Thank you for trying Sticky AMP!!

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

জোড়া ষড়যন্ত্র ও একটি শবদাহ

ঔপন্যাসিক, লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট অরুন্ধতী রায়ের জন্মদিন আজ। তাঁর এই মতামত কলামটি গত ৩ অক্টোবর প্রথম প্রকাশিত হয় ভারতীয় ডিজিটাল গণমাধ্যম স্ক্রল ডট ইনে। এ লেখায় হাথরাসে দলিত সম্প্রদায়ের তরুণীকে ধর্ষণ ও হত্যা, দিল্লিতে নাগরিকত্ব বিলবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বাবরি মসজিদ মামলার রায়ের ইস্যুগুলোকে এক সুতায় বেঁধেছেন তিনি। নিজের চিরচেনা ভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করেছেন সেই কমন প্যাটার্ন, যা এই তিনটি ঘটনারই নিয়ামক। আজ এই লেখকের ৫৯তম জন্মদিনে ঈষৎ সংক্ষেপিত করে বের হলো সর্বশেষ প্রকাশিত তাঁর এই লেখা। অনুবাদ করেছেন মুশফেকা ইসলাম

চলুন, আমরা তাঁদেরই ভোট দেওয়া জারি রাখি, যাঁরা আমাদের ঠেলে দিচ্ছেন চরম দারিদ্র আর যুদ্ধের দিকে। যাঁরা আমাদের নৃশংসভাবে আঘাত করছেন, মেরে ফেলছেন।

দীপাবলি উৎসবের দিন যত এগিয়ে আসছে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা জোরেশোরে প্রস্তুত হচ্ছে প্রভু রামের বিজয়ী বেশে নিজ রাজ্যে ফিরে আসা উদ্‌যাপনের জন্য (এবং অযোধ্যায় যে ঝাঁ–চকচকে মন্দিরটি প্রভুর তরে তৈরি হচ্ছে, তার জন্যও)। আর বাদবাকি আমাদের জন্যও চলতি মৌসুমে ভারতীয় গণতন্ত্রের অব্যাহত জয়ের ধারা নিশ্চয়ই বিপুল আনন্দ আর উদ্‌যাপনের বিষয়। খানিক অস্বস্তিকর একটি মড়া পোড়ানোর ব্রেকিং নিউজ এবং এক বিরাট ষড়যন্ত্রকে মাটিচাপা দিয়ে আরেকটা শুরু করার এই প্রক্রিয়ার ভেতর আমরা কি নিজেদের নিয়ে, আমাদের ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক সংস্কৃতি-সভ্যতার মূল্যবোধ নিয়ে গর্ব না করে পারি?

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর প্রদেশে এক উনিশ বছর বয়সী নিম্নবর্ণের মেয়েকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও নিষ্ঠুর শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা খবরে আসে। ধর্ষকেরা তারই গাঁয়ের লোক। উচ্চবর্ণের হিন্দু। মেয়েটিকে মরার জন্য ফেলে রেখে গিয়েছিলেন তাঁরা। মেয়েটির পরিবার ওই হাথরাস গ্রামের পনেরো ঘর দলিতের একটি, যেখানে বাদবাকি ৬০০ ঘরই উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ আর ঠাকুরদের (ভূমিপতি)। উত্তর প্রদেশের গেরুয়াধারী মুখ্যমন্ত্রী অজয় সিংহ বিশত, যাঁর আরেক নাম যোগী আদিত্যনাথ, ওই একই জাতের লোক। (যত দূর জানা যায়, অদূর ভবিষ্যতে তাঁকেই নরেন্দ্র মোদির স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য তৈরি করা হচ্ছে)

মেয়েটিকে বেশ কিছুদিন ধরে এই আক্রমণকারীরা অনুসরণ করছিলেন। ভয় দেখিয়ে আসছিলেন। সাহায্য চাওয়ার মতো কেউ ছিল না ওর। ওকে রক্ষা করারও কেউ ছিল না। তাই মেয়েটি বাড়িতেই থাকত। বাইরে যেত না বড় একটা। মেয়েটি ও তার পরিবার ঠিকই বুঝতে পেরেছিল, তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। কিন্তু সেই বুঝতে পারাটা শেষতক কোনো কাজে আসেনি। গরু চরাতে গিয়ে মা দেখতে পেলেন, তাঁর প্রিয় কন্যার রক্তাক্ত শরীর মাঠে পড়ে আছে। দেখলেন, ওর জিহ্বা প্রায় ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়ে চলতশক্তিহীন পড়ে আছে তাঁর মেয়ে।

মেয়েটি এরপর দুই সপ্তাহ বেঁচে ছিল। প্রথমে তাকে আলীগড়ের একটা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থা আরও খারাপ হলে পরে নেওয়া হয় দিল্লিতে। ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে মারা যায় মেয়েটি। গত বছর ভারতে সংঘটিত ১৭০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সফলতার সঙ্গে ৪০০ হত্যাকাণ্ড পরিচালনার জন্য সুবিদিত উত্তর প্রদেশ পুলিশ বিভাগ এরপর একদম সময় নষ্ট করেনি। তারা মাঝরাতেই মেয়েটির মৃতদেহ সরিয়ে নিয়ে যায়। তারপর গাড়িতে করে গ্রামের বাইরে নিয়ে তাকে পুড়িয়ে ফেলে। তারা মেয়েটির ভীত-শোকগ্রস্ত পরিবারটিকে আটকে রেখেছিল। তাই মৃত মেয়ের মুখটি একনজর দেখার, বিদায় জানানোর সুযোগ পাননি মা। মৃত প্রিয়জনকে সম্মানের সঙ্গে পৃথিবী থেকে বিদায় জানানোর শেষ আনুষ্ঠানিকতাটুকু আয়োজনেরও সুযোগ পায়নি হাথরাস গ্রামের দলিত সম্প্রদায়ের মানুষগুলো। এমনকি দাহ করা শবটি যে তাদের কন্যারই ছিল, সেটাও স্পষ্ট করে বলা হয়নি তাদের।

খুন হওয়া মেয়েটির বিধ্বস্ত শরীর তাড়াহুড়োয় তৈরি একটি চিতায় তোলা হয়েছিল। খাকি রঙের মানবদেয়ালের পেছন থেকে সেই চিতার আগুনের ধোঁয়া উঠে যাচ্ছিল রাতের আকাশের পানে। মেয়েটির পরিবার দাঁড়িয়েছিল জড়সড়, ঘন হয়ে। মিডিয়ার মনোযোগের আগুনের ভয়ে ভীত, ত্রস্ত। কেননা তারা ভালোই জানে, যখনই ক্যামেরার আলোগুলো মিলিয়ে যাবে, মিডিয়ার মনোযোগ পাওয়ার দোষে আরেক দফা শাস্তি ভোগ করতে হবে তাদের।

এ যাত্রায় বেঁচে গেলে তারা আবার ফিরে যাবে তাদের অভ্যস্ত জীবনে। মধ্যযুগীয় নিষ্ঠুরতার যে জীবন তারা যাপন করে আসছে তাদের মধ্যযুগীয় জাতপাতওয়ালা গ্রামটিতে, যেখানে অসম্মানটা তারা প্রাপ্য হিসেবে ভাগে পায়। যেখানে তাদের অচ্ছুত আর ঊনমানুষ হিসেবে দেখে সমাজ।

লাশটি যে সফলতার সঙ্গে লোপাট করা গেছে, সেটা নিশ্চিত হয়েই শবদাহের এক দিন পর পুলিশ ঘোষণা করে যে মৃত মেয়েটিকে মোটেই ধর্ষণ করা হয়নি। তাকে শুধু খুন করা হয়েছিল। শুধু খুন। এভাবে শুরুতেই জাতপাতের প্রসঙ্গটি জাতিগত নৃশংসতার এই ঘটনা থেকে দ্রুততার সঙ্গে আলাদা করে ফেলা হয়। তদন্তপ্রক্রিয়া কোন পথে যাবে সেটাও স্পষ্ট হয়ে যায়। জাতিগত ঘৃণা থেকে উৎপন্ন এই নৃশংসতা আরেকটি দুঃখজনক কিন্তু সাধারণ অপরাধ হিসেবে পর্যায়ক্রমে চালিয়ে দেওয়া হবে। আর আশা করা যায়, আদালত, হাসপাতালের নথি আর মূল ধারার গণমাধ্যমসহ সবাই এই প্রক্রিয়ায় সহযোগী ভূমিকা রাখবে।

আসল কথা হলো, সমাজের দোষগুলো মাফ করে দিলে আমাদের মূল্যবান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রথাগুলো চর্চায় বরং সুবিধা হয়। বরাবর আমরা তেমনটাই দেখে এসেছি। সবচেয়ে নিষ্ঠুরভাবে এ সত্য আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ২০০৬ সালের খারলাঞ্জি ম্যাসাকার, সুরেখা ভোটমাঙ্গে ও তাঁর দুই শিশুর প্রতি হওয়া সেই নির্মমতার ঘটনায়।
ভারতীয় জনতা পার্টির নির্বাচনী ওয়াদা, আমাদের দেশের গৌরবময় অতীত ফিরিয়ে আনবে তারা। তাদের সেই প্রচেষ্টা বাস্তবায়নের জন্য আগামী নির্বাচনে যদি পারেন, অজয় সিংহ বিশতকে ভোট দিতে ভুলবেন না। যদি অজয় না হন, তাহলে আপনার এলাকার যেকোনো মুসলমান-খেদানো, দলিত-পেটানো নেতা–নেত্রীকে জয়যুক্ত করুন। সামাজিকমাধ্যমে আগামীবার গণপিটুনিতে হত্যার যে ভিডিও আপলোড হবে, সেটিতেও ‘লাইক’ চাপবেন মনে করে। আর টিভির পর্দায় আপনার প্রিয়, বিষ-উগড়ানো উপস্থাককে দেখাও চালিয়ে যান, কারণ সে-ই আমাদের সামষ্টিক চেতনার ধারক ও বাহক।

সেই সঙ্গে, এ বিষয়ে শুকরিয়া আদায় করতে ভুলবেন না যে আমরা এখনো ভোট দিতে পারছি। ভুলবেন না, আমরা বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং আমাদের এই পরিচয় আমাদের সেই সব প্রতিবেশীর চাইতে আলাদা, যাদের আমরা ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ বলে ডাকতে ভালোবাসি। ভারতের আছে নিরপেক্ষ আদালত, যা আইনের শাসন বজায় রাখতে কাজ করে যাচ্ছে নিরলস। এই যেমন ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের এক বিশেষ আদালত নিরপেক্ষতা ও সততার এক শক্তিশালী নমুনা দেখাল আমাদের। হাথরাসের সেই লজ্জাকর ও ভীতিকর শবদাহের ঘটনার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পার হতেই।

খুন হওয়া মেয়েটির বিধ্বস্ত শরীর তাড়াহুড়োয় তৈরি একটি চিতায় তোলা হয়েছিল। খাকি রঙের মানবদেয়ালের পেছন থেকে সেই চিতার আগুনের ধোঁয়া উঠে যাচ্ছিল রাতের আকাশের পানে। মেয়েটির পরিবার দাঁড়িয়ে ছিল জড়সড়, ঘন হয়ে। মিডিয়ার মনোযোগের আগুনের ভয়ে ভীত, ত্রস্ত। কেননা তারা ভালোই জানে, যখনই ক্যামেরার আলোগুলো মিলিয়ে যাবে, মিডিয়ার মনোযোগ পাওয়ার দোষে আরেক দফা শাস্তি ভোগ করতে হবে তাদের।

২৮ বছর ধরে অনেক আলোচনা ও শুনানির পর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিযুক্ত ৩২ জনকেই বেকসুর খালাস দিল আদালত। আধুনিক ভারতের ইতিহাসের মোড় পালটে দেওয়া সেই বাবরি মসজিদ হামলা।

এই খালাস পাওয়াদের দলে আছেন এক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এক সাবেক ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও এক তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী। এই রায় অনুসারে মূল ব্যাপারটা যা দাঁড়াল তা হলো, বাবরি মসজিদ কেউ ভাঙেনি। অন্তত আইনের হিসেবে তো নয়ই। মসজিদটি বোধ হয় নিজে নিজেই ভেঙে গেছে। বোধ হয় ২৮ বছর আগে মসজিদটি নিজে থেকেই ৬ ডিসেম্বর দিনটিকে নিজেকে গুঁড়িয়ে ধূলিসাৎ করার জন্য বেছে নিয়েছিল। যে দিনটি কি না বাবাসাহেব আম্বেদকরের জন্মদিনও। উপস্থিত গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা ঠগীর বা ভক্ত দলের সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তির জোরেই বোধ হয় নিজে নিজেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়েছিল মসজিদটি।

তার মানে, পুরোনো মসজিদটির গম্বুজে হাতুড়ি-পেটানো লোকদের যে ছবি ও ভিডিও আমরা দেখেছি, প্রত্যক্ষদর্শীদের যে সাক্ষ্য আমরা পড়েছি ও শুনেছি, মাসের পর মাস ধরে গণমাধ্যম যেসব খবর ছেপেছিল, তার সবটাই স্রেফ আমাদের কল্পনা। এমনকি এল কে আদভানির সেই রথযাত্রা কর্মসূচিও। খোলা ট্রাকে তাঁর ভারতের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সফর, বিশাল জনসভায় ভাষণ, রাস্তাঘাট অবরোধ, প্রকৃত হিন্দুদের অযোধ্যায় জড়ো হয়ে ঠিক মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির তৈরির উপদেশ—এসবের কোনোটাই কখনো ঘটেনি।

তাঁর রত্রযাত্রার পেছনে যে লাশের সারি ও ধ্বংসাবশেষ রেখে যাচ্ছিল, সেটিও ঘটেনি কোনো কালে। কেউ কখনো স্লোগান দেয়নি, ‘এক ধাক্কা অওর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো’। আমরা আদতে দেশব্যাপী একটি সমষ্টিগত হ্যালুসিনেশনে ভুগেছি এতকাল। আমরা কোন গাঁজা খাচ্ছিলাম রে বাবা? মাদক নিয়ন্ত্রণ ব্যুরো আমাদের এত দিন তলব করেনি কেন? শুধু বলিউডের কলাকুশলীদেরই কেন জেরা করা হচ্ছে? আইনের দৃষ্টিতে না আমরা সবাই সমান?

আন্দোলনে সোচ্চার অরুন্ধতী রায়

কেন মসজিদ ভাঙার ঘটনাটি পরিকল্পিত নয়, সে বিষয়ে বিশেষ আদালতের সম্মানিত বিচারক একটি ২৩০০ পৃষ্ঠার বিশদ রায় লিখেছেন। পরিকল্পনার অভাব নিয়ে ২৩০০ পৃষ্ঠা! মানতেই হবে যে তিনি একটি অসাধ্য সাধন করেছেন। তিনি এখানে লিখেছেন, কীভাবে বিষয়টি কোনোমতেই প্রমাণ করা যায় না যে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা একটি কক্ষে বসে মসজিদটি ভাঙার পরিকল্পনা করেছিলেন। সম্ভবত এই কারণে যে পরিকল্পনাটি আদতে করা হয়েছিল ঘরের বাইরে। আমাদের রাস্তাগুলোয়, জনসমাবেশে, আমাদের টিভির পর্দায়, যাতে আমরা সবাই–ই এতে অংশ নিতে পারি? নাকি এটাও আবার সেই মালের রেশ, যার জন্য এই সব উদ্ভট চিন্তা আসছে মাথায়?

যা হোক, বাবরি মসজিদ ষড়যন্ত্র এখন পুরোনো হয়ে গেছে। তার জায়গায় আরেকটা এসেছে, যেটা নতুন ও ভাইরাল। নতুনটি হলো ২০২০ সালের দিল্লি ম্যাসাকার। উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে কর্মজীবী মানুষদের এলাকায় এ ঘটনায় ৪০ মুসলিমসহ ৫৩ জন নিহত এবং ৫৮১ জন আহত হয়েছে। মসজিদ, কবরস্থান আর মাদ্রাসাগুলো ছিল হামলার লক্ষ্য। যেসব বাড়িঘর, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোয় আগুন দেওয়া হয়, ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, তারও বেশির ভাগ ছিল মুসলিমদের মালিকানায়।

এই ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে দিল্লি পুলিশের দেওয়া হাজার হাজার পৃষ্ঠার চার্জশিটে কিছু লোকের টেবিল ঘিরে বসে থাকার একটি ছবিও সংযুক্ত আছে। আরে হ্যাঁ! অফিস বেজমেন্টের মতো দেখতে একটি ঘরে বসে তাঁরা পরিকল্পনা আঁটছেন, এমন একটি ছবি। ছবিতে তাঁদের অভিব্যক্তি দেখেই বলে দেওয়া যায়, তাঁরা হামলার পরিকল্পনা করছিলেন। অভিযুক্ত হিসেবে তীর চিহ্ন দিয়ে নির্দেশ করে, তাদের নাম–পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে এই চার্জশিটে। ভয়ংকর ব্যাপার!

বাবরি মসজিদের গম্বুজের ওপর হাতুড়ি-মারা লোকগুলোর চাইতেও তাঁরা বেশি ভয়াবহ। ছবিতে টেবিল ঘিরে বসা মানুষদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে জেলে আছেন। বাকিদেরও হয়তো শিগগিরই জেলে পোরা হবে। গ্রেপ্তারে কয়েক মাস সময় লেগেছে। ছাড়া পেতেও অনেক বছর লেগে যেতে পারে। যদি বাবরি–বিচারের অভিজ্ঞতা আমলে নিই, কে জানে হয়তো ২৮ বছরও লেগে যেতে পারে রায় আসতে।

বেআইনি কার্যকলাপ দমন আইনের (ইউএপিএ) অধীনে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এই আইন অনুসারে অবশ্য প্রায় সবকিছুই অপরাধ। এমনকি মনে মনে দেশবিরোধী ভাবনা ভাবাও। এই আইনে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের দায় সম্পূর্ণভাবে অপরাধীর ওপর বর্তায়। আমি যতই এই আইন আর একে ঘিরে পুলিশের নানা কার্যক্রম সম্পর্কে পড়ছি, ততই মনে হচ্ছে এটা যেন একজন সুস্থ মানুষের একদল পাগলের সামনে তার সুস্থতা প্রমাণের পরীক্ষা।

আমাদের বিশ্বাস করতে বলা হচ্ছে যে দিল্লি ষড়যন্ত্র হলো এনপিআর, এনআরসি আর সিএএ বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া মুসলিম ছাত্র ও অ্যাক্টিভিস্ট, গান্ধীবাদী, শহুরে নকশাল ও বামপন্থীদের একটি সম্মিলিত ষড়যন্ত্র। কারণ এরা মনে করে, এটি বাস্তবায়িত হলে ভারতের সেই সব মুসলিম ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী, নাগরিকত্ব প্রমাণের সনদ নেই যাঁদের, তাঁদের পায়ের তলার মাটি সরে যাবে। আমিও তেমনটাই মনে করি এবং আমি মনে করি, যদি সরকার তাঁদের এই প্রকল্প সামনে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, আবারও প্রতিবাদ শুরু হবে, যা হওয়া উচিত।

পুলিশের মতে, দিল্লি ষড়যন্ত্রের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরকালে সহিংসতা উসকে দিয়ে এবং সাম্প্রদায়িক বিরোধ তৈরি করে সরকারকে বিব্রত করা। যে অমুসলিমদের নাম চার্জশিটে এসেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তাঁরা এই আন্দোলনকে অসাম্প্রদায়িক চেহারা দিতে ষড়যন্ত্র করেছে। অবস্থান কর্মসূচি ও আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া হাজারো মুসলিম নারীর বিষয়ে অভিযোগ হলো, তাঁদের ডেকে এনে এই আন্দোলনকে একধরনের ‘জেন্ডার কভার’ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

এই আন্দোলনকে ঘিরে পথে পথে পতাকা দোলানো, ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার গণপাঠ এবং প্রতিবাদী কবিতা, গান ও ভালোবাসার বান ছুটেছিল। তবে সেগুলোকে আন্দোলনকারীদের হীন উদ্দেশ্য গোপন করার ছল বা কূটকৌশল হিসেবে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, তাদের মতে এই আন্দোলনের মূলটা হলো জিহাদি। বাদবাকি সব আলঙ্কারিক, লোকদেখানো।

আমার পরিচিত তরুণ বিদ্বান ড. উমর খালিদ, যিনি বহু বছর ধরে গণমাধ্যমের নির্যাতন, জ্বালাতন ও গুজবের শিকার, সেই তাঁকেই পুলিশ এই ষড়যন্ত্রের মূল হোতা হিসেবে ঠাউরেছে। তাঁর বিরুদ্ধে যে প্রমাণ সংগৃহীত হয়েছে, পুলিশের ভাষ্যমতে তা দশ লাখ পৃষ্ঠার বেশি। (এটা কিন্তু সেই একই সরকার যারা ঘোষণা করেছিল যে শত শত বা হাজারো মাইল পায়ে হেঁটে গ্রামে ফেরা এক কোটি শ্রমিকের ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। মার্চে মোদির ডাকা পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম কোভিড-১৯ লকডাউনের সময় এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে শ্রমিকদের কত জন মারা গেছেন, কত জন অভুক্ত থেকেছেন বা অসুখে পড়েছেন সে বিষয়ে কোনো ধারণা নেই তাদের।)
উমর খালিদসহ সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া শত শত মুসলিম আন্দোলনকারী এখন জেলে।

বেআইনি কার্যকলাপ দমন আইনে (ইউএপিএ) তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ হলো হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও দাঙ্গা সংঘটন। ১০ লাখ পৃষ্ঠার ‘প্রমাণ’ পর্যালোচনা করতে আদালত ও আইনজীবীদের কত জনম লেগে যাবে, কে জানে!

বাবরি মসজিদের ক্ষেত্রে যেমন সে নিজেই নিজেকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল বলে মনে হয়, ২০২০ সালের দিল্লি ম্যাসাকার নিয়েও পুলিশের ভাষ্য ঠিক একই রকম। মুসলিমরা নিজেরাই নিজেদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছে। নিজেদের মসজিদ পুড়িয়েছে, বাড়িঘর ধ্বংস করেছে। নিজেদের শিশুদের অনাথ করেছে। আর এর সবই শুধু ট্রাম্পকে এটা দেখানোর উদ্দেশ্যে যে ভারতে তারা কত কষ্টে আছে।

আমি মনে করি, এই ১০ লাখ পৃষ্ঠার প্রমাণ এবং ২ হাজার পৃষ্ঠার রায়ের জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ এগুলো প্রমাণ করে যে গণতন্ত্র নামের শবটি এখনো ঘষটে ঘষটে পথ চলছে। হাথরাসের খুন হওয়া মেয়েটার মতো এটিকে এখনো পুড়িয়ে ফেলা হয়নি। লাশ হয়েও এটি তার কাজ করে যাচ্ছে, অন্যান্য বিষয়ের গতি ধীর করে দিচ্ছে।

এই মামলা আরও শক্ত করতে পুলিশ চার্জশিটে সংযুক্তি হিসেবে ছাত্র ও অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যকার হোয়াটসঅ্যাপ আলাপের শত শত পৃষ্ঠা জুড়ে দিয়েছে।

দিল্লিতে হঠাৎ বেগ পাওয়া আন্দোলন ও শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচির সময় ও স্থান নিয়ে ছাত্র, অ্যাক্টিভিস্ট ও সমর্থকদের মধ্যে সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে এসব হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ কাজ করছিল।

ছাত্র-অ্যাক্টিভিস্টদের হোয়াটসঅ্যাপ আলাপের বেশির ভাগই ছিল তারুণ্যের প্রেরণা ও লক্ষ্যে ভরপুর। যুক্তিসংগত ক্ষোভের অনুভূতিতে ভর করে নিজের কাজটা চালিয়ে যাওয়াই ছিল মূল কথা। আমার জন্য তাঁদের সেই কথপোকথনে চোখ বুলানো ছিল উদ্দীপনা–জাগানিয়া, যা আমাদের সেই কোভিডপূর্ব উদ্দাম দিনগুলোয় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আর নতুন প্রজন্মকে আত্মবিশ্বাস ও পরিপক্বতার সঙ্গে সামনে এগিয়ে যেতে দেখার উত্তেজনাও তো কম উপভোগ্য নয়। সেখানে কিছুটা অভিজ্ঞ অ্যাক্টিভিস্টরাও আলাপ তুলেছেন। বারবার আন্দোলনকারীদের শান্ত ও সুস্থির থাকার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সতর্ক করেছেন। তাঁরাও উত্তরে অপ্রয়োজনীয় তর্ক ও ঝগড়া করে গেছেন, যেমনটা অ্যাক্টিভিস্টরা করে থাকেন, যা কিনা গণতন্ত্রচর্চারই অংশ।

দিল্লি আন্দোলনের এসব হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কিছু অ্যাক্টিভিস্ট মত দিলেন যে রাস্তা অবরোধ করার সিদ্ধান্তে হিতে বিপরীত হবে। উত্তরে অন্যরা যুক্তি দিলেন, সড়ক অবরোধ করে জোরপূর্বক শহরবাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করা না গেলে তাঁদের দাবি পাত্তা পাবে না। এরপর দেখা গেল, কিছু এলাকায় আন্দোলনকারীরা রাস্তা আটকে প্রতিবাদ করছেন। যেমনটা ধারণা করা হয়েছিল, তাই হলো এরপর।

আন্দোলনকারীদের এই পদক্ষেপ অস্ত্রধারী, সহিংস স্লোগান–আওড়ানো হিন্দু জনতাকে সেই সুযোগ এনে দিল, যার অপেক্ষায় ওত পেতে ছিল তারা।

পরবর্তী কয়েক দিন ধরে তারা যে লাগামহীন নির্মমতা চালাল, তা দেখে আমাদের আত্মা উড়ে গেল। ভিডিওগুলোতে আমরা দেখলাম, পুলিশ খোলাখুলিভাবে তাদের সাহায্য করছে, সমর্থন দিচ্ছে।

মুসলিমরাও রুখে দাঁড়িয়েছে। এই আন্দোলনে দুই পক্ষেরই জানমালের ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ সমান নয়। এ ক্ষেত্রে সমতার হিসাব খাটবে না।

অরুন্ধতী যখন নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে

সহিংসতাকে ফুলেফেঁপে ওঠার ও ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। আমরা অবিশ্বাসের সঙ্গে চেয়ে দেখলাম সেই দৃশ্য, যেখানে গুরুতর আহত মুসলিম তরুণেরা রাস্তায় শুয়ে আছেন। আর ঘিরে থাকা পুলিশ জাতীয় সংগীত গাইবার জন্য তাঁদের সঙ্গে জবরদস্তি করছে। তাঁদের একজন, ফাইজান, কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যান।
এ সময় সাহায্য চেয়ে করা শত শত ফোনকল পুলিশ এড়িয়ে গিয়েছিল। একসময় অগ্নিসংযোগ আর হত্যাযজ্ঞের তেজ কমে এল।

অভিযোগগুলোও শেষমেশ গ্রহণ করা হলো। তবে ভিক্টিমরা বলেছে, হামলাকারীদের নাম-পরিচয় এবং বন্দুক-তলোয়ারধারী জনতার মুখের সাম্প্রদায়িক স্লোগান অভিযোগ থেকে মুছে ফেলার জন্য পুলিশ তাদের চাপ দিয়েছিল। অপরাধীদের বাঁচাতে এভাবেই সুনির্দিষ্ট অভিযোগগুলোকে সাধারণ অভিযোগে পালটে ফেলা হলো (ঘৃণাপ্রসূত অপরাধের ঘটনাটি থেকে ঘৃণাকেই মুছে ফেলা হলো)।

এরই মধ্যে বিভিন্ন স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিবেদন ও নাগরিক সংগঠনগুলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলোতে এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আলোচনায় উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে সহিংসতার ঘটনায় সহযোগিতার জন্য পুলিশকে দায়ী করা হয়েছে। আমাদের সবার দেখা সেই সব চরম সহিংস ভিডিওগুলো পর্যালোচনা করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের আগস্ট মাসের প্রতিবেদনে বলেছে যে আন্দোলনকারীদের মারধর-নির্যাতন এবং আক্রমণকারী জনতার সঙ্গে সহযোগী হিসেবে থাকার দোষে দোষী দিল্লির পুলিশ। সেই থেকেই অ্যামনেস্টির বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আনা হয় এবং তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়। শেষে সংস্থাটিকে ভারত থেকে তাদের কার্যক্রমই গুটিয়ে ফেলতে হলো এবং তাদের ১৫০ কর্মী চাকরি হারালেন।

যখন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকে, তখন প্রথম যাঁরা দেশ ছেড়ে যান বা যাঁদের ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়, তাঁরা হলেন বিদেশি পর্যবেক্ষক। কোন দেশগুলোতে আমরা এই প্যাটার্ন আগেও লক্ষ করেছি? ভাবুন অথবা গুগল করুন।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলে ভারত একটি স্থায়ী আসন চাইছে, বৈশ্বিক নানা ইস্যুতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চাইছে। আবার সেই পাঁচ দেশের কাতারেও দেশটি থাকতে চায় যারা কি না নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চুক্তিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবে না। আদতে ভারত চায় একটি একদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে, যেখানে জবাবদিহিতার কোনো বালাই থাকবে না।

পুলিশ প্রযোজিত ২০২০ সালের অযৌক্তিক দিল্লি ষড়যন্ত্র এবং সমানভাবে যুক্তিহীন ২০১৮ সালের ভীমা-কোরেগাঁও ষড়যন্ত্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো অ্যাক্টিভিস্ট, ছাত্র, আইনজীবী, লেখক, কবি, অধ্যাপক, ট্রেড ইউনিয়নপন্থী এবং অবাধ্য এনজিওগুলোকে বন্দী করা ও চাপে রাখা।

আমি মনে করি, এই ১০ লাখ পৃষ্ঠার প্রমাণ এবং ২ হাজার পৃষ্ঠার রায়ের জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ এগুলো প্রমাণ করে যে গণতন্ত্র নামের শবটি এখনো ঘষটে ঘষটে পথ চলছে। হাথরাসের খুন হওয়া মেয়েটার মতো এটিকে এখনো পুড়িয়ে ফেলা হয়নি। লাশ হয়েও এটি তার কাজ করে যাচ্ছে, অন্যান্য বিষয়ের গতি ধীর করে দিচ্ছে। অবশ্য সেই দিন দূরে নয় যখন এই শবকে ছুড়ে ফেলা হবে এবং ধীরে চলা বিষয়গুলো গতি পাবে। আমাদের শাসকদের অনুচ্চারিত স্লোগানটি তখন বোধ হয় হবে, ‘এক ধাক্কা অওর দো, ডেমোক্রেসি গাঁড় দো’। গণতন্ত্রের গোর দাও।

দিনটি যখন আসবে, এক বছরে ১৭০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে তখন নিকট অতীতের সুখস্মৃতি হিসেবে মনে পড়বে আমাদের।

দেখুন, এই সব ছোটখাটো কারণে আমাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেললে চলবে না। বরং চলুন, আমরা ভোট দিয়ে যাই তাঁদের, যাঁরা আমাদের ঠেলে দিচ্ছেন চরম দারিদ্র্য আর যুদ্ধের দিকে, যাঁরা আমাদের নৃশংসভাবে মেরে ফেলছেন।
তাঁরা অন্তত একটা জবর মন্দির বানাচ্ছেন আমাদের জন্য। সেটাই বা কম কী!

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com