Thank you for trying Sticky AMP!!

গাছদের যুদ্ধ

‘এই এই! ওঠো ওঠো! যুদ্ধ লেগে গেছে!’
আমি একটা মরিচগাছ। মা-বাবা আমার নাম রেখেছে লিবো। কিরোর ডাকে আমি চোখ খুলে তাকালাম। কিরো আমার বন্ধু।
কিরো বলল, ‘আরে হাঁদারাম, কী দেখছিস? ওঠ! তোর বাবাও যুদ্ধে চলে গেছে। তুই যাবি না?’
আমি ঘুম-জড়ানো কণ্ঠে বললাম, ‘যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আমরা কী করব?’
‘কী করবি মানে! ফাজলামি করিস? আয়, যুদ্ধ দেখবি না?’
আমি তড়াক করে উঠে গেলাম। হেঁটে হেঁটে একটা ডোবার কাছে গিয়ে শিকড়টা ভালোমতো ভিজিয়ে নিয়ে পা বাড়ালাম কিরোর সঙ্গে।
‘তোর মা-বাবা যুদ্ধে গেছে? আমি কিরোকে প্রশ্ন করলাম।
‘আরে না, মা তো ঘরেই। বাবাই গেছে শুধু। তোর বাবাকেও যেতে দেখলাম। আর তোর মা তো...’
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম। সেই ঝড়ের রাতে, যেদিন প্রচণ্ড হাওয়া বইছিল, মানুষগুলো সব হেলে পড়ে যাচ্ছিল, সেই রাতে মা বের হয়েছিল বাইরের অবস্থা দেখার জন্য। আর তখনই...একটা বাজ এসে পড়ল মায়ের ওপর। সেই থেকে আমি মা-হারা।
মা অনেক ভালো ছিল। আমাকে অনেক আদর করত। শাসনও করত। মনে আছে, একবার যখন আমি বসে বসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর চুল ছিঁড়ছিলাম, তখন মা আমাকে একটা কষে থাপ্পড় দেয়। তারপর বলে, ‘মানুষেরা যদি আমাদের মতো চলতে-ফিরতে পারত, আর আমরা যদি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতাম, তাহলে মানুষই হয়তো আমাদের পাতা ছিঁড়ত। বুঝলি? সে জন্য কাউকে কখনো কষ্ট দিতে নেই। বুঝলি?’
মায়ের কথা ভাবতে ভাবতেই আমরা যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হলাম। আমাদের মতো বাচ্চারা আরও অনেকেই এসেছে। কাঁঠালগাছ, আমগাছ, সবাই উৎসাহভরে দেখছে যুদ্ধটা। যুদ্ধ হচ্ছে আমাদের পাশের গ্রামের গাছগুলোর সঙ্গে। ওরা আমাদের উৎপাত করছে সব সময়। তাই আমাদের নেতা, মানে বটগাছ পাশের গ্রামের বটগাছকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেছে।
প্রথমেই আমাদের নেতা হ্যান্ডমাইকে বলল, ‘আমাদের মধ্যে এমন কোনো বীর সেনানী কি নেই, যে একটা তুচ্ছ বটগাছকে হারাতে পারবে?’
পাশের গ্রামের নেতা বটগাছের নাম হেইরো, সে তড়াক করে লাফিয়ে ময়দানে হাজির হলো। আর চারদিকে হাজারো ‘দর্শক গাছ’ হইহই করে উঠল। হেইরো হুংকার দিয়ে বলল, ‘দেখি কোন বাপের ব্যাটা আমার সঙ্গে লড়তে আসে! একদম শিকড়টা দুমড়ে-মুচড়ে দেব। আয়! আয় মাটি থেকে পুষ্টি নেওয়া ন্যাদা ন্যাদা বাচ্চারা! ভয় পাচ্ছিস নাকি?’
হঠাৎই তার মাথায় বড়সড় একটা কাঁঠাল এসে পড়ল। আমরা তাকিয়ে দেখলাম, গ্রামের সবচেয়ে বড় কাঁঠালগাছ ফোকিন্ট চলে এসেছে যুদ্ধের ময়দানে। ফোকিন্ট বলল, ‘আয়, কেমন লড়তে পারিস দেখব। খুব ভাব বেড়েছে, না?’
দুজন দুজনের দিকে আগুন-ঝরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে গোল হয়ে ঘুরতে লাগল। হঠাৎই হেইরো প্রচণ্ড এক লাফ মারল কাঁঠালগাছকে উদ্দেশ্য করে। ফোকিন্টও কম যায় না। ও ঝট করে একপাশে সরে গেল। তারপর হঠাৎ ওর ছাল খুলে ফেলল। গাছের সবটুকু আঠা ও ছুড়ে দিল বটগাছটাকে লক্ষ্য করে।
যা ভেবেছিলাম তা-ই। বটগাছটার শিকড় আটকে গেল। শত চেষ্টা করেও সে শিকড়টা ছাড়াতে পারল না। ফোকিন্ট হো হো করে হেসে বলল, ‘এই যে বীর সেনানী, কী হলো তোমার? ভূতের ভয়? দিনের বেলা ভূত আসবে না। কাঁদে না সোনা, কাঁদে না...।’
হেইরো তার দলের লোকদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? যা, আক্রমণ কর।’
আমরা রুদ্ধশ্বাসে দেখলাম, খেলার নিয়ম ভঙ্গ করে পাশের গ্রামের সবগুলো গাছ লাফিয়ে নামল ময়দানে। কিছু বোঝার আগেই কচুকাটা (নাকি কাঁঠালকাটা!) করে ফেলল ফোকিন্টকে। আমরা যে যেদিক দিয়ে পারলাম ছুটে পালালাম।
একটু দূরে গিয়ে ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, দুই গ্রামের মধ্যে ভয়ংকর যুদ্ধ লেগে গেছে। ভিড়ের মধ্যে আমার বাবাকেও দেখলাম। নিচু হয়ে মরিচ ছুড়ছেন তিনি।
আমগাছ ছুড়ছে আম...
জামগাছ ছুড়ছে জাম...
কাঁঠালগাছগুলো ছাল ছাড়িয়ে আঠা ছুড়ে দিচ্ছে প্রতিপক্ষকে, কাঁঠাল ছুড়ছে সজোরে।
বাবাও যুদ্ধ করে যাচ্ছেন প্রাণপণ...

২.
‘গল্পটা বেশি উদ্ভট হয়ে গেছে।’
বড় ভাইয়ের ডাকে চমকে উঠলাম। গল্পটা লিখে প্রায় শেষ করেছি, এই সময় এমন কথা কারও ভালো লাগে? বললাম, ‘বিরক্ত কোরো না তো, যাও।’
ভাইয়া চলে গেল। আমি আবার লিবোর দিকে তাকালাম। বললাম, ‘এবার তোমার বাবার জীবনকাহিনির শেষ অংশটা বলো।’
বারান্দার টবে রাখা মরিচগাছটা বলতে লাগল, ‘এরপর বাবা করল কী...’

সপ্তম শ্রেণি, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল, ঢাকা