Thank you for trying Sticky AMP!!

ডেড অন দ্য আওয়ার

ভোরের অব্যবহিত আগের সময়টা খুব ভয়ংকর। সুনসান নীরব পবিত্র এই সময়টায় বাতাস থাকে অনির্বচনীয় স্থির। অন্ধকার কেটে গেলেও দিনের শুরু হয় না তখনই। এই সময়টাতে মানুষের প্রতিরোধক্ষমতা থাকে সবচেয়ে কম। তারপর সবকিছু ধীরে ধীরে জেগে ওঠে, প্রাণ ফিরে পায়। শুরু হয় নতুন একটা দিন।

মায়ের একটা হাত ধরে বসে আছে সান্ড্রা। হাতগুলো ঠিক বাচ্চাদের মতো সরু। নরম, দুর্বল হাতের চামড়ায় বার্ধক্যের ভাজ। মাঝে মাঝে তার মনে হচ্ছিল সেগুলোয় এখনো প্রাণের স্পন্দন আছে। পরমুহূর্তে বুঝতে পারল আসলে এটা তার নিজেরই হৃৎকম্পের শব্দ।
গাল বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তাদের অনুসরণ করল আরও কয়েক ফোঁটা। অতীতের স্মৃতি এসে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে সব, যা ছিল ভালো। শৈশবে ফিরে গেল সে, যখন সে ছিল দুর্বল আর তার মা ছিল শক্তিশালী। সে ভাবছে কীভাবে সময়ের চাকা ঘুরে যায়! ঠিক যেমন নিচতলায় তার দাদার আমলের ঘড়ির কাঁটা নিরন্তরভাবে টিক টিক করে ঘুরে চলেছে। দৃঢ়, হ্যাঁ গত মাসগুলোয় সে মানসিকভাবে বেশ দৃঢ় ছিল। শিশুদের মতো চামচ দিয়ে মাকে খাইয়ে দিয়েছে সময় করে। গত রাতের খাবারের মেনু ছিল কমলার জেলি আর এক গ্লাস গরম দুধ। ঠিক সন্ধে ৭টার সময় মাকে খাইয়েছে সে।
ঘড়িটা থেমে গেছে। অনেক আগে শেষবার ঘণ্টা বেজেছিল। নিজের হাতঘড়িটার দিকে তাকাল সে। পুরো একটা ঘণ্টা কেটে গেছে। একটু আগেও ছিল রাত তিনটা। তারপর হঠাৎ করেই এটা ভোর চারটা হয়ে গেল। তখনো সান্ড্রার মায়ের দেহে প্রাণ ছিল। অথচ এখন পড়ে আছে তার নিথর দেহ।
এখন আর কোনো কিছুর তাড়া নেই। দুঃখের মাঝেও এসব চিন্তা এসে মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল তার। একেবারেই কোনো তাড়া নেই। এখন চাইলে সে এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে পারে। যদিও একসময় না একসময় একজন ডাক্তার—শরীরটা কেপেঁ উঠল তার—আর একজন মৃতদেহ সৎকারকারী ডেকে আনতে হবে। একটা ডেথ সার্টিফিকেটও সংগ্রহ করতে হবে। চার্চের যাজক আসবে। আত্মীয়দের ফোন করে খবরটা জানাতে হবে। ছয় বছর আগে তার বাবা মারা যাওয়ার আনুষ্ঠানিকতার বিষয়টা মনে পড়ে গেল। পালিয়েছে! ছিঃ এসব কী ভাবছে সে। মায়ের কৃশকায় প্রাণহীন দেহটার দিকে তাকিয়ে নিজেকে অপরাধী মনে হলো তার।
টনি সব সময় এটা নিয়ে মজা করত। তার মায়ের কাছ থেকে পালানোর জন্য এটাই নাকি সবচেয়ে নিরাপদ রাস্তা ছিল তার বাবার। কারণ, যদি তিনি শুধুমাত্র মাকে ছেড়ে চলে যেতেন, যেভাবেই হোক মা তাকে খুঁজে বের করে ফেলত এবং দেয়ালঘড়িটার দিকে তাকিয়ে রাগত কণ্ঠে জানতে চাইত, কটা বাজে।
হ্যাঁ, তিনি কঠিন প্রকৃতির মহিলা ছিলেন। ঘড়ির কাঁটা মেনে চলা অত্যাচারী মহিলা। স্বার্থপর, খিটখিটে, অবুঝ আর শেষদিকে প্রচুর বাচালতা পেয়ে বসেছিল তাকে। তার ভাই বিল অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী হয়েছে। পালিয়েছে—যেমনটি বলে থাকে টনি। আর বোন ম্যারিওন চলে গেছে আমেরিকায়। টনির মতে সে-ও পালিয়েছে। সুতরাং মাকে দেখাশোনা করার দায়িত্বটা একমাত্র সান্ড্রার ঘাড়েই এসে চাপল।
টনি সব সময় এটা নিয়ে সমালোচনা করত। একবার তাকে সতর্ক করে বলেছিল, মায়ের প্রতি সে বড় বেশি দুর্বল। সে সব সময় মাকে তার ওপর খবরদারি করতে দেয়, কর্তৃত্ব করতে দেয়। তাই অসুস্থ মা তাকে দেখাশোনা করার জন্য বাড়িতে থাকতে চাপাচাপি করে। অথচ নিজের বাচ্চা নেবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে সান্ড্রার। সে বলেছিল এটা নাকি ভালোবাসার বন্ধন নয়—ভয়ের। হতে পারে। সান্ড্রাকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেবার কারণে টনিকে কখনোই পছন্দ করত না মা। শেষ দুবছর মা যখন শয্যশায়ী, তারও আগে যখন সান্ড্রাকে এ বাড়িতে আসতে দিত না টনি, তখন থেকে মা তাকে আরও বেশি অপছন্দ করতে শুরু করে।
এখন মায়ের প্রাণহীন নিথর হাতটা ধরে বসে থাকার সময় প্রথমবার নিজেকে মুক্ত-স্বাধীন মনে হলো তার। ঠিক সাড়ে ছটার সময় মাকে এক কাপ বেড টি বানিয়ে দেয়ার জন্য এখন আর ভোর ছয়টা পনেরো মিনিটে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে হবে না তাকে। এই কাজটা আগে সব সময় করে থাকতেন তার বাবা। ঠিক সোয়া সাতটার সময় ব্রেকফাস্ট দেওয়ারও চিন্তা করতে হবে না। অথবা ঠিক সকাল আটটার সময় তাকে গোসল করানোও লাগবে না আর। তাকে আর মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে না যখন-তখন এটা-সেটা করার জন্য ডাক শুনতে। বাইরে থেকে সামান্য দেরি করে আসার জন্যও বকুনি শুনতে হবে না। বকুনি শুনতে হবে না দুপুরের চা বা রাতের খাবারের ট্রে একটু দেরিতে পৌঁছানো বা ঘুমানোর এক ঘণ্টা আগে এক গ্লাস গরম দুধ দিতে ভুলে যাওয়ার জন্য।
মায়ের প্রাণহীন আঙুলগুলো একটা একটা করে ছাড়িয়ে নিথর কঙ্কালসার হাতটা যখন সে আধা নির্বিকারভাবে নামিয়ে রাখছিল, একটু স্বাধীনতাবোধের, মুক্তির চাপা একটা উত্তেজনাও অনুভব করছিল সান্ড্রা। দীর্ঘদিন অসুস্থ রোগীর দেখাশোনা করার পর মারা গেলে ঠিক যেমনটা অনুভব হয়। আলো নিভিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল সে। ধীরে ধীরে নিজের লিভিংরুমে গিয়ে বিছানায় টনির ঘুমন্ত অবয়বের পাশে শরীর এলিয়ে দিল।
টনিকে জাগানোর কোনো মানে হয় না। তাড়াহুড়ার কিছু নেই আর। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে দিনের পরবর্তী বিষণ্ন কাজগুলো—যেমন কফিন বাছাই করা, শোকসংগীত, পত্রিকায় মৃত্যুসংবাদ পাঠানোর মতো কাজগুলো ভালোভাবে সামলানো যাবে। নিশ্চল শুয়ে রইল সে। সপ্তাহখানেক ধরে রাত্রি জাগরণের ফলে শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। তার চোখ দুটো ভেজা, হৃদয়টা অতি শোকে পাথর হয়ে গেছে।
আধো ঘুমে সে তার দাদার ঘড়ির ঘণ্টা শোনার চেষ্টা করছিল কিন্তু তার নিজের হার্টবিট ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না সে। ঘুম আসছে না, তাই অবশেষে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। গাউনটা পড়ে নিল। দরজা বন্ধ করে একমুহূর্ত দাড়িয়ে রইল। বিটুমিনের মতো অন্ধকারের কালো ছায়া গ্রাস করছে তাকে। মায়ের কক্ষের দরজার দিকে তাকিয়ে কান্নায় গলাটা বুজে এল তার। এখানে দাঁড়ালে সব সময় ঘড়ির কাঁটার টিক টিক শব্দটা শোনা যায়, তবে আজ সেটা শুনতে পেল না সে। বিস্মিত হয়ে সিড়ি ভেঙে নিচে হলরুমে নেমে এল সে। দেয়ালঘড়ির কাঁটা তিনটার ঘরে এসে বন্ধ হয়ে গেছে! নিজের হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল ৬টা ৪৫ বাজে।
ভীষণ অস্বস্তিবোধ হচ্ছে তার। তিনটা বাজে। দুঃখের চাপে সে এটা ভুলেই গিয়েছিল। ডাক্তার নিশ্চিতভাবে এই তথ্যটা জানতে চাইবে। ভোর তিনটার সময় মারা গেছে তার মা।
ভয়ের শিরশিরে একটা অনুভূতি তার ভেতরে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠল। বিয়ের উপহার হিসেবে মাকে ঘড়িটা দিয়েছিল তাদের দাদা। অনন্যসাধারণ ডিজাইনের একটা জিনিস। ছোট্ট হলঘরটা আলো করে আছে। প্রতিবার কক্ষে প্রবেশ করতেই যেন ওপর থেকে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকত এটা। মনে করিয়ে দিত মায়ের খোঁজ নেওয়ার সময় হয়েছে অথবা ভর্ৎসনা করত মায়ের কথা ভুলে যাওয়ার জন্য। টনি এটা পছন্দ করত না, যদিও শুরুর দিকে মায়ের সাথে সম্পর্কটা সহজ করে নিতে চেয়েছিল সে। ঘরটাকে আলো করে এভাবেই ঘড়িটা রয়ে গেছে এখানে। সে মজা করে বলত যে এই ঘরে মায়ের কোনো ছবি টাঙানোর প্রয়োজন নেই—ঘড়িটাই মায়ের প্রতিরূপ।
ঘুরে রান্নাঘরের দিকে এগোল সান্ড্রা। ভেতরে প্রবেশ করতেই ঠান্ডা বাতাসের একটা ঝাপটা এসে শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিল তার। সে ভাবল রেফ্রিজারেটরের দরজাটা খোলা রয়ে গেছে হয়তো। পর্দার ফাঁক গলে ভেতরে প্রবেশ করছে ধূসর বির্বণ রোদ। রেফ্রিজারেটরের গুনগুন শব্দ ছাড়া চারপাশে সব নিস্তব্ধ। আলো জ্বালানোর জন্য সুইচের দিকে হাত বাড়িয়েছে সে, এমন সময় পেছনে কিছু একটা ছুটে গেল যেন। কাপড়ের খসখস শব্দও শুনতে পেল কি? জায়গায় দাড়িয়ে জমে গেল সে। শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে।
তার মা প্রবেশ করেছে কক্ষে।
অবিশ্বাস আর ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে সান্ড্রা। গোলাপি ড্রেসিং গাউন পড়ে দাঁড়িয়ে আছে তার মা। রাগান্বিতভাবে তার দেয়ালঘড়িটায় টোকা দিচ্ছে। 'আমার চা কোথায়? আচ্ছা, তুমি কেমন মেয়ে যে নিজের মুমূর্ষু মাকে সকালবেলা এক কাপ চা দিতে ভুলে গিয়েছ?'
'ম-ম-মা!' অবশেষে তোতলাতে তোতলাতে কোনোমতে বলল সে। 'তুমি...তুমি তো মারা গেছ...মৃত...তুমি কীভাবে...'
কক্ষের ভেতরের ঠান্ডাটা আরও বেড়েছে। ক্রমশ কমে আসছে লাইটের আলো। অথচ বিপরীতে তার মাকে আরও উজ্জ্বল, আরও প্রাণবন্ত এবং আরও তরতাজা লাগছে। মুহূর্তের জন্য স্বস্তির একটা দমকা অনুভব করল সান্ড্রা। বিভ্রম! 'মাম্মি...তুমি ঠিক আছ...আমি...আমি...' ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে এল তার কণ্ঠস্বর। তার চোখ বলছে যে মা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার মন বলছে এটা অসম্ভব। সে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিল যে কিছুক্ষণ আগেও তার মায়ের শরীরে প্রাণের স্পন্দন ছিল না, ঠান্ডা হয়ে আসছিল তার শরীর, আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল রিগর মর্টিস প্রক্রিয়া।
'তুমি আর টনি আমার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলে না? ঘাড় থেকে বোঝা নামানোর জন্য এতই অস্থির হয়ে গেছ, তাই না?'
'মাম্মি, এ...এ..এটা ঠিক নয়। আমি কখনোই...'
হাত দুটো ওপরে তুলে তার দিকে এগিয়ে আসছেন বৃদ্ধা। 'তুই একটা ডাইনি, ভবঘুরে রাস্তার বেশ্যা মাগি!' ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তার দিকে হাত ছুড়লেন তিনি। চমকে গিয়ে চিৎকার করে লাফ দিয়ে দ্রæত কয়েক পা পেছনে সরে গেল সান্ড্রা।
'কার সাথে কথা বলছ তুমি?'
ঘুরে তাকাল সান্ড্রা। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে টনি। ড্রেসিং গাউন পড়ে একটা টাওয়েল কাঁধে তার পেছনে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে সে। আবার মায়ের দিকে ফিরল সান্ড্রা। নেই! হাতুড়ির বাড়ির মতো ধুকপুক শব্দ করছে তার হার্ট। নিশ্বাস নেওয়ার জন্য বাতাসে খাবি খাচ্ছে সে।
'মাম্মি...' বিড়বিড় করল সে। 'আমি...আমি...'
টনিকে পাশ কাটিয়ে ছুটল সে। হোঁচট খেতে খেতে সিড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যাচ্ছে। ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল হলঘরের দরজাটা।
তার মা শুয়ে আছে, ঠিক যেভাবে সে শেষবার দেখে গিয়েছিল। নিশ্বাস নিতেও ভয় হচ্ছে তার, মায়ের গালটা স্পর্শ করল সে। বরফের মতো শক্ত আর ঠান্ডা! চোখগুলো বন্ধ হয়ে আছে। মুখে সন্তুষ্টির একটা হাসি লেগে আছে। যেন কোনো কৌতুক উপভোগ করছে সে।
ভয় আর সন্দেহে আরেকবার কেপেঁ উঠল সান্ড্রা। ঝাঁপিয়ে পড়ল টনির বুকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। টনির কাঁধ থেকে টাওয়েলটা নিয়ে মুখ চেপে ফোঁপাচ্ছে সে।
***
পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় সোজা হয়ে বসল সান্ড্রা। সম্পূর্ণ জাগ্রত সে। পাশের ঘড়িতে এখন সময় ৬টা বেজে ১৫ মিনিট। ১৫ মিনিট! দ্রæত সিড়ি বেয়ে নিচে নামল সে, পাত্রে চা ঢালল, কেটলিতে পানি ফুটে গেলে মায়ের কাপটা ধুয়ে ট্রের ওপর রাখল।
কাপে চা ঢালতে গিয়ে থেমে গেল সে।
কী করছি আমি?
তার মাকে তো প্রার্থনাগৃহের ফিউনারেল পার্লারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আগামী বুধবারে ফিউনারেলের সব আয়োজন সম্পন্ন। রেগে গেল সে নিজের ওপর। চাপাতিগুলো সব ছুড়ে ফেলে দিল বেসিনের ওপর। হলঘরে ফিরে গেল সে আবার। ঘড়িটা এখনো তিনটার ঘরে আটকে আছে দেখে আবার বেডরুমে ফিরে গেল। টনির শরীর ঘেঁষে শুয়ে পড়ল সে। একটা হাত টনির ট্রাউজার গলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। ধীরে ধীরে জাগিয়ে তুলল পুরুষাঙ্গটাকে। দুপা ফাঁক করে টনির ওপর বসে পড়ল সে। অনেক দিন পর দুজনে মেতে উঠল বুনো শারীরিক ভালোবাসায়।
'তুমি এখন মুক্ত,' টনি বলল তাকে। অনেক দিন পর শনিবার সকালটা তারা বিলাসিতা করে একসাথে শুয়ে কাটাল। 'এখন তুমি চাইলে নিজের মতো করে জীবনটা উপভোগ করতে পারবে। একান্ত নিজের মতো করে। আমরা ছুটি কাটাতে যেতে পারব এবং ওই অভিশপ্ত ঘড়িটার হাত থেকে এবার মুক্তি মিলবে আমাদের।'
'সকালে ঘড়িটা ঠিক করতে লোক আসবে,' সান্ড্রা জানাল।
'হে ঈশ্বর! এটার পেছনে টাকা খরচ করছ কেন তুমি? বরং চলো আমরা ওটা প্রথম নিলামে বিক্রি করে দিই।'
'আগে ওটা ঠিক করতে চাই আমি,' বলল সে। 'যেভাবে আছে সেভাবেই ওটাকে থাকতে দিতে পারি না আমি। হাজার হোক মায়ের স্মৃতি জড়িত তাতে।'
***
'এখন আর কোনো সমস্যা নেই, মিসেস অ্যালিস। আমি ভালো করে পরিষ্কার করে দিয়েছি; সম্ভবত ময়লা ঢুকে এটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।'
সান্ড্রা ঘড়ির মেকানিককে ধন্যবাদ জানিয়ে মজুরি পরিশোধ করে দিল। লোকটা চলে যাচ্ছে, এমন সময় পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল সে, 'আচ্ছা, ঘড়িটা কিনতে আগ্রহী হবে, এমন কেউ কি পরিচিত আছে আপনার?'
'ওহ!' বিক্রির কথায় একটু হতাশ মনে হলো তাকে। 'হ্যাঁ, এটা একটা বিরল ঘড়ি। অনেকেই কিনতে আগহী হবেন নিশ্চয়। লুইস হাই স্ট্রিটের আথারটন সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে দেখতে পারেন।'
দরজা বন্ধ করে দিল সান্ড্রা। হলঘরটা ঠিক আগের মতো তার দাদার দেয়ালঘড়িটার টিক টিক শব্দে ভরে উঠেছে। সে তাকিয়ে দেখল ঘড়ির কাঁটাটা একটা লাফ দিয়ে ২টা বেজে ১৫ মিনিটের ঘরে চলে গেল।
গলফ খেলতে গিয়েছে টনি। বিকেলের আগে ফিরবে না সে। ভাবল এখন ঘড়িটা বিক্রির আয়োজন করতে পারে সে। যত দ্রæত ঘড়িটা বাড়ি থেকে বিদায় হয়, তত ভালো। ফিউনারেল শেষ হওয়ার আগেই এটা বিক্রি করে দেওয়াটা হয়তো মৃত মানুষের প্রতি একটু অশ্রদ্ধা হয়ে যায়। হোক, সান্ড্রা থোরাই কেয়ার করে এসব আবেগের।
***
পাচঁটার একটু আগে ফিরে এসে টনি দেখল সান্ড্রার টয়োটা পার্কিং লটে নেই। ভেতরে প্রবেশ করে সে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করল, দেয়ালঘড়িটা আবারও তিনটার ঘরে এসে বন্ধ হয়ে গেছে। ওটা থেকে কোনো টিক টিক শব্দ শোনা যাচ্ছে না। অদ্ভুত তো! সে ভাবল। অথচ সান্ড্রা তাকে বলেছিল আজই ওটা মেরামত করতে লোক আসবে। রান্নাঘরে শব্দ শুনে একটু আশ্চর্য হলো সে।
আরে! এ তো সান্ড্রা।
'হ্যালো ডার্লিং,' তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল সে। 'আমি তো ভেবেছি তুমি বাইরে গিয়েছ।'
টেবিলের ওপর একটা ট্রেতে চায়ের কাপ রাখা। 'মাম্মি বিকেলের চা চাইছেন,' বলল সান্ড্রা। 'তাই আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হলো।'
অবাক চোখে তাকিয়ে আছে টনি। 'তোমার মা মারা গেছেন! আচ্ছা, তোমার গাড়িটা কোথায়?'
সে উত্তর দেওয়ার আগেই ডোরবেল বেজে উঠল। সান্ড্রা কেটলির দিকে ফিরল, যেন ডোরবেল বা প্রশ্ন কোনোটাই শুনতে পায়নি সে।
সামনের দরজাটা খুলল টনি। ক্যাপগুলো খুলে হাতে ধরে বিষণ্ন মুখে দুজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে আছে।
'মি. অ্যান্থনি অ্যালিস?' কাপাঁ কাপাঁ কণ্ঠে জানতে চাইল একজন পুলিশ সদস্য।
'হ্যাঁ, আমিই,' টনি উত্তরে জানাল।
'আপনার স্ত্রীর একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, স্যার। লুইস হাই স্ট্রিট পেরোনোর সময় একটা গাড়ি এসে পেছন থেকে তাকে ধাক্কা দেয়। রয়েল সাসেক্স কাউন্টি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। আমরা অনুমান করছি পথেই মারা গিয়েছেন তিনি।'
টনি মাথা নাড়ল। 'আমি দুঃখিত, আপনারা মনে হয় একটা ভুল করছেন, সে এখানেই আছে। ভেতরে এসে নিজেরাই দেখে যান।'
সে তাদেরকে ভেতরে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। 'সান্ড্রা, তুমি বিশ্বাস করবে না...' থেমে গেল সে। সান্ড্রা রান্নাঘরে নেই! টেবিলের ওপর নেই কোনো ট্রে!
সান্ড্রাকে ডাকতে ডাকতে ওপরে গেল সে। কোনো উত্তর এল না। ভয়ংকর নীরবতা গ্রাস করছে সবকিছু। আবার নিচে নেমে এল সে। 'কী...কখন...কখন ঘটেছে এটা?'
'একটু আগে। আজ দুপুরবেলায়, স্যার,' দ্বিতীয় পুলিশ কর্মকর্তা বলল। অদ্ভুত চোখে দেয়ালঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে সে। 'ঠিক তিনটার দিকে।'