Thank you for trying Sticky AMP!!

এক সিলেটির হাসির (?) গল্প

তিন সাহিত্যিকের তিনটি মজার ঘটনার অলংকরণ করেছেন সব্যসাচী মিস্ত্রী

‘অন্য আলো’ থেকে আমাকে বলা হয়েছে আমার জীবনের ঘটে যাওয়া একটি মজার গল্প নিয়ে লিখতে। আমি একটি নয়, তিনটি নিয়ে লিখব, যেহেতু ঈদের মৌসুম চলছে। মেয়াদ শেষ হওয়া খেজুরের প্যাকেট যে রকম একটি কিনলে এখন অনেক দোকানি র​্যাবের ভয়ে দুটি ফ্রি গছিয়ে দেয়, অনেকটা সে রকম। কে হায় গুদাম খুঁড়ে র​্যাবকে জাগাতে ভালোবাসে!

আপনার যদি মনে হয় গল্পগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, র​্যাবকে খবর দিন। তবে এগুলো ভেজাল নয়, এ-ই রক্ষা।

প্রথম দুটি গল্প স্কুল-কলেজে পড়ার সময়। আমি দেখেছি, এই সময়টাতেই কেন জানি জীবনের মজার গল্পগুলো সব ঘটে যায়। হয়তো এ সময়টা অপাপবিদ্ধতার, মন খুলে হাসতে পারার, এ জন্য। বয়সটা আপনি পেয়ে গেলে (অর্থাৎ ‘প্রাপ্ত’বয়স্ক হলে) বালসুলভ অনুভূতিগুলো সব উবে যায়, জগতের পাপ আপনার ‘মতি’কে কঠোর করে ফেলে (আপনি আর কোমলমতি থাকেন না, পাপ-তোবয়স্ক হয়ে যান), তখন হাসাটাও মানা হয়ে যায়। সে যা–ই হোক, স্কুলের দশম শ্রেণিতে যখন পড়ি, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হলো। রেডিওতে ঘন ঘন এলান দেওয়া হতো, ভারতীয় চর থেকে সাবধান! চর বলে কাউকে সন্দেহ হলে পুলিশে খবর দিন। আমার এক বন্ধু, সাইফুলের মামা লন্ডন থেকে সিলেট এলেন (সিলেটিদের কাছে লন্ডন-সিলেটের দূরত্বটা বরাবর ঢাকা-আশুলিয়ার মতো)। তিনি পরদিন যাবেন তাহিরপুর, তাঁর বাড়ি। একটা হোটেলে জিনিসপত্র রেখে তিনি বেরোলেন বোনের বাড়ির খোঁজে। কিন্তু খুঁজবেন যে, ঠিকানাটা গেছেন ভুলে। তাঁর ধারণা ছিল মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে বাড়ি পেয়ে যাবেন। ভুল! তিনি আধা ঘণ্টা শুধু শুধু ঘুরে বিভ্রান্ত হয়ে আমাদের পাড়ার কাকুর চায়ের দোকানে ঢুকে চায়ের অর্ডার দিলেন। আমার অভিজ্ঞতা বলে, মানুষের ওপর নির্ভর করে হাতিরপুলের কোনো ঠিকানা খুঁজতে গেলেও একসময় আপনি হয়তো গাবতলি পৌঁছে যাবেন। সাইফুলের মামার হাতে একটা প্যাকেট। তাতে লন্ডনের কোনো দোকান থেকে বোন ও তাঁর পরিবারের জন্য কেনা কিছু গিফট ছিল। প্যাকেটে ‘ইন্ডিয়া’ কথাটা ছিল। বড় করে লেখা দোকানটার নামে। এক খদ্দের তা দেখল। অল্প বিদ্যা সব সময় ভয়ংকরী।

সে লোক কাকুর দোকান থেকে বেরিয়ে যাকে সামনে পেল, বলতে লাগল, ‘স্ফাই’, অর্থাৎ স্পাই। সাইফুলের মামা উঁচু-লম্বা মানুষ, চোখে সোনার রিমের চশমা। পরনে ভালো কাপড়চোপড়। তিনি কিছু বোঝার আগেই দোকানের সামনে ভিড় জমে গেল। আমরা মাঠে ছিলাম। স্ফাই পাওয়া গেছে শুনে আমরাও দৌড় লাগালাম। ততক্ষণে মামা দোকান থেকে বেরিয়েছেন এবং বলছেন, ‘আমি স্ফাই নায়।’ কিন্তু তাঁর কথা কে শোনে। কয়েকজন থানায় দৌড়াল। পুলিশকে খবর দিতে হবে। তীব্র উত্তেজনা। একসময় তিনি গলা চড়িয়ে, কাতর কণ্ঠেই বললেন, তিনি লন্ডনি; এবং সাইফুলের বাবার নামটা বলে জানালেন, তিনি তাঁর বাড়িতে যাওয়ার জন্য এসেছেন।

সাইফুল একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। সে দৌড়ে এল, ‘মনা মামা নি!’ সে চিৎকার করে বলল, ‘আফনে স্ফাই নি’!

সৌম্যদর্শন মনা মামা রেগে গিয়ে সাইফুলের কানটা ডলে দিলেন, ‘তরে কইছে। আয়, দেখাই দিমু আমি কিতা,’ তিনি বললেন এবং দুহাতে মানুষ ঠেলে সাইফুলের বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন।

ভয়ে আমরা সেদিন সাইফুলের বাড়ির দিকে যাইনি।

দ্বিতীয় গল্পটি কলেজে প্রথম বর্ষের। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে মাঝেমধ্যে ট্রেনে এদিক-সেদিক বেড়াতে যেতাম। সাইকেলে চেপে জাফলংয়েও যেতাম। একবার তিন বন্ধু গিয়েছি ছাতক। আমাদের এক বন্ধুর মামা ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির বড় কর্তা। আমাদের দুটি উদ্দেশ্য, ফ্যাক্টরিটা দেখা এবং সম্ভব হলে ছাতক-ভোলাগঞ্জ রেলওয়েতে চড়া। রেলওয়েটা তখন প্রায় শেষ। আমরা ফ্যাক্টরির গেটে পৌঁছে গেটটা খোলা পেয়ে ঢুকে পড়লাম। দুই উর্দি পরা লোক হইহই করে আমাদের ওপর হামলে পড়ল। উদুর্ভাষী সান্ত্রী। তারা উদুর্তেই চিৎকার করতে শুরু করল। উর্দুর কারণে কিনা আমাদের রাগটা জাগল, কিন্তু সিলেটিতে—বাংলায়—ইংরেজিতে আমরা যা–ই বলি, দুই সান্ত্রী চোটপাটের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। একসময় আমাদের ঠেলে গেটের বাইরে বের করে দিল। গায়ে হাত দেওয়ায় আমাদের মেজাজের পারদ উঠল। একটা মারামারির অবস্থা। এক লোক কমলার একটা ঝুড়ি নিয়ে ঢুকছিল। সে এগিয়ে এসে গন্ডগোলে শামিল হলো। লোকটা বাঙালি। তাকে বললাম, আমরা ভেতরে যাব, আমরা বেড়াতে এসেছি। আমাদের কথা শুনে সে-ও চোটপাটে নাম লিখল। এক সান্ত্রী পুলিশ আনতে গেল। একসময় বাঙালি লোকটিকে আমার বন্ধু তার মামার নাম বলল। মামার নাম শুনে লোকটার চোখমুখ সাদা হয়ে গেল। হাতের ঝুড়ি দেখিয়ে সে তোতলাতে তোতলাতে বলল, উনি আমার স্যার, আপনাদের জন্যই কমলা কিনতে পাঠিয়েছিলেন।

মামা বদমেজাজি মানুষ। সেই লোক এবং দুই সান্ত্রীর এরপর কী হয়েছিল, তা না বলাই ভালো। তবে কমলাগুলো ছিল স্বর্গীয়। ছাতকের কমলা বলে কথা।

শেষ গল্পটা লন্ডনের, ১৯৭৬ সালের। আমি তখন প্রাপ্তবয়স্ক শুধু না, বিবাহিত। পিএইচডি করার জন্য কানাডা যাওয়ার পথে দুদিন সাউদাম্পটন থেকে লন্ডনে ফিরেছি। সন্ধ্যায় গেছি আমার এক আত্মীয়ের রেস্টুরেন্টে, তিনি আমাকে ডিনার খাওয়াবেন। রেস্টুরেন্টের শেফ মঝর মিয়া, বয়স ষাটের মতো, হাসিখুশি, দয়ালু। বাড়ি মৌলভীবাজার। আমার নানাবাড়ি কমলগঞ্জ শুনে তিনি অশেষ প্রীত হলেন। বললেন, ‘ঠাকুর, হুনছি তুমি বিয়া করছ।’

‘জি’, আমি বললাম।

‘বউমা আইছইননা নি?’

‘জি না, ও তিনমাস পর আসবে।’

‘বালা। তা ঠাকুর, বউর বাড়ি কই? ছিলটর কুনখানো?’

আমি চুপ করে রইলাম। কী করে বলি আমি ছিলটি বিয়ে করিনি, করেছি বেঙ্গলি!

‘ও বুঝছি’, তিনি বললেন, ‘অবিগঞ্জ।’

‘জি না, হবিগঞ্জ না।’

‘তে কুনখানো? ভাটিত নি?’

ভাটিতে মানে অষ্টগ্রামে, মিটামইনে।

‘জি না।’

‘বাম্মনবারিয়া?’ তার গলা বিমর্ষ।

আমি চুপ করে রইলাম। মঝর মিয়া এবার যেন একটা কিনারা পেয়েছেন। হেসে বললেন, ‘ঢাকাত নি?’

‘জি না’, আমি বললাম।

তিনি হাল ছেড়ে দিলেন। বললেন, ‘কছাইন ঠাকুর, বউমার বাড়ি ঠিক কুনখানো?’

‘মালদা’, আমি বললাম এবং ভুগোলটা বুঝিয়ে দিলাম।

মালদা যেতে কত দিন লাগে, আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।

আমি বললাম, তা প্রায় দু-তিন দিন।

এবার হতাশ মনে হলো মঝর মিয়াকে। তিনি দুহাত তুলে বললেন, ‘ঠাকুর, তুমি তো লন্ডন বিয়া করলেই ফারতায়। আইতে যাইতে দশ ঘণ্টা লাগে।’

মাত্র তিন মাস আগে বিয়ে করেছি। কিন্তু মঝর মিয়ার মুখ দেখে মনে হলো, একজন মানুষকে বিয়েটা অনেক কষ্ট দিয়েছে।

কী আর করা, ঠাকুর।