Thank you for trying Sticky AMP!!

লুপ্ত গ্রামের ডাক

কেউ বিশ্বাস করছিল না প্রথমে। দক্ষিণ বাংলার অখ্যাত একটা গ্রাম হারিয়ে গিয়েছে। সেই গ্রামের খোঁজে যাবে নাজমুল, কিন্তু কাজটি করতে গিয়ে প্রায় নিরাপদ হয়ে ওঠা চাকরিটা তাকে ছাড়তে হলো।

বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আম্মা শুধু জানতে চাইলেন, ‘জলদি ফিরে আসবি তো?’ ছোট বোন উত্তেজনা সামলে বলল, ‘ভাইয়া, ছবি তুলবি। মেসেঞ্জারে পাঠাবি।’ বাবা বিরক্ত মুখে সিগারেটে টান দিতে লাগলেন।

শহুরে রাত, চারদিকে দোকানের আলো। আকাশে পূর্ণবয়স্ক চাঁদটাকে ঘোলাটে করে রেখেছে মেঘের ফিনফিনে চাদর। পরপর কয়েকটা রিকশাকে হাত বাড়িয়ে ডাকল সে। থামল না কোনোটাই।

চাকরি নাজমুল ছাড়তে চায়নি, সপ্তাহখানেকের ছুটি চেয়েছিল। এখন পিক সিজন। সব সেকশনে দারুণ ব্যস্ততা। ছুটি মঞ্জুর হলো না। কিন্তু একরাতে আচমকা তলিয়ে যাওয়া সেই গ্রামে তাকে যেতে হবে, এতগুলো মানুষ, ঘরবাড়ি, খেতখামার, পুকুর আর মসজিদ-মন্দির-বিদ্যালয় শূন্যে কীভাবে মিলিয়ে গেছে, দেখতেই হবে—তাড়নাটা কে তার মাথায় এমন ঠেসে ঠেসে দিচ্ছিল প্রতিনিয়ত? রাতে ঘুমাতে পারছিল না, খাওয়ায় অরুচি ধরেছিল, কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলেও কেমন এক অস্থিরতায় গুলিয়ে যাচ্ছিল তার চিন্তাভাবনা।

দৈনিকের ভেতর দিকে কোনার এক কলামে ছিল খবরটা, ‘ভূমিকম্পে ধসে গেল লোকালয়।’ শিরোনামটা চোখে না পড়ায় সে বিনোদন সংবাদে মন দিয়েছিল, এমা ওয়াটসন গোপনে দেশে এসে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সময় দিয়ে গেছে। সহকর্মী নাজিব তখন বলল, ‘কী সব যে পড়ো, চার নম্বর পাতায় দেখো। ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে, খোদার গজব নয়তো কী?’

সে সময় সে সংবাদটা পড়েছিল। এমন হয় শহরে, ছয়তলা-দশতলা দালান ধসে যাওয়ার খবর তো নতুন কিছু না। তাই বলে একটা আস্ত গ্রাম? নাজিবকে সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘পড়লাম। এ কেমন সব ঘটনা ঘটছে বলো তো?’

‘কেমন আর, মানুষের পাপের ফল। গ্রাম তো গ্রাম, কোনো দিন এ দেশ না ডুবে যায়।’

‘কী যে বলো না...’

‘আরে মিয়া, পাপে ছাড়ে না বাপে।’

‘একটা গোটা গ্রাম তলিয়ে গেছে, ধরো ওই গ্রামে তোমার পরিবারের কেউ ছিল, তখনো এমন বলতা? তাদের পাপের কারণে এমনটা হয়েছে?’

‘বিষয় এই রকম না।’

‘কী রকম, আমাকে বুঝিয়ে বলো। এত এত লোক মারা গেল। আর তুমি এককথায় বলে দিলে এসব খোদার গজব, পাপের ফল?’

নাজিব কিছুটা নরম হয়ে বলেছিল, ‘এসব থাক। যাবে সেখানে বলছ? অত দূরের গ্রাম, শুনেছি ওদিকে যাতায়াত ব্যবস্থা সুবিধার না। ছুটিও তো এ সময় পাবে না মনে হয়।’

‘বলে দেখি জাকারিয়া ভাইকে।’

‘আচ্ছা, ওখানে গিয়ে করবেটা কী তুমি, শুনি?’

একই রকম প্রশ্ন জাকারিয়া ভাইও করেছিলেন। কোনো রকম উত্তর নাজমুলের মগজে আসেনি। আসলেই তো, ভূমিধসে নেই হয়ে যাওয়া একটা গ্রামে যাবেই-বা কীভাবে সে, আর গিয়ে করবেই বা কী? কার স্বার্থ উদ্ধার হবে সেখানে গেলে?

হাঁটতে হাঁটতে তার মনে অতীতের নানান সমজাতীয় ঘটনাগুলো তোলপাড় করে, যেদিকে সে যাচ্ছে, খুব নদীভাঙন ওখানকার নিত্য ঘটনা—কত কত গ্রাম অমাবতীর জলে বিলীন হয় প্রতিবছর। কিন্তু এ গ্রামটা নদীভাঙনের শিকার হয়নি, এখন বন্যার মৌসুম তা-ও নয়। একপাল দানব এসে কি রাতভর নেচে গিয়েছে, লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে মানুষের নিত্য আবাস, বেঁচে থাকা, স্বপ্ন আর ঘুম?

বাসস্ট্যান্ড এদিক থেকে পনেরো মিনিটের হাঁটাপথ। নিজের ভেতরে কেমন এক অস্থিরতা নিয়ে সে হাঁটে, চার রাস্তার মোড়ে পৌঁছে দেখে ডান দিক থেকে মানুষ এগিয়ে আসছে, বাঁ দিক থেকেও—কেন তারা আসছে, কেনই তারা যাচ্ছে? মহল্লার দশ নম্বর লাইনে ঢুকতে কে তার নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকল, ‘ওই!’

পিছে তাকিয়ে সে দেখল ইকবাল দাঁড়িয়ে আছে। কোন এক ব্যাংকে চাকরি করে এখন। শৈশব-কৈশোর কিংবা প্রথম তারুণ্যের দিনগুলো একসঙ্গে কাটিয়েছে তারা এ মহল্লায়, অথচ শেষ কবে দেখা হয়েছে মনে পড়ল না নাজমুলের।

‘কেমন আছিস রে? কাঁধে স্কুলব্যাগ ঝুলিয়ে কই চললি?’

‘যাচ্ছি এক কাজে। তোর খবর বল। কত দিন পর দেখা!’

‘হ্যাঁ, মেলা দিন।’

‘চাকরি কেমন চলছে?’

‘ভূতের খাটুনি খাটছি। সকালে যাই, ফিরতে রাত নয়টা-দশটা। মাস শেষে গাদাখানেক টাকা দেয়, সেই টাকা খরচ করার টাইম পাই না।’

‘বেশ তো। জমছে বরং।’

‘মজা নিচ্ছিস? তোর খবর তো বললি না। আইটি সেক্টরে বেশ নাকি জমিয়ে বসেছিস?’

‘আর জমালাম কই? চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি আজ সকালে।’

‘ছেড়ে দিয়েছিস মানে?’

‘ছুটি চাইতে মঞ্জুর হলো না, তাই ছেড়ে দিলাম।’

‘তুই পাগল নাকি? এই বাজারে কেউ চাকরি ছাড়ে? না খেয়ে মরবি তো!’

‘তোরা বন্ধুরা থাকতে না খেয়ে কেন মরব?’

‘হা হা হা। ঠিক ঠিক। তোর ফাজলামোর স্বভাবটা যায়নি এখনো তাহলে? যাক বাদ দে, কোথায় যাচ্ছিস বল এখন। বাসার সবাই কেমন আছে?’

‘সবাই আছে ভালো। গাবতলী যাচ্ছি। ওখান থেকে বাসে উঠব।’

‘চাকরি ছেড়ে বনবাসে চললি?’

‘ওই এক রকম।’

‘দুই মিনিট আমার জন্য দাঁড়াবি?’

‘কেন?’

‘একটু বাসায় যাব আর আসব। তোকে গাড়িতে তুলে দিতে পারি। একসঙ্গে তো মেলা দিন ঘুরি না।’

‘আমার খুব জরুরি কাজ ইকবাল। অন্য একদিন তোর সাথে ঘুরব?’

‘দেখে তো মনে হচ্ছে না টিকিট কেটেছিস। দাঁড়া পাঁচ মিনিট। যাব আর আসব, বউকে অন্তত বলে আসি, ফিরতে দেরি হলে রাতে ড্রয়িংরুমে ঘুমাতে হবে। বিয়ে তো করিস নাই, এসব বুঝবি না।’

‘তুই বিয়ে করেছিস? কবে করলি? জানালি না তো!’

ওর বিস্ময়টা দন্তবিকশিত হাসির সঙ্গে উপভোগ করতে করতে ইকবাল দ্রুত পা চালায়, ‘বলছি বলছি, পাঁচ মিনিট দাঁড়া। কত কথা জমেছে।’

ফোনের ডিসপ্লেতে সময় দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল বুক চিরে। নয়টা আটান্ন। শেষ বাস রাত কটায় ছাড়ে তার জানা নেই। পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে এভাবে দেখা হওয়া ঠিক হলো না। চায়ের দোকানে ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আব্বার কথা স্মরণ হলো তার, নবুবাজারে একটা মলিন জুতার দোকানে বিরক্ত মুখে আব্বা বসে আছেন—সে দেখতে পেল: খরিদ্দার নেই, পুরোনো ডিজাইনের চামড়ার জুতা এখন আর কেউ কিনতে চায় না, তবু পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এ ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার লোক তিনি নন। পিতার বিরক্ত মুখেও কিসের একটা প্রত্যয়, নাজমুল বোঝে—এ প্রত্যয় বংশগতভাবে সে-ও পেয়েছে। এই আধঘণ্টা আগেও বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আব্বার সঙ্গে হওয়া কথোপকথন তার বুকটাকে ভার করে তুলল। জুতার দোকানের দৃশ্যটা বদলে নিজেদের তিনতলার ভাড়া ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। রান্নাঘরে আম্মা সবজি কুটছেন, ভেতরের একটা রুম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছোট বোন উচ্চকণ্ঠে কিছু একটা আউড়ে যাচ্ছে অনবরত। আব্বা বলছেন, ‘তুমি আমাদের সবার স্বপ্ন এভাবে মাটি করবে ভাবিনি।’

ইকবালের জন্য আর অপেক্ষা না করে হাঁটতে শুরু করল নাজমুল। এসে তাকে আর পাবে না? না পেল। কতজন কত কিছু পায় না। ফিরে এসে তাকে না দেখে ইকবাল কী কী করতে পারে, ভাবতে বেশ লাগে। তার নম্বরে ফোন দেবে? কিংবা হয়তো বহুদিন পর তাদের বাসায় ছুটে যাবে, আম্মাকে প্রশ্ন করবে, ‘নাজমুলকে কাঁধে ব্যাকপ্যাক নিয়ে কোথায় যেতে দেখলাম চাচি, কোথায় যাচ্ছে ও?’

বাসস্ট্যান্ডে লোকজন কমে আসছে। বন্ধ হচ্ছে দোকানপাট, অস্থায়ী ফুডকার্টগুলোও নেই এখন। অনিক প্লাজার সামনে চুপচাপ ঝিমাচ্ছে একটা পুলিশ ভ্যান।

বহুক্ষণ অপেক্ষার পর একটা বাসে উঠতে পারল সে, প্রায় ভরা বাস। দশ-বারোটা আসন ফাঁকা আছে। বাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই শিপার কথা মনে পড়ল। চাকরি ছাড়ার সংবাদ প্রেমিকাকে দেয়নি সে, কিংবা এই যে লুপ্ত গ্রামের সন্ধানে চলেছে, এ কথাগুলোও ফোন করে বলতে গিয়ে কণ্ঠে আটকে গেছে সব। কী বলবে? শেষ যেদিন দেখা হলো সপ্তাহখানেক আগে, বাজে রকমের ঝগড়া হলো কোনো কারণ ছাড়াই। এই রকম তাদের শুরু থেকেই হয়, তবু কোনো অজানা কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার ভাবনাটা মৃত্যুর অনুভূতি দেয় নাজমুলকে, শিপাকেও কি দেয় না?

পরপর কয়েক জায়গায় থামল বাসটা। যে কয়টা আসন ফাঁকা ছিল ভরে যেতেই সাঁই সাঁই করে ছুটে চলল আবার। এত অল্পের জন্য গোটা জীবন ঝুঁকিতে ফেলার কোনো অর্থ হয়? হয়তো কিছুই পাবে না সে গ্রামটায় গিয়ে, খালি হাতে ফিরতে হবে। টিভিতে কিংবা দৈনিকে কয়েক দিন ধরে সংবাদ হচ্ছে ওই লোকালয় নিয়ে, দূর থেকেই তো এসব দেখা মঙ্গল। কাছে কেন যাচ্ছে সে? বাসের সব থেকে পেছনের আসনে বসে নিজেকে তার মনে হলো, সে মহাভারতের অর্জুন—নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেন এই নিত্য বেঁচে থাকার সমস্ত অন্ধকার এক ঝলকে দেখে ফেলেছে সে, নির্বাসনে চলেছে তাই সমস্ত কিছু পেছনে ফেলে।

ইঞ্জিন বয়ে আসা জোরালো শব্দ ছাপিয়ে তার খেয়াল হলো বহুক্ষণ পেরিয়েছে। গাবতলী পৌঁছাতে এত সময় কি লাগে? ওখানে টার্মিনাল, সময়মতো না পৌঁছালে হাইওয়ে বাসে উঠবেই-বা কীভাবে? শেষ ট্রিপটা যদি ধরতে না পারে, আজ রাতে আর রওনা করা হবে না। আশপাশের রাস্তাঘাটও সে চিনছে না, জানালার ওপাশে অচেনা সব, সীমাহীন ফসলের খেতের ওপর ঝরে পড়ছে চাঁদের আলো। খুব বাতাস দিচ্ছে। পাশে বসা মাঝবয়সী লোকটিকে সে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথাকার বাস এটা ভাই? এ বাস কি গাবতলী যাবে না?’

লোকটি বলে, ‘না। যাবে না।’

‘তাহলে কোথায় যাবে?’

‘এ বাস কোথাও যাবে না।’

‘মানে?’

দূর থেকে অজস্র কণ্ঠ তার নাম ধরে ডাকছে—নাজমুল শুনতে পেল। সমুদ্র গর্জনের মতো থেকে থেকে ওঠানামা করছে সেই ডাক। পাশে বসা সহযাত্রীটিকে আবার সে জিজ্ঞেস করল, ‘কারা ডাকছে অমন করে ভাই? আমার নাম ধরে কারা ডাকছে? শুনতে পাচ্ছেন?’

লোকটির কণ্ঠ তখন বেজে উঠল এক মগ্ন সেতারের মালকোষ হয়ে, ‘শুনছি। আমার নাম ধরেও ডাকছে। আমরা যার যার নিজের নাম শুনতে পাই ওই ডাকে। এই নিয়ম।’