Thank you for trying Sticky AMP!!

অলংকরণ: আরাফাত করিম

৪০ বছর পর বৃদ্ধাশ্রমে এসে যা দেখলেন স্ত্রী

প্রবীণ নিবাসের সেবক সিস্টার সান্ত্বনা একগুচ্ছ ফুল আর একটা কেক নিয়ে হাজারী সাহেবের রুমে হাজির হলেন।

হাজারী খুশি হলেন। কাশির গমক উঠল, তা সামলে নিয়ে তিনি বললেন, এসব কেন?

আজ আপনার জন্মদিন। ৮৬ বছর পূর্ণ হলো। আপনি ৮৭তম বছরে পা রাখলেন।

আচ্ছা।

আপনি কেকটা কাটেন। আমি মোবাইল ফোনে একটা ছবি তুলি।

আচ্ছা।

মোমবাতিটাতে ফুঁ দেন।

আচ্ছা, মোমবাতি কেন?

আজকে আপনার জন্মদিন। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।

আজকে কী?

আপনার জন্মদিন।

কত বছর বয়স হলো?

৮৬ বছর ১ দিন।

আচ্ছা। আমার বার্থডে?

জি।

আজকে আমার কোনো ভিজিটর আসেনি?

না।

আমার ছেলে? রাহাত হাজারী?

না। আপনার ছেলে করোনার সময় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন!

ও। ছেড়ে চলে গেছে? সবাই তাই যায়। আর আমার মেয়ে সাবরিনা?

উনি আমেরিকা থাকেন।

কই থাকে?

আমেরিকা।

কে আমেরিকা থাকে?

আপনার মেয়ে।

আচ্ছা। তাহলে সাবরিনার মা তো আসবে? নূপুর।

না। আসবেন না।

কেন আসবেন না?

উনি আপনাকে ছেড়ে চলে গেছেন আজ থেকে ৪০ বছর আগে!

কে চলে গেছে?

আপনার প্রাক্তন স্ত্রী। তাঁর নাম ছিল নূপুর। উনি আপনার ছেলে আর মেয়েকে ফেলে রেখে চলে যান।

কোথায় যান?

আপনার মেয়ের প্রাইভেট টিউটর ছিল একজন। আপনাদের বাসায় আসত। তার সঙ্গে নূপুর চলে গেছেন।

তুমি জানলে কী করে?

আপনার হিস্ট্রি আমাদের ফাইলে লেখা আছে। আমাকে পড়ে নিতে হয়েছে।

আচ্ছা।

নেন। এক টুকরা কেক খান।

কেক! কেক কেন খাব?

আপনার আজকে জন্মদিন!

আচ্ছা। নূপুর আসেনি। নূপুর আমাকে জন্মদিনে পাঞ্জাবি সেলাই করে দিত। একবার দিল লাল রঙের পাঞ্জাবি। আমি বলেছিলাম, লাল রঙের পাঞ্জাবি কি আমি পরতে পারব? সেকি রাগ! পুরো পাঞ্জাবি কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলেছিল। নূপুরকে খবর দাও।

ওনার ঠিকানা তো আমরা জানি না।

কেন, সে আমার লালমাটিয়ার বাসায় নাই?

না। লালমাটিয়ার বাসা তো ভাড়া। আপনার ছেলে মারা যাওয়ার পর আপনার ছেলের বউ আমেরিকা চলে গেছে।

নূপুর আসবে না?

না। ওনার কোনো খবর নাই।

দেখো, আসবে। নূপুর আসবে। আচ্ছা...

সিস্টার সান্ত্বনা ঠিক করলেন, এই নূপুরকে তিনি খুঁজে বের করবেন এবং একদিন তাঁকে ঠিক হাজির করবেন এই প্রবীণ নিবাসে। নূপুর ম্যাম আসবেন কি না, সান্ত্বনা নিশ্চিত নন। তবে সান্ত্বনা চেষ্টা করবেন। চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখবেন না।

বিকেলবেলা রোদ খুব তেরছা হয়ে পড়ল। একেবারে হলুদ রঙের। আমের মুকুলের গন্ধসমেত একঝলক বাতাস বৃদ্ধনিবাসের ১০১ নম্বর রুমের পর্দাটা পতাকার মতো পতপত করে নাড়াতে লাগল।

হাজারী সাহেব শুয়ে ছিলেন। তিনি উঠে বসলেন। তাঁর মুখ বিরক্তিতে ছেয়ে গেল। কে দরজায়?

একজন বৃদ্ধা, তোবড়ানো গাল, কুঁচকানো চামড়া, চোখে ভারী পাওয়ারের চশমা!

তার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন সিস্টার সান্ত্বনা। এই নেন, আপনার নূপুরকে এনেছি। কত সাধনা করে কত জায়গায় মেইল করে, ফোন করে যে ওনার ঠিকানা জোগাড় করে ওনাকে রাজি করিয়েছি, আমিই জানি। আমাকে থ্যাংক ইউ বলেন।

কে এসেছে?

নূপুর ম্যাডাম। আপনার নূপুর।

পাভেলের আব্বা, আমি পাভেলের মা।

পাভেলের মা? নূপুর আসেনি?

আমিই নূপুর।

আমি কি নূপুরকে চিনি না! ফোকলা মুখে হাসেন হাজারী! এই যে নূপুর। মাথার বালিশের কাছে রাখা মানিব্যাগ হাতে নেন হাজারী। শীর্ণ কাঁপা কাঁপা হাতে ওয়ালেট থেকে বের করেন একটা পাসপোর্ট সাইজের বিবর্ণ হয়ে যাওয়া রঙিন ছবি। ৪০ বছর বয়সী এক নারীর। এই হলো নূপুর...

বৃদ্ধা কথা বলেন না। তাঁর ঠোঁট কাঁপতে থাকে। তাঁর চোখের পাতা স্থির। দুই ফোঁটা পানি গড়াল। এরপর চার ফোঁটা। এরপর অঝোর বর্ষণ।

সিস্টার সান্ত্বনা ওই রুম থেকে দূরে চলে গেছেন। ওই রুমে এক প্রবীণ, আরেক প্রবীণা।

হাজারী বলেন, আপনি কাঁদছেন কেন? আচ্ছা, আপনি কি নূপুরকে খবর দিতে পারবেন? বলবেন, হাজারী তাকে একটা বারের জন্য দেখতে চায়। জাস্ট একটা বার...

আচ্ছা বলব। প্রবীণা বলেন। তারপর তিনি আর কথা খুঁজে পান না।

বাইরে চৈত্রের বাতাস। গাজীপুরের শালবন থেকে একটা ঘূর্ণি বাতাস ঘুরতে ঘুরতে এসে প্রবীণ নিবাসের প্রাঙ্গণে পাক খায়। একটা বউ কথা কও পাখি ডেকে ওঠে, ঠিক সেই সময়...হাজারী টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা নূপুর বের করেন। হাতে ধরে তা বাজাতে থাকেন, বলেন, কী সুন্দর শব্দ হয়, না!