Thank you for trying Sticky AMP!!

লেখক হাসনাত আবদুল হাই এবং ‘কল্যাণী/মমতাজ’–এর ছবি অবলম্বনে কোলাজ

যে উপন্যাসে আছে ভাষা আন্দোলনের জন্য ‘বড় আপা’র জেলে যাওয়ার গল্প

তাঁর নাম ছিল কল্যাণী রায়। তাঁর বাবা ছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি। কল্যাণী ভালোবেসে একজনকে বিয়ে করেছিলেন, নাম বদলে হয়েছিলেন মমতাজ বেগম। তাঁর রায়বাহাদুর বাবা বিয়েটা মেনে নেননি।

ফলে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় তাঁর। দেশভাগের পর শিশুকন্যাকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে পূর্ববঙ্গে চলে এসেছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের মর্গান গার্লস স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে।

ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই নিজ স্কুলের ছাত্রীদের নিয়ে মিটিং-মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। ফলে সরকারের রোষানলে পড়ে জেলে যেতে হয় তাঁকে। স্বামীর কথামতো দাসখত দিয়ে কারামুক্ত হতে চাননি এই নারী। তখন কারাগারে তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের সঙ্গে একই সেলে ছিলেন মমতাজ।

এই কারাবাসের অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনদৃষ্টি ও চেতনাকে এমনভাবে গড়ে দেয় যে ৪৪ বছরের আয়ুর বাকি দিনগুলো তিনি ব্যক্তিগত জীবনযাপনের ঊর্ধ্বে উঠে সমষ্টির কল্যাণব্রতে উৎসর্গ করেছিলেন। এই সাহসী নারীর জীবনকে উপজীব্য করে ‘কল্যাণী/ মমতাজ’ নামে উপন্যাস লিখেছেন হাসনাত আবদুল হাই। ২০২৪ সালের অমর একুশে বইমেলা উপলেক্ষ্যে প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হয়েছে উপন্যাসটি। এই উপন্যাসে আছে এক অকুতোভয় নারীর আখ্যান। এখানে প্রকাশিত হলো ‘কল্যাণী/মমতাজ’ উপন্যাসের একটি অধ্যায়।

মমতাজ বেগমের দিকে তাকিয়ে ইলা মিত্র বললেন, ‘তোমাকে আমি বেথুনে পড়ার সময় দেখেছি মনে হয়। নিচের ক্লাসে পড়তে। একটা শাড়ি দিয়ে ঘেরা ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে আসতে কলেজে।’

মমতাজ হেসে বললেন, ‘আমার বাবার শর্ত ছিল সেটা। প্রথমে তো কলেজে পড়াতেই চাননি। বলেছেন, মেয়েদের বাড়ির বাইরে যেতে নেই। স্কুল পাস করেছ, এই তো যথেষ্ট। এখন বিয়ের জন্য প্রস্ত্তত হও। পড়াশোনা যা করার বাড়িতেই করো।’

‘খুব আশ্চর্যের কথা তো। তিনি হাইকোর্টের জজ ছিলেন, স্ত্রী শিক্ষিত এবং স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। তাঁর পক্ষে এমন রক্ষণশীল হওয়া বেশ অবাক করার মতো ব্যাপার।’

মমতাজ বললেন, ‘কিন্তু আমার জেদের কাছে তিনি হেরে গেলেন।’

ইলা মিত্র বললেন, ‘জীবনে মাঝে মাঝে জেদের দরকার পড়ে। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য। আমাদের যা ন্যাঘ্য পাওনা, তা পেতে হলেও হইচই করতে হয়, জেদ দেখাতে হয়।’

মমতাজ বললেন, ‘আমাকে জীবনে একবার না, কয়েকবার জেদ দেখাতে হয়েছে। আর প্রতিবারই আমি জিতেছি। যা চেয়েছি, তা পেয়েছি এই পর্যন্ত।’

‘তুমি খুব সৌভাগ্যবতী। সবার ক্ষেত্রে এমন হয় না। কোথাও অপূর্ণতা থেকেই যায়। আমি সব শুনব। এখন বিশ্রাম নাও।’ তারপর তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কখন ধরেছে এরা? কোথা থেকে?’

মমতাজ বললেন, ‘সকালে। নারায়ণগঞ্জে আমার স্কুলের সামনে থেকে।’

‘তারপর কোথায় নিয়ে গেল তারা?’

মমতাজ বললেন, ‘মহকুমা অফিসারের আদালতে।’

ইলা মিত্র বললেন, ‘তুমি বেঁচে গিয়েছ, থানায় নেয়নি। চব্বিশ ঘণ্টা আটক রেখে আদালতে হাজির করেনি।’ বলেই ইলা মিত্র শিউরে ওঠেন। যেন ভয়ংকর কিছু দেখছেন।

মমতাজ বললেন, ‘কেন? থানায় নিলে কী হতো?’

হাসনাত আবদুল হাই

শুনে হতবিহ্বল এবং সন্ত্রস্ত হয়ে ইলা মিত্র বললেন, ‘তার চেয়ে নরকে যাওয়া ভালো। থানায় নিয়ে ওরা চব্বিশ ঘণ্টা কী যে করে, তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আমাকে ওরা থানায় নিয়ে রেখেছিল চব্বিশ ঘণ্টা। সবচেয়ে ভয়ংকর দুঃস্বপ্নও তার কাছে হার মানে।’ বলে তিনি অন্যমনস্ক হয়ে যান।
মমতাজ বলেন, ‘খুব জিজ্ঞাসাবাদ করে বুঝি?’

শুনে ইলা মিত্র মমতাজের দিকে তাকান। তারপর শিউরে উঠে বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদ? বললাম না, নরক তার চেয়ে ভালো। সে এমন এক বিভীষিকা যে মনে করতেও রক্ত বরফশীতল হয়ে যায়।’
‘স্বীকারোক্তির জন্য টর্চার করে বুঝি?’

‘এক দল পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে জিঘাংসু হয়ে। খুবলে খুবলে খায় শকুনের মতো। তফাত এইটুকু যে তারা মৃতদেহ নয়, জীবন্ত দেহ দেখে পাশবিক উল্লাসে ফেটে পড়ে। উহ্‌! সে যে কী ভয়ংকর অভিজ্ঞতা, তা অনেক বলেও বর্ণনা করা যায় না। তুমি বেঁচে গিয়েছ তোমাকে থানায় নেয়নি।’
মমতাজ বললেন, ‘মনে হয় সাহস পায়নি।’

‘সাহস? দুর্জন, দুর্বৃত্তের সাহসের দরকার হয় নাকি? তা ছাড়া থানা মানে একটা দুর্গ, যার ভেতর তারা যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে। চব্বিশ ঘণ্টা তারাই হর্তা-কর্তা-বিধাতা। সেখানে নেওয়ার পর তারা যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে। যুবতী মেয়ে আসামি হলে তো কথাই নেই। কী বললে তুমি, সাহস পায়নি? এ কী করে সম্ভব?’

‘আমাকে গ্রেপ্তার করার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রীরা, সাধারণ মানুষ এসে তাদের ঘেরাও করেছে। চিৎকার করে বলেছে, বড় আপাকে ছেড়ে দাও। ক্রমেই মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। সেই সঙ্গে জোরদার হয়েছে তাদের দাবি। আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে গিয়েছে আদালতে।’

স্বগত সংলাপের মতো ইলা মিত্র বললেন, ‘আমাকে গ্রামের হাজার হাজার মানুষ রানিমা বলত। আমাকে ঘিরে রাখত তারা, সুরক্ষা দেয়ালের মতো। কিন্তু সে সুযোগ পায়নি তারা। গ্রামের পর গ্রামে ভাগচাষি সাঁওতালদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে, তারা প্রাণভয়ে ছুটছে আশ্রয়ের জন্য, মারা যাচ্ছে গুলিতে, বেয়নেটের খোঁচায়। তারা কী করে তখন তাদের প্রিয় রানিমাকে রক্ষা করতে আসবে? তারা তো জানেই না আমি কোথায়, কী অবস্থায় আছি।’

‘কল্যাণী/মমতাজ’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ

‘আপনার বাড়ি থেকেই ধরেছিল তারা? একাই ছিলেন তখন?’

ম্লান হেসে ইলা মিত্র বললেন, ‘বাড়িতে থাকব কী করে? তারা ডালকুত্তার মতো হন্যে হয়ে খুঁজছে আমাকে।’

‘আপনি কী করলেন?’ বলেই মমতাজ সলাজে বললেন, ‘সরি, এত কথা জিজ্ঞাসা করছি আপনাকে। আপনার কষ্টের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি। এসব তো আমার জানা নেই। শুধু কাগজে পড়েছি আপনাকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে রাজশাহী জেলে, তারপর ঢাকায় নিয়ে এসেছে। বিচারে আপনাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।’

ইলা মিত্র হেসে বললেন, ‘মাঝখানে আমাকে যে থানায় নেওয়া হলো, সেখানে যে নারকীয় তাণ্ডব ঘটল, সে সম্বন্ধে কাগজে কিছু লেখেনি। কী করে লিখবে? কিছু জানতেই পারেনি।’ তারপর বললেন, ‘জানলেও কি লিখতে পারত? ঘাড়ে দশটা মাথা আছে ওদের, যারা খবর ছাপায়?’
মমতাজ বললেন, ‘আপনার কাছে না শুনলে আমিও কিছুই জানতে পারতাম না।’

ইলা মিত্র বললেন, ‘দেখো তো, এতক্ষণ তোমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। তুমি সারা দিন এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে গিয়েছ। তোমার শরীর, স্নায়ুতন্ত্র সব নিশ্চয় অবশ হয়ে এসেছে। তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন। বসো, আমার বিছানায় এসে বসো। মেঝেতে এই বিছানা ছাড়া তো এই সেলে আর কিছু নেই। এই ভূমিশয্যা! তোমাকেও তা-ই দেবে। তোমার যে অপরাধের কথা বললে, তহবিল তছরুপ, তার জন্য এরা তোমাকে ডিভিশন দেবে না। আমার মতোই তুমি সাধারণ অপরাধী।’ তারপর মেঝেতে মাদুরের ওপর ময়লা চাদর বিছানো বিছানায় বসতে বসতে বললেন, ‘প্রথমে খুব খারাপ লাগবে, ঘুমোতে পারবে না। তারপর আস্তে আস্তে সহ্য হয়ে যাবে। যাকে বলে অভ্যাস।’

একটু পর মমতাজ এসে ইলা মিত্রের বিছানার এক পাশে বসে বললেন, ‘সারা দিন নারায়ণগঞ্জের মানুষ চারদিক থেকে আমাকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছে। তাদের দেখে আমার একটুও একা মনে হয়নি। তারপর সন্ধ্যার আগে আমাকে আর আমার দুজন ছাত্রীকে গাড়িতে করে ঢাকায় এনে যখন জেলে ঢোকাল, তখনো একা মনে হয়নি।’

ইলা মিত্র চঞ্চল হয়ে বললেন, ‘দুজন ছাত্রী? তারা কোথায় গেল?’
মমতাজ বললেন, ‘ফিরোজা আর আয়েশা আক্তার বেলুকে জুভেনাইল সেলে নিয়ে গিয়েছে। ওরা আমার সঙ্গে একই সেলে থাকতে চেয়েছিল। জেলার সাহেব তাদের হয়ে আমার আবেদন শোনেননি। বলেছেন, অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার জন্য তাদেরকে নির্দিষ্ট সেলে যেতে হবে।’
ইলা মিত্র বললেন, ‘তুমি খুব জনপ্রিয় দেখা যাচ্ছে। সারা দিন জনতা তোমার চারদিকে থেকে পুলিশকে বাধা দিল। ছাত্রীরা তোমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য পুলিশের গাড়িতে উঠে বসে থাকল। তুমি অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতাদেরও হার মানিয়ে দিয়েছ।’
মমতাজ লজ্জা পেয়ে বললেন, ‘কী যে বলেন ইলাদি। আপনার জনপ্রিয়তা আর খ্যাতির কাছে আমি কিছুই না। সামান্য স্কুলমিস্ট্রেস।’

ইলা মিত্র বললেন, ‘তুমি এক দিনেই অসামান্য হয়ে গিয়েছ। তারপর শুধরে নিয়ে বললেন, কেউ হঠাৎ করে অসামান্য হয় না। তুমি ভেতরে ভেতরে অনেক দিন থেকেই অসামান্য হয়ে উঠছিলে। আজকের ঘটনা সেই অসামান্য হওয়াকে ত্বরান্বিত করেছে মাত্র। এই পর্যন্ত যা শুনলাম, তাতে মনে হচ্ছে তোমার ভেতরে সেই শক্তি আছে, যা জানে কখন জ্বলে উঠতে হবে।’ তারপর বললেন, ‘আমিও জনতার সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু আমার জনতা ছিল একটা নির্দিষ্ট গ্রুপ। তাদের স্বার্থ ছিল অন্যদের চেয়ে পৃথক। সেই পার্থক্য তাদেরকে সহানুভূতি আর সাহাঘ্যের জন্য আমাকে কাছে টেনেছিল। আমাদের স্বার্থ এক ছিল না।

তারা মনে মনে আমার সাহায্য চেয়েছে, আমিও মনে মনে তাদের সাহাঘ্য করতে চেয়েছি সহানুভূতি দেখিয়ে। আমাকে তারা “রানিমা” বলে সম্বোধন করেছে, যেখানে “রানি” কথাটাই প্রধান, যার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ক্ষমতার এবং বিত্তের। তোমার কেসটা একেবারে ভিন্ন। তুমি মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য মাথা তুলে দাঁড়িয়েছ, যা কোনো বিশেষ শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার বিষয় না, আপামর জনসাধারণের। তুমি জননেতা হয়ে গিয়েছ তাদের সবার প্রাণের কথা বলে। আমি তা হইনি। একটা গোষ্ঠীর কিছু মানুষের কাছে রানিমা হতে পেরেছি মাত্র।’

মমতাজ মুখে হাতচাপা দিয়ে বললেন, ‘আপনি আমাকে লজ্জা পাইয়ে দিচ্ছেন ইলাদি। আপনার পাশে আমি কিছুই না।’

ইলা মিত্র বললেন, বিনয় ভালো মমতাজ। কিন্তু যা বাস্তব, সেটা শুনে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। তুমি মিছেই লজ্জা পাচ্ছ। তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি জানি, আমার খ্যাতি পূর্ববঙ্গে এবং পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে, কেননা আমি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল থানায় যে তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছি, তা শুরু হয়েছিল চল্লিশের দশকের গোড়ায়। জলপাইগুড়ি, দিনাজপুর, রংপুর, উত্তরবঙ্গের এই সব এলাকায় ভাগচাষিদের ফসলের অর্ধেক জমির মালিককে দেওয়ার পরিবর্তে তিন ভাগের এক ভাগ দেওয়ার আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। এটা করতে গিয়ে আমরা জমির মালিকদের খেপিয়ে দিয়েছি। তাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হতে দেখে রাষ্ট্রযন্ত্র ক্রুদ্ধ হয়েছে, কেননা আধা সামন্তবাদী আর আধা পুঁজিবাদী দেশে রাষ্ট্র আর বিত্তবান শ্রেণির স্বার্থ অভিন্ন। সেই যৌথ শক্তি আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আন্দোলনের মূলোৎপাটন করতে চেয়েছে। আমাদের আন্দোলন ব্যর্থ হলে একটা শ্রেণির স্বার্থ, ভাগচাষিদের স্বার্থ পরাজিত হবে। এটা সামান্য ইস্যু নয়। কিন্তু তুমি মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলে, সেই আন্দোলন চলতেই থাকবে দুর্বার গতিতে, যে পর্যন্ত রাষ্ট্র পিছু হটে দাবি মেনে না নেয়। আমার এত কথা বলার উদ্দেশ্য হলো আমার আর তোমার আন্দোলনের মধ্যে পার্থক্যটা তুলে ধরা। অথচ কী আশ্চর্য জানো! তোমার আন্দোলন আমারও আন্দোলন, কেননা বাংলা আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষার আন্দোলন যেভাবে সকল শ্রেণির বাঙালিকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে, সেই ঐক্যের ভিত্তিতে আরও বড় আন্দোলন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তেভাগা আন্দোলনে সেই সম্ভাবনা নেই। তেভাগা সবার আন্দোলন নয়। তার মানে এই নয় যে তেভাগা আন্দোলনের পেছনে যুক্তি নেই, আদর্শ নেই। অবশ্যই আছে, কিন্তু এই ইস্যুতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হলে আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যাবে। তোমাকে দেখে যে আমার মনে এসব ধারণার আবির্ভাব হয়েছে, তা নয়। আমি জেলে এসে বেশ চিন্তাভাবনা করেছি। তুমি এসে সেই বিক্ষিপ্ত চিন্তাকে আরও শুধু এগিয়ে নিয়ে গেলে না, সংহত করলে।’

তারপর ইলা মিত্র হেসে বললেন, ‘এত কথা বলে তোমার মাথা ঘুরিয়ে দিলাম। ব্যাপার হলো কী, এই সেলে দুবছর দিনের পর দিন থেকে, কারও সঙ্গে কথা বলার সুযোগ না পেয়ে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ছিলাম। তুমি এসে যেন লাইটনিং রড হয়ে আমার মনের ভার লাঘব করে দিলে। আমার ভেতরের সেই অস্থিরতা অনেকটাই চলে গিয়েছে। এখন বলো, তোমার কথা শুনি। এতক্ষণ আমিই বকবক করে গেলাম।’

‘আমার তেমন বলার কিছু নেই, ইলাদি। হঠাৎ একটা ঘটনায় সবার চোখের সামনে চলে এসেছি। কিন্তু আমি বিশেষ কেউ নই, আপনি যেমন বললেন। টর্নেডোর মতো একটা ঘটনা আমাকে তুলে এনে সবার সামনে নিয়ে এসেছে। এই ঘটনা আমার তৈরি নয়।’
মমতাজ কুণ্ঠিত হয়ে বললেন।

‘না, তোমার তৈরি নয়। কিন্তু তুমিই ঘটনাকে একটা সময়ে এবং স্থানে যাকে বলে ক্রিস্টালাইজ হতে সাহায্য করেছ। তুমি হেগেল পড়েছ? জার্মান দার্শনিক, যার খুব প্রভাব ছিল মার্ক্সের ওপর?’
‘না, ইলাদি।’ মমতাজ সংকুচিত হয়ে তাকালেন ইলা মিত্রের দিকে।

ইলা মিত্র বললেন, ‘হেগেল লিখেছেন, যার অস্তিত্ব আছে, তার লয় আছে। কিন্তু লয় মানে বিলুপ্ত হওয়া নয়, সেই অস্তিত্ব আগের রূপ হারিয়ে নতুন রূপ নেয়। এইভাবে নিরন্তর পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে একটা অস্তিত্ব সামনে এগিয়ে যায়। এটা যেমন ঘটে প্রকৃতিতে, তেমনি ঘটে মানুষের জগতে, তাদের কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে। থিসিস, অ্যান্টিথিসিস, সিন্েথসিস। চক্রাকারে চলে বস্ত্তজগতের এই পরিবর্তন এবং অগ্রযাত্রা। চক্রাকারেই পরিবর্তন হয় এবং সামনে অগ্রসর হয়।’
মমতাজ মন্ত্রমুগ্ধের মতো ইলা মিত্রের কথা শোনেন আর ভাবেন, তিনি কত জানেন।

ইলা মিত্র বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন এবং তার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ভাষা নিয়ে যে ইস্যু, সেটি পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি করেছে। তুমি একটি নির্দিষ্ট স্থানে এবং সময়ে সেই ঘটনার অন্তর্গত লজিক অনুযায়ী জনতার শক্তি ব্যবহার করে সামনে নিয়ে যেতে সাহাঘ্য করেছ। তুমি, আমি সবাই অতি সামান্য বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে। কিন্তু ঘটনা, যাকে চলমান ইতিহাস বলতে পারো, তা আমাদের দিয়ে অনেক বড় কাজ করায় কখনো কখনো। সেই কাজ ঘটনার রূপান্তর ঘটায় রসায়ন হয়ে।’ তারপর তিনি মমতাজের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আমি কি বোঝাতে পেরেছি মমতাজ?’
মমতাজ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়েন।

ইলা মিত্র খুশি হয়ে বলেন, ‘তোমার নামটা বড় আর কেমন যেন কমান্ডিং। সম্রাট শাহজাহানের প্রিয় বেগমের মতো, যাঁর জন্য তৈরি হয়েছে তাজমহল। তোমার কোনো ডাকনাম নেই?’
‘আছে। মিনু।’
শুনে ইলা মিত্র বললেন, বাহ! বেশ মিষ্টি নাম। কে রেখেছেন? বাবা, না মা?’
মমতাজ বললেন, ‘মামা। প্রমথ মামা।’
‘প্রমথ নামটা হিন্দুর মনে হয়। মুসলমানের এমন নাম শুনিনি।’
ইতস্তত করে মমতাজ বলেন, ‘তিনি হিন্দু। পুরো নাম প্রমথনাথ বিশী।’
শুনে স্তম্ভিত হয়ে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ইলা মিত্র তাকিয়ে থাকেন মমতাজ ওরফে মিনুর দিকে। যেন বুঝতে চান, তিনি ঠাট্টা করছেন কি না। তারপর বলেন, ‘তোমার আপন মামা?’
‘হ্যাঁ, ইলাদি।’
‘তার মানে তুমি হিন্দু ছিলে, ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান হয়ে এই নাম নিয়েছ?’
‘হ্যাঁ, ইলাদি। আমার কুমারী নাম ছিল কল্যাণী।’

ইলা মিত্র তাঁর আসন থেকে সরে এসে বসে বসেই মমতাজকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তুমি অসাধারণ। আমি তোমাকে দেখে, কিছু কথা শুনেই তা বুঝতে পেরেছি। তারপর বললেন, সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এই যে তোমার সিদ্ধান্ত, তা এতই বিশাল, একমাত্র অতি সাহসী হলেই এটা সম্ভব।

সাহসী মানে শারীরিকভাবে নয়, মনের দিক দিয়ে। আর সাহস তো হঠাৎ করে হয় না, হয় ধীরে ধীরে ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায়। তুমি দারুণ সাহসী এক মেয়ে। তোমাকে দেখে ধন্য হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে আমার এই জেল খাটা যেন তোমার দেখা পাব বলেই।’

মমতাজ বললেন, ‘আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন ইলাদি।’

ইলা মিত্র মমতাজকে আরও কাছে টেনে তার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, ‘তুমি আমার ছোট বোন হয়ে গেলে।’

মমতাজ তাঁর পা স্পর্শ করে বললেন, ‘আমাকে দোয়া করুন ইলাদি। ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করার পর আমার মনে মুহূর্তের জন্য কোনো ভাবান্তর হয়নি। আমি নিশ্চিত থেকেছি যে ঠিকই করেছি। কিন্তু আমি একটি পাঁচ বছরের মেয়ের মা। আমার কি ঠিক হয়েছে তার কথা ভুলে এভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া? গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই চিন্তাটা মাঝে মাঝে আমাকে আলোড়িত করছে। আমি কি ভুল করেছি ইলাদি?’

ইলা মিত্র বললেন, ‘মনের মানুষকে বিয়ে করে যেমন তুমি ভুল করোনি বলে ভাবতে পেরেছ, তেমনি সময়ের ডাক শুনে সাড়া দিয়েও তুমি ভুল করোনি।’

মমতাজ মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বললেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি, যেদিন আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা মিছিল-মিটিং করেছি, সেদিন আমার খুকুর জন্মদিন ছিল। পঞ্চম জন্মদিন। আমি তার কাছে ছিলাম না। তাঁর স্বরে বিষণ²তা।’

ইলা মিত্র তাঁর চুলে বিলি কেটে বলেন, ‘সে হয়তো অভিমান করেছে সেদিন। কিন্তু বড় হয়ে সব বুঝতে পেরে তোমার জন্য গর্ব বোধ করবে। তোমাকে আরও ভালোবাসবে।’

তাঁর কথা শেষ হতে না হতে বিকট আর কর্কশ শব্দে ঘণ্টা বেজে উঠল। বেশ কিছুক্ষণ বাজার পর ঘণ্টা থেমে গেল। ইলা মিত্র বললেন, ‘কথা বলতে বলতে ঘুমানোর সময় হয়ে গেল। ‘এখন ওরা ঘরের বাতি নিভিয়ে দেবে।’ তারপর মমতাজের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার মনে হয় আজ কিছু খাওয়া হলো না।’

মমতাজ বললেন, ‘আমার খিদে নেই।’ তারপর ইলা মিত্রের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার সব কথা আমার জানতে ইচ্ছে করছে। একদিন বলবেন।’
ইলা মিত্র মমতাজের চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললেন, ‘বলব।

কল্যাণী/মমতাজ
হাসনাত আবদুল হাই
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
দাম: ৩৩০ টাকা
আসন্ন বইমেলায় বইটি পাবেন প্রথমা প্রকাশনের (প্যাভিলিয়ন: ৫) প্যাভিলিয়নে।
অনলাইনে কিনতে অর্ডার করুন prothoma.com