপ্তাহ পরেই আসমানি রঙের খামে জবাব পেলেন, ‘আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করিতে হইবে, এই কথাটির মোটামুটি অর্থ এই—স্বার্থই যেন মানুষের কাম্য না হয়। দেশের মঙ্গলের জন্য ও জনসেবার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ কামনাই মানুষকে কল্যাণের পথে নিয়ে যায়। তোমার পক্ষে কী করা উচিত তা এত দূর থেকে বলে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে তোমার অন্তরের শুভেচ্ছাই তোমাকে কল্যাণের পথে নিয়ে যাবে।’

শান্তিনিকেতনে প্রথম সাক্ষাতেই রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন মুজতবাকে, কী পড়তে চাও? তরুণ মুজতবা বললেন, তা ঠিক জানি নে। তবে একটা জিনিস খুব ভালো করে শিখতে চাই। রবীন্দ্রনাথ বললেন, নানা জিনিস শিখতে আপত্তি কী।

এভাবেই শান্তিনিকেতনে জার্মান, ফরাসি, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, রুশ ও ইতালীয় ভাষা আয়ত্ত করেন মুজতবা। এর মধ্যে গুরুদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো ইংরেজি আর বাংলা ক্লাসে। তিনি পড়াতেন শেলি, কিটস আর বলাকা। ড. মার্ক কলিন্সের কাছে শেখেন ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান, অধ্যাপক তুচ্চির কাছে ইতালিয়ান, বগ্ দানফের কাছে আরবি ও ফারসি। এসব মহান শিক্ষককে শান্তিনিকেতনে জড়ো করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তাঁদের কোনো ক্লাসই মিস করার সুযোগ ছিল না মুজতবা আলীর।

মুসলমান হিসেবে নয়, মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে জায়গা করে নেন আপন যোগ্যতায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কবিতা, ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ প্রবন্ধ তাঁর মুখস্থ ছিল। তিনি ও প্রমথনাথ বিশী সুসাহিত্যিক হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথের একান্ত প্রচেষ্টায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর শান্তিনিকেতনের জীবনের সব কথা লিপিবদ্ধ আছে তাঁর ‘গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন’ বইয়ে।

শান্তিনিকেতনের লেখাপড়া শেষ করে সৈয়দ মুজতবা আলী ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়, মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এর মধ্যেই চাকরি করেছেন কাবুলের শিক্ষা দপ্তরে, বরোদার মহারাজার আমন্ত্রণে সেখানকার কলেজে, দিল্লির শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পঞ্চাশের দশকে কাজ করেন ‘আকাশবাণী’ রেডিওর স্টেশন ডিরেক্টর পদে। এই চাকরি তিনি ছেড়ে দেন ১৯৫৭ সালে। ফিরে আসেন কলকাতায়।

আরেক জীবনের শুরু

এ সময় থেকে মুজতবা আলীর আরেক জীবনের শুরু। চাকরি নেই, শরীরের বয়স বাড়ছে। তত দিনে সুসাহিত্যিক হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত। কারণ, তাঁর আলোচিত বই প্রায় সব বেরিয়ে গেছে। মুজতবা আলী চেয়েছিলেন কোনো সংবাদপত্রে সম্মানজনক বেতনে চাকরি করতে। অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতে, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় চাকরির আশা করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেখান থেকে কোনো সাড়া পাননি। অনেক বড় পত্রিকাগোষ্ঠী তাঁর কাছ থেকে কেবল লেখা চাইতে থাকে। লেখার বিনিময়ে সম্মানী। কিন্তু এটা তাঁর ভালো লাগত না।

কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে মুজতবা আলী কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন শান্তিনিকেতনে। চেয়েছিলেন বাকি জীবন সেখানেই থাকতে। ওই বছরের (১৯৫৭) ফেব্রুয়ারিতে তিনি বন্ধু অমলেন্দু সেনকে এক চিঠিতে লেখেন, ‘এই স্থান আমি জীবনে ত্যাগ করতে চাইনে। পেটের ভাতের জন্য লিখতে হবে, সেটুকুই লিখব। কোনো দিন যদি লেখা বন্ধ করেও পেটের ভাত জোটে, তবে চেষ্টা করব, বই পড়া থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য।’
তবে শান্তিনিকেতন গিয়েও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তিগত মোটরগাড়ি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে তিনি খরচ নির্বাহ করতেন। এমনকি সঙ্গে থাকা বাইসাইকেলও বিক্রি করার কথা ভেবেছিলেন। সেখানে তাঁর মনঃকষ্টের কারণ কেবল আর্থিক সংকট ছিল না। রবীন্দ্রনাথের সময় সেখানে যে প্রাণের আনন্দ ছিল, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-পরবর্তী সেখানে তাঁর উপস্থিতি তাঁকে পীড়িত করত। বন্ধুবৎসল পরিবেশের বদলে তিনি দেখেছিলেন চারদিকে ঈর্ষাকাতরতা আর হীনম্মন্যতার প্রকাশ।

এ সময় ‘দেশ’ পত্রিকায় মুজতবা আলীর ‘শবনম’ উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। এ ছাড়া নানা পত্রিকার চাহিদামতো হালকা লেখার চাপ। তিনি যেন হয়ে ওঠেন ‘রাইটিং মেশিন’। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি বড় বই লেখার ইচ্ছা তাঁর অনেক দিনের ছিল; কিন্তু পারেননি এসব লেখার চাপে। সব মিলিয়ে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত লেখার টাকা দিয়েই তাঁকে পেট চালাতে হয়।

এ সময় বিশ্বভারতীর উপাচার্য হয়ে আসেন বিচারপতি সুধীরঞ্জন দাস, যিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র। তিনি সৈয়দ মুজতবা আলীর কাজ ও যোগ্যতা সম্পর্কে জানতেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও জার্মান বিভাগে রিডার পদে ১ হাজার ১০০ টাকা বেতনে সৈয়দ মুজতবা আলীকে নিয়োগ দেন। দুঃখজনকভাবে তখন ইসলামের ইতিহাসে কোনো শিক্ষার্থী ছিলেন না। মুজতবা জার্মান ভাষা পড়াতেন। এ সময় একটি পক্ষ রটিয়ে দেয়, মুজতবা আলী ঠিকমতো ক্লাস নেন না, গবেষণা করেন না। রিডার পদে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া ঠিক হয়নি।

অবশ্য এটা সত্য যে সে সময় সেখানে মুজতবার ভক্তকুলের অভাব ছিল না। আড্ডায় পেয়ে বসেছিল সারা জীবন মজলিশি মানুষ মুজতবাকে।

১৯৬৪ সালে কলকাতার কিছু পত্রিকা মুজতবার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে থাকে। ওই বছর শারদীয় ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকায় বহু আগে দেওয়া তাঁর এক বেতার ভাষণ পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল, সেটি নিয়ে ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় একজন কলাম লেখক মন্তব্য করেন, মুজতবা নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দুধর্মের ওপর আঘাত হেনেছেন। অবশ্য এই নিবন্ধের বিরুদ্ধে আচ্ছামতো জবাব দেন মুজতবার সুহৃদ পরিমল গোস্বামী। লক্ষণীয় হলো, তখন ঢাকার কেউ কেউ মনে করতেন, মুজতবা কলকাতায় থাকতে থাকতে হিন্দু হয়ে গেছেন!
ওই বছর (১৯৬৪) মুজতবার বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হয়। তিনি আশা করেছিলেন, বিশ্বভারতীতে তাঁর চাকরির মেয়াদ বাড়বে।

কিন্তু ৬০ বছর পূর্ণ হওয়ার ৮ মাস পর ১৯৬৫ সালের ৩০ জুন তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কেউ কেউ মনে করেন, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ মুজতবা আলীকে অব্যাহতি দিয়েছিল বাধ্য হয়ে, কারও অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে নয়। মুজতবা যদি উপাচার্যের পরামর্শমতো গবেষণাকর্ম সম্পাদন করতেন, তাহলে হয়তো তাঁর মেয়াদ বাড়তে পারত।

কিছুটা কষ্ট নিয়ে মুজতবা শান্তিনিকেতন ছেড়ে বোলপুরে একটি বাসা ভাড়া নেন। কিন্তু শান্তিনিকেতনের সেই কুৎসা রটনাকারীরা তাঁর পিছু ছাড়েনি। এমন সময় শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। অপপ্রচারকারীরা বলতে শুরু করে, মুজতবা আলী আসলে পাকিস্তানের চর। তাঁর পরিবার থাকে পাকিস্তানে। তাঁর স্ত্রী পাকিস্তান সরকারের চাকুরে। তিনি এখানে কেন? এসব রটনা বিশ্বাস করে স্থানীয় অত্যুৎসাহী পুলিশ তাঁর বোলপুরের বাসায় অভিযান চালায় এবং তাঁর পাসপোর্ট জব্দ করে বসে।

বিষয়টি শুনে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অত্যন্ত ক্ষিপ্ত মুজতবা আলীকে পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন। সাগরময় ঘোষ পরে এক লেখায় মন্তব্য করেন, যেসব অর্বাচীন লোক সৈয়দদা সম্পর্কে এমন রটিয়েছেন, তাঁরা মানুষটাকে ভালোভাবে জানতেন না। আর অন্নদাশঙ্কর মন্তব্য করেন, এ আমাদের সবার লজ্জা।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ঘটনায় মুজতবা আলী মানসিকভাবে প্রচণ্ড আঘাত পান। অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুমাতে পারতেন না। একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল তাঁকে।

কিছুটা সুস্থ হয়ে ১৯৬৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর মুজতবা আলী বোলপুরের বাসা ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। এরপর বেঁচে ছিলেন প্রায় ছয় বছর। ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মৃত্যু হয় ‘দেশে বিদেশে’র লেখকের।
সূত্র: সংশ্লিষ্ট বই ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ