Thank you for trying Sticky AMP!!

বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে, পালাও

উঁচু টিলার ওপর রাখাল দাঁড়িয়ে। দূরে ঘন জঙ্গলের দিকে মুখ করে চিৎকার করছিল, ‘বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে, পালাও।’ বহুক্ষণ গলা ফাটিয়ে চিৎকার চলতে লাগল। জওয়ান গলার আওয়াজ। সেই আওয়াজ ভেসে বেড়াল চারদিকে—বহুক্ষণ। চিৎকার করতে করতে যখন তার গলা শুকিয়ে এসেছে, তখন গ্রাম থেকে দু-তিনজন বুড়ো এল। লাঠি ঠুকতে ঠুকতে হাঁপাতে হাঁপাতে। এসেই রাখালের কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল।

ডাকা হলো পঞ্চায়েত। এসে জমা হলো গ্রামের সব বুদ্ধিমান লোক। শুরু হলো রাখালের বিচারকাজ। অভিযোগ—ভুল খবর দিয়ে গ্রামে অশান্তি সৃষ্টি করা।

রাখাল বলল, ‘মুরব্বিরা, তোমরা ভুল বুঝছ...বাঘ আসেনি মানে যে আসবে না, এমন তো নয়।’

জবাব এল, ‘হতেই পারে না।’

রাখাল বলল, ‘কেন হতে পারে না?’

উত্তর এল, ‘বন বিভাগের লোকজন আমাদের চিঠিতে জানিয়েছে যে বাঘ বুড়ো হয়ে গেছে।’

রাখাল পাল্টা জানাল, ‘তোমরা জানো না, বাঘ কদিন আগেই যৌবন ফিরে পাওয়ার চিকিৎসা করেছে।’

এক বুড়ো বলল, ‘একদম গুজব, আমরা বন বিভাগের লোকদের জিজ্ঞেস করেছি। চিকিৎসার বদলে বাঘ তো নিজের সব দাঁত ফেলে দিয়েছে। জীবনের বাকি দিনগুলো সে অহিংসার পথে কাটাতে চায়।’

রাখাল এবার তেড়ে উঠল, ‘এই খবর মিথ্যেও তো হতে পারে!’

সবাই একজোটে এবার বলল, ‘কখনো না। বন বিভাগের ওপর আমাদের পুরো বিশ্বাস আছে। ওরা সত্য বলার শপথ নিয়ে চাকরি নেয়।’

রাখাল পাল্টা জবাব দিল, ‘কেন? শপথ মিথ্যা হতে পারে না?’

জবাব এল, ‘কখনোই না...তুমি ষড়যন্ত্রকারী, ফিফথ কলামিস্ট, কমিউনিস্ট, গাদ্দার, প্রগতিশীল...তুমি সাদাত হাসান মান্টো!’

রাখাল হাসল। বলল, ‘তবু ভালো, যে আসবে, আমি সেই বাঘ নই...বন বিভাগের লোকজন মোটেই সত্য বলেনি...আমি...আমি...’

পঞ্চায়েতের এক বুড়ো রাখালের কথা থামিয়ে বলল, ‘তুমি সেই রাখালের বংশধর না, যার গল্প স্কুলের বাচ্চাদের পড়ানো হয়? তোমার অবস্থাও ওর মতো হবে। বাঘ আসলে তোমাকেই খাবে।’

রাখাল আবার হাসল, ‘আমি তো বাঘের সঙ্গে লড়ব। আমি জানি সে আসবে। তোমরা বোঝো না কেন! যে গল্প বাচ্চাদের স্কুলে পড়ানো হয়, সে আজকের গল্প নয়! আজকের গল্পে “বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে” মানে সাবধান থাকো। সতর্ক থাকো। হয়তো বাঘের বদলে নেকড়েই এসে পড়ল! তাকে তো আটকানো দরকার!’

সবাই হো হো করে হেসে উঠল, ‘কী ভিতু রে বাবা! নেকড়েকে ভয় পায়!’

রাখাল বলল, ‘বাঘ-নেকড়ে কাউকেই আমি ভয় পাই না। তবে এদের হিংস্রতা নিশ্চয়ই পছন্দ করি না। তাই নিজেকে তৈরি রাখি। মুরব্বিরা, তাহলে স্কুলের বই থেকে গল্পটা বাদ দিয়ে দাও! সে গল্প তো পুরোনো হয়ে গেছে। তার বদলে আজকের এই নতুন গল্পটা পড়াও।’

কাশতে কাশতে বলল এক বুড়ো, ‘এ ছেলে দেখি আমাদের ভুল পথে নিয়ে যেতে চায়! সরল পথে থেকে আমাদের সরানোর ধান্দা!’

রাখাল হেসে বলল, ‘দাদু, জীবন সরল নয়।’

আরেক বুড়ো রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘এ দেখি বিধর্মী! অশান্তি সৃষ্টিকারীদের এজেন্ট! একে এক্ষুনি জেলে ঢোকানো হোক!’

রাখালকে জেলে ঢোকানো হলো।

সেই রাতেই গ্রামে বাঘ এল। চারদিকে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। কেউ গ্রাম ছেড়ে পালাল, বাকিরা মরল বাঘের থাবায়। গোঁফ থেকে রক্ত চাটতে চাটতে বাঘ যখন জেলখানার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, দেখল মজবুত লোহার গরাদের ওপাশে রাখাল। রাগে গড়গড় করল বাঘ। কিন্তু নিরুপায়!

রাখালের ঠোঁটে আবার হাসি। বলল, ‘বন্ধু, সব দোষ আমার মুরব্বিদের! নইলে আমার রক্তের স্বাদও তুমি পেতে।’

সাদাত হাসান মান্টো

উর্দু সাহিত্যের সবচেয়ে আলোচিত গল্পকার সাদাত হাসান মান্টো (১৯১২-৫৫)। ছিলেন রেডিও নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার, সিনেমার সংলাপ রচয়িতা, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার। জন্ম লুধিয়ানায়, মৃত্যু লাহোরে। কেবল লেখালেখির কারণে ব্রিটিশ আমলে তিনবার, পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরও তিনবার তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। রাষ্ট্র, সাহিত্যবোদ্ধা মহল থেকে এককালের সাংগঠনিক বন্ধু— সবাই তাঁকে ত্যাগ করেছে। জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো তিনি লিখে গেছেন ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর, নিঃসঙ্গ শেষ সাত বছরে। এই গল্পও সেই সময়ে লেখা। গল্পটি নমরুদ কি খুদায়ি (নতুন সংস্করণ ১৯৯০, সাকি বুক ডিপো, নতুন দিল্লি) বইয়ের অন্তর্গত।