Thank you for trying Sticky AMP!!

বইমেলায় আমি আর কখনো যাব না

অলংকরণ:

বইমেলায় আমি আর কখনো যাব না। বইমেলায়, এইখানে, এই যে শিরিষগাছটা, তার আঁকাবাঁকা ছায়া, এইখানে তুমি আমার হাত ধরেছিলে। এত জোরে কেউ হাত চেপে ধরে। আমার হাতে তিন দিন লাল দাগ ছিল। লোকজনের সামনে তুমি আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে তুলেছিলে একটা ঘোড়ার গাড়িতে। পয়লা ফাল্গুনের বাসন্তী রং মেয়েদের শাড়িতে, খোঁপার গাদায়, ছেলেদের পাঞ্জাবিতে, আর টিএসসির উল্টো দিকের পলাশগাছটায়। এত হইহুল্লোড় ছিল আকাশে-বাতাসে যে টিএসসির সড়কদ্বীপের রাজু ভাস্কর্য পেরিয়ে যে মান্দারগাছটা, সেখানে গলায় রক্ত তুলে ডেকে যাওয়া কোকিলটার কুহু আমি বহু কষ্টেই কেবল শুনতে পাচ্ছিলাম। এইভাবে তুমি কেন আমাকে সবার সামনে থেকে ধরে এনে টমটমে তুললে? ঘোড়া দুটো বেতো, একটা সাদা, একটা খয়েরি, সহিসের পরনে সাদা ইউনিফর্ম, তামার একটা পদকও যেন ঝুলছিল তার বুকপকেটের কাছে!

তারপর রোদটা হঠাৎ মরে এল, সূর্যের নিচে কি পাখা মেলল একটা চিল, নাকি একখণ্ড মেঘ? তুমি আমার গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে বসলে! আমি আশপাশের জনস্রোতের দিকে তাকালাম। তোমার গা থেকে আসছে ঘামের গন্ধ, পারফিউমের গন্ধ, তোমার ইস্তিরি করা চুল থেকে শ্যাম্পুর গন্ধ! আমি একদম বোকা বনে গেলাম। তারপর আমি তোমার দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকালাম। তুমি বললে, ‘ফাজিলের বাচ্চা, আজকে কী দিবস মনে নাই?’

আমি বললাম, ‘কী দিবস?’

তুমি বললে, ‘আজকে চমচম দিবস।’

আমার তখন মনে পড়ল, আগের বছর এই দিন, পয়লা ফাল্গুনে বইমেলা থেকে আমাকে বের করে রিকশায় তুলে নিয়েছিলে তুমি। হঠাৎই কালবোশেখি এল, প্রায় মিনিট পনেরো বইল বাতাস, আর তারপর এল বৃষ্টি। রিকশাওয়ালা হুড তুলে দিতেই তুমি আমার ঠোঁট ভিজিয়ে চুমু বসিয়ে দিলে।

এখন আমার কী করা কর্তব্য! চুমু খাওয়া! এই রোদেলা বিকেলে শাহবাগ জাদুঘরের সামনে ঘোড়াগাড়িতে বসে? তা কী করে হয়!

তোমার বিয়েতে আমি ‘শামসুর রাহমান সমগ্র’ উপহার দিয়েছি। বিয়ে হবে ভার্চ্যুয়াল, তুমি লিখেছিলে! আমি তোমাকে গিফট পাঠিয়েছি অ্যাকচুয়াল। তুমি আমাকে ডাকতে শামসুর রাহমান বলে। বলতে, আমার কবি, আমার শামসুর রাহমান!

আমার প্রথম কবিতার বই বের হবে এবার। তবুও আমি বইমেলায় যাব না। একটাই সুসংবাদ, পয়লা ফাল্গুনে এবার বইমেলা হবে না, এবার বইমেলা হবে মার্চে।

পয়লা ফাল্গুনে আমি যাব বনানী গোরস্তানে। শামসুর রাহমানের কবরের পাশে দাঁড়াব। পাঠ করব ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। এটা শামসুর রাহমানের প্রথম বই। এতে তিনি লিখেছিলেন মৃত্যুর পরে জেগে ওঠা ল্যাজারাসের বয়ান:

সত্তায় এনেছি বয়ে অন্তহীন আশ্চর্য বিষাদ।

সেহেতু সে-বিষাদের বৃন্তে ফোটে আতঙ্কের ফুল,

আমার সান্নিধ্যে কেউ ঘেঁষে না সহজে, ভয়, পাছে

তাদের শিরায় নামে লিথির বিষণ্ন জলধারা।

আমিও মরে গেছি। ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর আমি মরে গেছি, কান্তা! আমার চুলে, আমার চিবুকে, আমার নীল শিরায় লিথির জলধারা।

শামসুর রাহমান জানতেও পারবেন না, ২০২০-এ তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটে গেছে।

আর এটিই হলো, তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুর পর প্রথম গান।

দুই.

এই লেখাটা আমি ফেসবুকে দিয়েছিলাম। কান্তা আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে লিখেছে:

‘আমার কবি শামসুর রাহমান। তুমি অবশ্যই বইমেলায় যাবে। অনেক অনেক কবিতার বই হবে তোমার। আমাকে ভুল বুঝো না, আমি আইটি ইঞ্জিনিয়ার দেখে বর বাছিনি, আমি তোমার কবিতার চিরকালের প্রেরণা হতে চেয়েছি। তাই আমি দূরে সরে গেছি। অ্যাকচুয়ালি দূরে গেলেও ভার্চ্যুয়ালি আমিই তোমার সবচেয়ে কাছের, এই হলো আমার বিশ্বাস।’

মোবাইল ফোনটা এক আছাড়ে ভেঙে ফেলে এখন কষ্ট হচ্ছে। এমনিতেই বুয়া নিজের টাকা দিয়ে বাজার করে এনে খাওয়াচ্ছে। চিলেকোঠার ঘরে বসে দরজা দিয়ে আকাশের তারা দেখে দেখে তো পেট ভরে না। এখন আরেকটা মোবাইল যে কিনব, টাকা কই?