Thank you for trying Sticky AMP!!

কনফেশনস অব আ সিনেগাওয়া মাংকি

হারুকি মুরাকামি

গল্প প্রসঙ্গে
বিখ্যাত জাপানি ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক হারুকি মুরাকামির জন্ম ১২ জানুয়ারি, ১৯৪৯ সালে জাপানের কিয়োটোতে। দেশকালের সীমানার গণ্ডিতে তিনি আটকে নেই। সমগ্র দুনিয়ায় জনপ্রিয় তিনি। এটা সম্ভব হয়েছে তাঁর সরল গদ্য ভাষা, বিষয়বস্তু, আর গল্প বলার জাদুকরি ঢংয়ের কারণে। পৃথিবীর সর্বাধিক বিক্রিত আর আলোচিত লেখকদের মধ্যে অগ্রগণ্য তাঁর নাম। ইতিমধ্যে বিশ্বের প্রায় ৫০ টি ভাষায় তাঁর লেখা অনুদিত হয়েছে। 'কনফেশনস অব এ্যা সিনেগাওয়া মাংকি' গল্পটা এই বছরের ১ জুন মাসের এক 'দ্যা নিউইয়র্কার' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেই হিসেবে এখনো বেশ তাজা গল্পটা। এমনকি মুরাকামির কোনো বইয়েও এটা এখন অব্দি স্থান পায়নি। আগামী মাসে তার নতুন একটা ছোটগল্পের বই বের হওয়ার কথা। এটা সেই বইয়েরই একটা গল্প। গল্পটা সম্পর্কে সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, এটা একটা টিপিক্যাল মুরাকামি স্টোরি। বাস্তবতাকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে এক ধরনের মেটাফরিক্যাল উপস্থাপনা, যা পাঠককে বিব্রতকর কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়; এবং অবশ্যই এসব প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা হতে চাই না। গল্পটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন আলভী আহমেদ

বছর পাঁচেক আগের কথা। অদ্ভুত এক বানরের সঙ্গে আমার দেখা হয়, অদ্ভুত এবং বুড়ো। গুনমা এলাকার একটা হট-স্প্রিং শহরে জাপানিজ স্টাইলের একটা মোটেলে সেবার আমি রাত কাটিয়েছিলাম। গ্রাম্য সেই মোটেলের ছিল খুবই জীর্ণদশা, ভেঙে পড়ার অপেক্ষায় কষ্ট করে যেন শরীরটাকে ধরে রেখেছে। সেখানেই বানরটার সঙ্গে আমার কথা হয়।

সে সময়টায় আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য আমার ছিল না। মন যেখানে চায়, সেখানেই যাচ্ছিলাম। ওই শহরে যখন ট্রেন থেকে নামলাম, তখন সন্ধ্যা সাতটার কিছু বেশি বাজে। হেমন্ত প্রায় বিদায় নিয়েছিল। সূর্য অনেকক্ষণ আগেই ডুবে গেছে। পুরো জায়গাটা একটা গাঢ় নীল রঙের অন্ধকারে ডুবে আছে। পর্বতের চূড়া থেকে ঠান্ডা কনকনে বাতাস বইছিল। রাস্তাজুড়ে ছিল ঝরাপাতার উৎসব।

শহরের মধ্য দিয়ে আমি কিছুক্ষণ হাঁটলাম। আসলে রাতটা কাটানোর মতো একটা জায়গা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলাম। হোটেল–মোটেল মিলিয়ে পাঁচ–ছয়টা জায়গায় ঢুঁ মারলাম। কিন্তু কোনো ভদ্রগোছের থাকার জায়গা খুঁজে পেলাম না। সম্ভবত ডিনার টাইম পার হওয়ার পরে তারা নতুন কোনো অতিথির চেক ইন করে না।

হাঁটতে হাঁটতে শহরের বাইরে বেশ নির্জন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছলাম, শহরতলি বলা যেতে পারে সেটাকে। সেখানে বেশ পুরোনো ধাঁচের একটা নিঃসঙ্গ মোটেল ছিল। ওই মোটেলে আমার জন্য একটা রুম জুটে গেল। বিল্ডিংটা দেখে মনে হচ্ছিল, জীবনের অনেকগুলো বছর ইতিমধ্যেই সে দেখে ফেলেছে। পুরোনো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পুরোনো মোটেল বা সরাইখানায় রাত কাটানোর ব্যাপারে মনের মধ্যে যে রকম একটা রোমান্টিসিজম জাগার কথা, তা জাগল না মোটেই। নড়বড়ে অবস্থা, যেকোনো সময় ভেঙে পড়ার জন্য যেন তৈরি হয়ে আছে। শুধু একটা জুতসই ভূমিকম্পের অপেক্ষা। মনে হলো, আজ রাতে সে ভূমিকম্পটা না এলেই এ যাত্রা বেঁচে যাব।

মোটেলে ডিনারের কোনো ব্যবস্থা নেই। কিন্তু সকালে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট আছে। ভাড়া খুবই কম। দরজা দিয়ে ঢুকতেই রিসিপশন ডেস্ক। টাক মাথার এক বুড়ো সেখানে বসে আছে। ভালো করে দেখতেই খেয়াল করলাম, তার শরীরে দৃশ্যমান কোনো চুল নেই, এমনকি চোখের ভ্রু পর্যন্ত নেই। ভ্রু না থাকায় তার বড় বড় চোখগুলো খুবই বিশ্রীভাবে জ্বলজ্বল করছিল। ঠিক পাশেই মেঝেতে বালিশ পেতে একটা বড় বাদামি রঙের বিড়াল নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। বিড়ালটার নাকে বোধ হয় কোনো সমস্যা আছে। এত জোরে যে বিড়াল নাক ডাকতে পারে, এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা ছিল না। একটা নির্দিষ্ট ছন্দে তার নাক থেকে ঘর্ঘর করে শব্দ বের হচ্ছে। মাঝেমধ্যে রিদমটা একটু এদিক–সেদিক হচ্ছিল। পুরো মোটেলটা দেখে আমার মনে হলো, সবকিছু বেশ পুরোনো এবং বাকি দুনিয়ার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

যে রুমে আমাকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল, সেটা বেশ আজব ধরনের। ওটা আসলে গেস্ট থাকার রুম নাকি বিছানা-বালিশ-বেডিং রাখার গুদামঘর, সেটাই টের পাচ্ছিলাম না। তবে এটাও ঠিক, সেখানে না থেকে আমার কোনো উপায় ছিল না। রাত হয়ে গিয়েছিল অনেক। এত রাতে কোনো কিছু নিয়ে খুঁতখুঁত করা সাজে না। নিজেকেই বোঝালাম, মাথার ওপর একটা ছাদ এবং ঘুমানোর জন্য একটা বিছানা হলেই তো হয়, এতেই আমার বেশ খুশি থাকা উচিত।

লাগেজ এবং কাঁধের ব্যাগটা ফ্লোরে রেখে আমি হোটেলের বাইরে বের হলাম। রাতে কিছু একটা খেতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে কাছেই একটা সোবা-নুডলসের দোকান পেয়ে গেলাম। সেখানেই ডিনার সারলাম। আসলে ব্যাপারটা ছিল এমন যে হয় আমাকে ওই নুডলস খেতে হবে, নাহয় কিছু না খেয়ে রাতটা পার করে দিতে হবে। আমার জন্য অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। কারণ, আর কোনো রেস্টুরেন্ট খোলা নেই। অবশ্য আমি নুডলসের সঙ্গে একটা বিয়ার আর অল্প কিছু স্ন্যাকসও খেলাম। নুডলসের স্বাদ একদমই ভালো ছিল না। খাবারটা আসলে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। তারপরও আমার কোনো অভিযোগ ছিল না। কিছু না খেয়ে ঘুমানোর চেয়ে অন্তত কিছু খেয়ে বিছানায় যাওয়াটা ভালো।

দোকান থেকে বেরিয়ে মনে হলো, কিছু স্ন্যাকস–জাতীয় খাবার কিনে নেওয়া উচিত। সঙ্গে এক বোতল হুইস্কি হলে আরও ভালো। কিন্তু আশপাশে কোনো কনভেনিয়েনস স্টোর খুঁজে পেলাম না। রাত আটটার পর সম্ভবত এখানকার সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। শুধু একটা জায়গায়ই খোলা দেখা গেল। সেটা হচ্ছে শুটিং গ্যালারির গেম সেন্টার। সব কটি হট-স্প্রিং শহরেই এ রকম দু-একটা গেম সেন্টার দেখা যায়। রুমে ফিরে এসে আমি দ্রুত কাপড়চোপড় বদলে একটা ইউকাতা রোব গায়ে চড়ালাম, নিচতলায় গেলাম গোসল করতে।

এই পর্যায়ে আমাদের কথাবার্তা একটু থেমে গেল। বানরটা খুব মন দিয়ে জোরে জোরে আমার পিঠে সাবান ঘষতে শুরু করল। আমি আরামে চোখ বন্ধ করে যুক্তি দিয়ে পুরো ধাঁধাটার একটা সমাধান বের করার চেষ্টা করলাম। একটা বানর, সে কিনা সিনেগাওয়াতে বেড়ে উঠেছে। পাশেই গুটেনইয়েমা বাগান। চমৎকার মানুষের ভাষায় কথা বলে। এটা কী করে সম্ভব। ঘুরেফিরে শেষ পর্যন্ত এটা একটা বানর। অন্য কিছু নয়। বানর কী করে মানুষের ভাষায় কথা বলে উঠবে?

আশ্চর্যজনকভাবে মোটেলের গরম পানির ব্যবস্থাটা ছিল দুর্দান্ত। এ রকম একটা ভাঙাচোরা বিল্ডিংয়ের মধ্যে এ ধরনের আধুনিক সুব্যবস্থা যে থাকতে পারে, এটা আশাই করা যায় না। বাষ্পীভূত গরম পানি যখন পড়ছিল, মনে হচ্ছিল পুরো ঘরটা গাঢ় সবুজ রঙে ভরে গেছে, সালফারের একটা তীব্র গন্ধও পাওয়া যাচ্ছিল। শরীরে গরম পানির আরামটা বেশ অনেকক্ষণ ধরে উপভোগ করলাম। সৌভাগ্যক্রমে আমি যতক্ষণ বাথরুমে ছিলাম, অন্য কেউ গোসল করতে এল না। কিছুক্ষণ গরম পানিতে ভিজে আমার মাথাটা বেশ হালকা হয়ে এল। তখন গিয়ে বাথটাবে বসলাম। আরাম করে শরীরটা ছেড়ে দিলাম। আমার মনে হলো, মোটেলটা খুব একটা খারাপ না। অন্তত অন্যান্য বড় বড় হোটেলের মতো এখানে আমাকে অনেক লোকের গ্যাঞ্জামের মধ্যে গোসল করতে হচ্ছে না। বেশ একা একা অনেকক্ষণ ধরে আরাম করতে পারছি।

তৃতীয়বারের মতো যখন শরীরটা পানিতে ভেজাচ্ছিলাম, তখন অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল। বাথরুমের স্লাইডিং কাচের দরজাটা ঠেলে একটা বানর ভেতরে এসে দাঁড়াল। হাতে তালি দেওয়ার মতো একটা ভঙ্গি করে সে অবিকল মানুষের গলায় বলে উঠল, এক্সকিউজ মি।

গরম পানির বাষ্পে আমার চোখের দৃষ্টি কিছুটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। আর তা ছাড়া আমি কোনো বানরের কথা শুনতে পাব, এমনটাও আশা করিনি। তাই সে যখন কথা বলে উঠল, আমি আমার চোখ এবং কান দুটোর সঙ্গে সেই কথার কোনো সংযোগ খুঁজে পেলাম না। বানরটা তার পেছনের দরজাটা বন্ধ করে দিল। মেঝেতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট বালতিগুলো একদিকে সরিয়ে বাথটাবের কাছে এসে দাঁড়াল, থার্মোমিটার চেপে ধরে তাপমাত্রা পরীক্ষা করল। সে এত মন দিয়ে থার্মোমিটারের দিকে তাকিয়ে ছিল যে তার চোখ দুটো সরু হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল, একজন ব্যাকট্রোলজিস্ট নতুন কোনো রোগজীবাণু আবিষ্কারের চেষ্টা করছে।

গোসল করতে কেমন লাগছে? বানরটা আমাকে জিজ্ঞাসা করল।

খুবই ভালো, আমি বললাম।

কথাটা বলতে বলতেই খেয়াল করলাম, আমার গলাটা বাষ্পে ডুবে গিয়ে নিজের গলার মতো শোনাচ্ছে না, বরং মনে হচ্ছে প্রাচীনকাল থেকে কোনো পৌরাণিক চরিত্র এসে আমার ওপর ভর করেছে। আমার হয়ে কথা বলছে। বনের ভেতর যেমন একধরনের প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়, সে রকম একটা ব্যাপার ছিল। বলা যায়, অতীতের প্রতিধ্বনি…। অবাক হয়ে ভাবলাম, এখানে একটা বানর কী করছে? আর সে কেন আমার ভাষায় কথা বলছে?

আমি কি আপনার পিঠটা একটু সাবান দিয়ে ডলে দেব? বানরটা বলল।

আমি খেয়াল করলাম, তার গলার স্বরটা বেশ নিচু এবং একধরনের সুরে বাঁধা পড়ে আছে। বেজ এবং টেনর ভয়েসের মাঝামাঝি ব্যারিটোন ধরনের একপ্রকারের মাদকতা ছড়িয়ে ছিল তার গলার স্বরে। চোখ বন্ধ করে শুনলে মনে হবে একজন মোটা গলার পুরুষ কথা বলছে।

কেউ এসে যে আমার পিঠে সাবান ডলে দেবে, এ জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম না। আবার বানরটার মুখের ওপর না–ও করতে পারছিলাম না। কারণ, এটা তার তরফ থেকে একধরনের অফার। আমি যদি তাতে সম্মতি না দিই, তাহলে সে মনে আঘাত পেতে পারে। প্রত্যেক মানুষের যেমন মানবিক অনুভূতি থাকে, প্রতিটা বানরেরও বানরিক অনুভূতি থাকার কথা। আমি সেখানে আঘাত করতে চাইনি। তাই আমি আমার পিঠটা বাথটাব থেকে সামান্য তুলে বানরের দিকে ঘুরিয়ে দিলাম।

তার শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। অবশ্য বানরের শরীরে কাপড় থাকবে, এটা আশা করাটা একটু বাড়াবাড়ি। চুলগুলো সব পাকা। দেখে মনে হচ্ছিল, অনেক বয়স হয়ে গেছে। সে কোত্থেকে যেন একটা ছোট তোয়ালে নিয়ে এসে তাতে সাবান মাখল। তারপর আমার পিঠে অভ্যস্ত হাতে তোয়ালেটা ঘষতে শুরু করল।

খুব শীত পড়েছে এবার, বানরটা মন্তব্য করল।

হ্যাঁ তা–ই, একটু পড়েছে, আমি বললাম।

কিছুদিনের মধ্যেই পুরো জায়গাটা বরফে ঢেকে যাবে। তখন রাস্তাঘাট, বাগান, ছাদ সবকিছু থেকে বরফ পরিষ্কার করতে হবে। এটা খুবই কঠিন একটা কাজ, তা–ই না?

আমি উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু একটু বিরতি নিলাম। তারপর বললাম, আপনি মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারেন?

পারব না কেন? বানরটা বেশ জোরের সঙ্গে বলল, খুব ছোটবেলা থেকেই আমি মানুষের ঘরে বড় হয়েছি। আমার চারপাশে শুধু মানুষ দেখেছি। সুতরাং, কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি মানুষের ভাষায় কথা বলতে শুরু করি। টোকিওর সিনেগাওয়াতে একটা বাড়িতে আমি দীর্ঘদিন ছিলাম।

সিনেগাওয়ার কোন জায়গায়? মানে কোন অংশে?

ওই যে গুটেনইয়েমার পাশে।

ওটা তো খুবই ভালো জায়গা। থাকার জন্য খুব ভালো।

হ্যাঁ, সত্যি জায়গাটা খুবই ভালো। যে বাড়িটাতে ছিলাম, তার পাশেই ছিল গুটেনইয়েমা বাগান। জানালা দিয়ে প্রায়ই বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। খুব ভালো লাগত।

এই পর্যায়ে আমাদের কথাবার্তা একটু থেমে গেল। বানরটা খুব মন দিয়ে জোরে জোরে আমার পিঠে সাবান ঘষতে শুরু করল। আমি আরামে চোখ বন্ধ করে যুক্তি দিয়ে পুরো ধাঁধাটার একটা সমাধান বের করার চেষ্টা করলাম। একটা বানর, সে কিনা সিনেগাওয়াতে বেড়ে উঠেছে। পাশেই গুটেনইয়েমা বাগান। চমৎকার মানুষের ভাষায় কথা বলে। এটা কী করে সম্ভব। ঘুরেফিরে শেষ পর্যন্ত এটা একটা বানর। অন্য কিছু নয়। বানর কী করে মানুষের ভাষায় কথা বলে উঠবে?

অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে কিছু একটা বলতে হয় বলে বললাম, আমি মিনাটোকুতে থাকি।

বানরটা একধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ স্বরে বলল, ও তাহলে তো আমরা প্রায় প্রতিবেশী ছিলাম।

আপনি সিনেগাওয়াতে কার বাড়িতে ছিলেন? মানে তিনি কী ধরনের লোক?

যিনি আমাকে বড় করেছেন, তিনি একজন প্রফেসর ছিলেন। তার সাবজেক্ট ছিল ফিজিকস। টোকিও গাকুগে ইউনিভার্সিটির পরিচালনা পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন।

বাহ্‌ বেশ একজন বুদ্ধিজীবী বলা যায় তাকে তাহলে?

তা বলতে পারেন। তিনি গান খুব ভালবাসতেন। মিউজিকের ব্যাপারে খুব শখ ছিল। ব্রুকনার এবং রিচার্ড স্ট্রস শুনতে খুবই পছন্দ করতেন। তার কাছে ছিলাম বলে একসময় আমি নিজেও মিউজিক বেশ পছন্দ করতে শুরু করি। আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারিনি কখন থেকে সংগীতের প্রতি এই ভালোবাসা আমার তৈরি হয়েছিল।

আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি ব্রুকনার পছন্দ করেন?

হ্যাঁ, তার সেভেনথ সিম্ফনি সবচেয়ে পছন্দ। এই সিম্ফনিটার থার্ড মুভমেন্টে এসে আমি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে যাই।

আমার অবশ্য তার নাইনথ সিম্ফনিটাই বেশি পছন্দ, বললাম আমি।

হ্যাঁ, ওটাও খুব সুন্দর, বানরটা বলল।

আমি একটু ভেবে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা ওই অধ্যাপকই কি আপনাকে মানুষের ভাষায় কথা বলতে শিখিয়েছেন?

হ্যাঁ, তিনিই শিখিয়েছেন। আসলে তার কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না। আর এ জন্য তার হাতে প্রচুর ফাঁকা সময় থাকত। তিনি যখনই সময় পেয়েছেন, আমাকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল এবং বিচক্ষণ একজন মানুষ ছিলেন। আমি যেন নতুন কিছু শিখতে গিয়ে হাল ছেড়ে না দিই, সে জন্য তিনি প্রায়ই আমাকে বলতেন, 'ক্রমাগত চেষ্টা করে যাওয়াই হচ্ছে যেকোনো জিনিস শেখার আসল পথ।' তার স্ত্রীও ছিল খুব শান্ত আর মিষ্টি স্বভাবের। আমাকে খুব পছন্দ করতেন। তারা দুজন একসঙ্গে বেশ ভালোই ছিলেন। যদিও এ ব্যাপারে আমার একটা অবজারভেশন আছে।

কী রকম?

আপনি বাইরের লোক, কী করে বলি? তারপরও বলা যখন শুরু করেছি, বলেই ফেলি। আসলে তাদের রাতের কাজ কারবার, 'রাতের কাজ' মানে বুঝতে পেরেছেন তো কিসের কথা বলছি…ওই ব্যাপারটার মধ্যে খুব একটা তীব্রতা ছিল না।

ও, আমি বললাম।

বানরটা একসময় আমার পিঠে সাবান ঘষাঘষি শেষ করল।

আপনাকে ধন্যবাদ, আমি বললাম, সত্যি অনেকদিন পর খুব ভালো লাগল। শরীরটা হালকা মনে হচ্ছে। তো আপনি কি এখানে, মানে এই মোটেলেই কাজ করেন?

হ্যাঁ এখানেই, বানরটা বলল, এটা আমার সৌভাগ্য যে তারা আমাকে কাজ করতে দিচ্ছে। আসলে মোটেলটা ছোট বলে এখানে কাজ করার বেশ সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। বড় হোটেলে গেলে তারা কখনোই কোনো বানরকে চাকরি দিত না। কিন্তু এখানকার ব্যাপারটা একটু আলাদা। এরা মানুষ–বানরে খুব একটা ভেদাভেদ করে না। এরা দেখে, আপনি কাজটা ঠিকমতো পারেন নাকি পারেন না…। যদিও বানর হিসেবে কাজ করায় আমার বেশ কিছু অসুবিধা হয়। আমার যে পরিমাণ খাটাখাটনি যায়, সে তুলনায় বেতনটা খুবই কম। আর সব ধরনের কাজে আমাকে ওরা নিয়োগ দেয় না। মানুষের সামনে খুব একটা পড়তে হবে এমন কাজ আমাকে দেওয়া হয় না। টুকটাক কাজ, যেমন বাথরুমটা পরিষ্কার করা, একটু গুছিয়ে রাখা ধরনের জিনিস আরকি। কোনো বানর যদি মোটেলের অতিথিকে ট্রেতে করে চা খেতে দেয়, তাহলে সে বেশ অবাক হয়ে যাবে। রেগেও যেতে পারে। মোটেল কর্তৃপক্ষ সেই ঝুঁকিতে যাবে না। তারা আমাকে রান্নাঘরেও কাজ করতে দেয় না। ওই যে খাদ্য স্যানিটেশন আইন টাইপের কী কী যেন ব্যাপার আছে না? ধারণা করা হয়, বানরমাত্রই অপরিচ্ছন্ন একটা জীব আর আপনাদের তথাকথিত ওই সব স্যানিটেশন রুল মেনে চলতে পারে না।

আপনি কি এখানে অনেকদিন ধরে কাজ করছেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

মোটামুটি তিন বছর হবে, বানরটা বলল।

এখানে আসার আগে আপনার জীবনে নিশ্চয়ই নানান বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা–ই না?

তা আর বলতে? অনেক অভিজ্ঞতা।

আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আপনি কি আপনার অতীত সম্পর্কে আরও কিছু আমাকে বলতে পারেন?

হ্যাঁ পারব। তবে আমার মনে হয়, আপনি হয়তবা অনেক আকর্ষণীয় কোনো একটা কিছু শুনতে চাচ্ছেন। সেটা আমি বলতে পারব না হয়তো। তবে আমি নিশ্চয়ই বলব। রাত ১০টায় আমার কাজ শেষ হয়ে যাবে। তখন আমি আপনার ঘরে আসতে পারি। আসব?

নিশ্চয়ই, আমি জবাব দিলাম, আপনি যদি তখন সঙ্গে করে কিছু বিয়ার আনতে পারেন, তাহলে আমি কৃতজ্ঞ থাকব।

বুঝতে পেরেছি, সে বলল, একদম বরফের মতো ঠান্ডা বিয়ার খেতে চাচ্ছেন। আমাদের এখানে সাপ্পোরো আছে, চলবে?

দৌড়াবে। আপনি বিয়ার খান তো?

মাঝেমধ্যে।

আচ্ছা, সে ক্ষেত্রে আপনি যেটা করবেন, সেটা হলো দুটি বড় কাচের বোতলের সাপ্পোরো আনবেন। ওকে?

আমি যদি ভুল না করি, আপনি দোতালার আরাইস্যো স্যুটে আছেন, তা–ই না?

ঠিক তা–ই।

এটা কি আপনার কাছে একটু অদ্ভুত মনে হয় না, বানরটা বলল, আপনাকে থাকতে হবে পাহাড়ের ওপরে একটা ঘরে, যে ঘরের নাম আরাইস্যো। আরাইস্যো মানে জানেন তো? এর অর্থ রুক্ষ সমুদ্রতট। থাকছেন পাহাড়ে আর ঘরের নামের মধ্যে সমুদ্র।

কথাটা বলে বানরটা নিচু স্বরে হাসতে শুরু করল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এর আগে আমি কখনোই কোনো বানরের হাসি শুনিনি। তবে আমার মনে হলো, বানরেরা মাঝেমধ্যে হাসে, এমনকি কাঁদেও। একটা বানর যদি কথা বলতে পারে, তাহলে হাসলে সমস্যা কোথায়?

একটু ইতস্তত করে জানতে চাইলাম, আচ্ছা আপনার কি কোনো নাম আছে?

না, ঠিক সেভাবে কোনো নাম নেই, বানরটা বলল, তবে সবাই আমাকে সিনেগাওয়া মাংকি বলে ডাকে।

বানরটা স্লাইড করে কাচের দরজা খুলল এবং সেখানে দাঁড়িয়ে আমার দিকে সামান্য একটু বো করল। তারপর দরজাটা বন্ধ করে চলে গেল।

১০টা বাজার কিছুক্ষণ পর সে এল। হাতে একটা ট্রে। তার মধ্যে দুটো বড় বিয়ারের বোতল, বোতলের মুখ খোলার জন্য ওপেনার, দুটো গ্লাস, সামান্য কিছু স্ন্যাকস। স্ন্যাকসের মধ্যে ছিল স্কুইড, এক ব্যাগ ক্যাকিপি-রাইস ক্র্যাকার সঙ্গে চিনাবাদাম। আয়োজন দেখেই বোঝা যায়, সে কাজে বেশ মনোযোগী। সবকিছু একেবারে গুছিয়ে এনেছে। এবার তার পরনে কিছু জামাকাপড় দেখা যাচ্ছে। গায়ে I Love NY প্রিন্ট করা একটা ফুল শার্ট। কোমরের নিচে একটা ধূসর রঙের সোয়েট প্যান্ট।

ঘরের মধ্যে কোনো চেয়ার–টেবিল ছিল না। তাই আমরা মেঝেতেই পাতলা কুশনের ওপর পাশাপাশি বসে দেয়ালে হেলান দিলাম। বানরটা ওপেনার দিয়ে বোতলের মুখটা খুলল। নিখুঁতভাবে দুটো গ্লাসে ঢালল। চিয়ার্স করে আমরা যে যার গ্লাসে চুমুক দিলাম।

ড্রিঙ্কসের জন্য অনেক ধন্যবাদ, বানরটা বলল। খুশিতে সে ঠান্ডা বিয়ারটা আঁকড়ে ধরল।

আমিও দুই–এক চুমুক দেওয়ার পর ভাবতে বসলাম, শেষ পর্যন্ত আমি একটা বানরের পাশে বসে বিয়ার খাচ্ছি। নিশ্চয়ই এটা একটা আজব অভিজ্ঞতা। কিন্তু আমি ধীরে ধীরে এই অদ্ভুত ব্যাপারগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম।

সারা দিনের কাজের পর বিয়ার খেতে বেশ ভালোই লাগে, বানরটা তার লোমশ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, তবে ঘটনা হচ্ছে, একটা বানরের পক্ষে এভাবে বিয়ার খাওয়ার সুযোগ খুব কমই আসে।

আপনি কি এখানে, মানে এই হোটেলেই থাকেন? আমি জানতে চাইলাম।

হ্যাঁ, একটা ঘর আমার আছে, যেখানে ওরা আমাকে ঘুমোতে দেয়। সমস্যা হচ্ছে, সেখানে সব সময় ইঁদুর থাকে। তাই ঘুমিয়ে খুব একটা আরাম পাওয়া যায় না। তবে আমি যেহেতু একটা বানর, এটা আমি মেনে নিয়েছি যে ঘুমানোর জন্য একটা বিছানা আর দিনে তিন বেলা খাবার পাওয়া গেলেই আমাকে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। আমার জন্য কেউ স্বর্গ খুঁজে দেবে না।

বানরটা তার প্রথম গ্লাস শেষ করে ফেলেছিল। তাই আমি তাকে আরও খানিকটা বিয়ার ঢেলে দিলাম। গ্লাসটা হাতে নিয়ে সে বলল, আসলে আমি খুব বাধ্য টাইপের।

আপনি কি শুধু মানুষের সঙ্গেই সারা জীবন থেকেছেন নাকি আপনার মতো যারা অন্য বানর আছে তাদের সঙ্গেও আপনার বসবাসের কিছু অভিজ্ঞতা আছে? তাকে জিজ্ঞাসা করলাম।

হ্যাঁ, বেশ কয়েকবার থাকতে হয়েছে, বানরটা উত্তর দিল। উত্তর দেওয়ার সময় তার মুখটা একটু মেঘে ঢেকে গেল। চোখের পাশের কুঁচকিতে গভীর একটা ভাঁজ তৈরি হলো।

সে বলল, কারণগুলো বলছি না, কিন্তু আপনি বুঝতেই পারছেন, সেগুলো কী হতে পারে…। যা–ই হোক, কিছু কারণে আমাকে জোর করে সিনেগাওয়া থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং দক্ষিণে তাকাসাকিইয়ামা অঞ্চলে ছেড়ে দিয়ে আসে। ওখানে বানরের একটা পার্ক আছে। ওরা ভেবেছিল যে আমি সেখানে জাতভাইদের সঙ্গে শান্তিতে থাকতে পারব। আমিও তা–ই ভেবেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শান্তি আসেনি।

কেন? জানতে চাইলাম আমি।

আমাকে ভুল বুঝবেন না, কিন্তু আমি প্রফেসরের পরিবারে একধরনের মানবিক পরিবেশের মধ্যে বড় হয়ে উঠেছিলাম। তাই অন্য বানরদের মধ্যে আমি সেভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারতাম না। ওদের সঙ্গে আচার–ব্যবহারে আমার মিল ছিল খুবই সামান্য। আমি যখন কথা বলতাম, তখন ওরা আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ধমকে উঠত আর বলত, 'তুমি খুব হাস্যকর কথাবার্তা বলো।' আর মেয়ে বানরগুলো আমার দিকে তাকিয়ে অকারণে হাসত, যেন আমি একটা হাস্যকর বস্তু। কোনো কিছুই মিল ছিল না ওদের সঙ্গে। আমার চলাফেরা থেকে শুরু করে সবকিছুর মধ্যে ওরা একটা হাস্যকর দিক খুঁজে পেত এবং বিরক্তি প্রকাশ করত। আমিও যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম। তাই অবশেষে আমি বেশ খিটখিটে টাইপের একটা বানর হয়ে উঠলাম।

আপনার নিজেকে তখন খুব একা মনে হতো, না? জানতে চাইলাম আমি।

নিশ্চয়ই, সে বলল, কেউ আমার দিকে কোনো সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। কোনো বিপদ হলে আমাকে নিজেকে রক্ষা করতে হতো। নিজের খাবার নিজেকে খুঁজে বের করতে হতো। কোনো দিন খুঁজে না পেলে না খেয়ে থাকতাম। একা একা বাঁচার চেষ্টা করেছিলাম। তবে সবচেয়ে যেটা খারাপ বিষয় ছিল তা হলো, আমার কথা বলার মতো কেউ ছিল না। বানররা আমার সঙ্গে কথা বলত না। আর আমি কথা বলার জন্য কোনো মানুষও খুঁজে পাইনি। যদিও ওই পার্কে অনেক দর্শক আসত, তবু কোথায় যেন একটা সংকোচ বোধ করতাম। নিজ থেকে কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না। একটা বার ভাবুন আমার অবস্থাটা। আমি না এদিকের, না ওদিকের…, না হতে পারলাম মানব সমাজের অংশ, না বানর সমাজের।

এবং সেখানে আপনি ব্রুকনারের সিম্ফনিও শুনতে পেতেন না।

হ্যাঁ, এটা সত্যি। কিন্তু তা মেনে নেওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না।

সিনেগাওয়া মাংকি কথা বলছিল। আর একটু একটু করে বিয়ার খাচ্ছিল। আমি ভালো করে লক্ষ করার চেষ্টা করলাম, অ্যালকোহল তাকে কাবু করতে পেরেছে কি না। মুখটা একটু লাল বটে, কিন্তু বানরের মুখ তো এমনিতেই একটু লাল হয়। সুতরাং এটা যে বিয়ারের প্রভাবে হয়েছে, সে রকম কিছু মনে হলো না। বানরটা সম্ভবত ভালোই মদ খেতে পারে। অথবা এমন হতে পারে, বানর যখন মাতাল হয়, তাদের মুখ দেখে সেটা আসলে বোঝা যায় না।

যে জিনিসটা নিয়ে আমি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেতাম সেটা হলো নারীঘটিত ব্যাপার, সে বলল।

মানে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম, নারীঘটিত ব্যাপার বলতে আপনি আসলে ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন?

এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, যৌন সম্পর্ক। মানে মেয়ে বানরদের সঙ্গে আমি সেক্সের কোনো তাগিদ অনুভব করতাম না। হ্যাঁ, আমি অনেকবার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু ভেতরে তাগিদ না থাকলে যেটা হয়, করা হয়ে ওঠেনি।

আপনি নিজে একজন বানর, অথচ মেয়ে বানরদের প্রতি আপনি শারীরিক আকাঙ্ক্ষা বোধ করতেন না?

অনেকটা সে রকমই। যদিও জিনিসটা খুব বিব্রতকর, তারপরও আপনাকে বলি, আমি শুধুমাত্র মানবজাতির মেয়েদেরকে ভালোবাসতে পেরেছি।

আমি চুপ করে গেলাম। এক টানে বিয়ারের গ্লাসটা খালি করে ফেললাম। স্ন্যাকসের ব্যাগটা খুলে একমুঠো মুখে দিলাম। চাবাতে চাবাতে বললাম, এটা আসলেই খুব মারাত্মক একটা সমস্যা।

হ্যাঁ খুবই মারাত্মক সমস্যা, সে বলল, আমি বানর হয়ে জন্মেছি। অথচ কামনা করছি মানুষের মেয়েকে। এটা কোনোভাবেই সম্ভব না। জেনেটিক্সের সম্পূর্ণ বিপরীত একটা ইচ্ছা।

একটু নীরবতা নেমে এল। আমি তার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বানরটা কিছুক্ষণ বিরতি দিল। তার কানের পেছনে শক্তভাবে ঘষে সে আবার কথা শুরু করল।

আমার এই অপূর্ণ কামনা–বাসনা থেকে নিজেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আমাকে একটা বিকল্প পদ্ধতি খুঁজে বের করতে হয়েছিল, সে বলল।

বিকল্প পদ্ধতি বলতে আসলে কী বোঝাতে চাচ্ছেন, আমি জানতে চাইলাম।

আপনি হয়তো আমাকে বিশ্বাস করবেন না, সে জন্য আপনাকে দোষ দেব না। কিন্তু আমার আপনাকে বলা উচিত। এভাবে অতৃপ্ত কামনা–বাসনা জমতে জমতে একসময় আমি যে মেয়েদের প্রেমে পড়েছিলাম, তাদের নাম চুরি করতে শুরু করি।

নাম চুরি, মানে?

সম্ভবত এটা আমার একটা বিশেষ প্রতিভা। আমি যদি কাউকে খুব তীব্রভাবে অনুভব করি, তাহলে আমি তার নামটা চুরি করতে পারি এবং সেটাকে নিজের কাছে রেখে দিতে পারি। বলা যায়, আমি ওটার মালিক হয়ে যাই।

একরাশ বিভ্রান্তি আমাকে ঘিরে ধরল। বললাম, আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারছি না, আপনি যখন মেয়েদের নাম চুরি করেন, তখন কী হয়? তারা কি পুরোপুরি তাদের নামটা হারিয়ে ফেলে?

না, পুরোপুরি তাদের নামটা হারিয়ে যায় না, সে বলল, আমি তাদের নামের একটা অংশ চুরি করি শুধু। পুরো নামটা থেকে যখন একটা অংশ আমি তুলে নিয়ে যাই, তখন নামটার ওজন যথেষ্ট কমে যায়। আগের চেয়ে হালকা হয়। অনেক সময় ভালো করে লক্ষ না করলে বোঝাই যায় না যে ওজনটা কমে গিয়েছে। সূর্য মেঘে ঢেকে গেলে আপনার ছায়াটা একটু ফিকে হয়ে যাবে। অনেক মানুষ বুঝতে পারে না তাদের ছায়া যে ফিকে হয়ে গেছে, সে রকম একটা ব্যাপার।

তবে কেউ কেউ নিশ্চয়ই বুঝতে পারে যে আপনি তাদের নাম চুরি করেছেন, তা–ই না?

আপনি বাইরের লোক, কী করে বলি? তারপরও বলা যখন শুরু করেছি, বলেই ফেলি। আসলে তাদের রাতের কাজ কারবার, 'রাতের কাজ' মানে বুঝতে পেরেছেন তো কিসের কথা বলছি…ওই ব্যাপারটার মধ্যে খুব একটা তীব্রতা ছিল না।



হ্যাঁ, তা পারে। কখনো কখনো তারা নিজেদের নাম মনে করতে পারে না। সে অবস্থায় আপনি যদি তাদের নামটা জিজ্ঞাসা করেন, তারা বলতে পারবে না। তখন একধরনের পরিচয়সংকট তৈরি হয়। এটাকে আপনি আইডেন্টিটি ক্রাইসিস বলতে পারেন। সে সময় আমার খুব খারাপ লাগতে শুরু করে। কারণ আমি জানি, সব দোষ আমার। আমার কারণেই মেয়েটা নিজের নাম মনে করতে পারছে না। যদিও আমি জানি, আমি একটা অন্যায় কাজ করছি, তবু আমি নিজেকে আটকাতে পারি না। নিজের দোষ ঢাকার জন্য বলছি না, তবে এ কথা সত্যি যে আমার ভেতরে যে ডোপামিন লেভেলগুলো আছে, সেটা আমাকে এই কাজ করতে বাধ্য করে। মাথার ভেতরে ডোপামিন লেভেল থেকে একটা কণ্ঠ আমি শুনতে পাই। সে আমাকে বলে, 'যাও গিয়ে ওর নামটা চুরি করে নিয়ে আসো। এর মধ্যে কোনো অন্যায় নেই। এটা তোমার অধিকার।'

ডোপামিন লেভেল কথাটা শুনে আমি বানরটার মুখের দিকে ভালো করে তাকালাম। এটা বেশ শিক্ষিত বানর বোঝাই যাচ্ছে। মস্তিষ্কের ডোপামিন লেভেলের মতো রাসায়নিক বিষয়গুলো সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞান আছে। একটু চিন্তা করে বললাম, আমি যদি ভুল না করি, তাহলে বোধ হয় আপনি শুধু সেই সব মেয়েরই নাম চুরি করতেন, যাদের প্রতি আপনার একধরনের ভালোলাগা বা শারীরিক আকাঙ্ক্ষা আছে। তা–ই কি?

ঠিক তা–ই, সে বলল, আমি কখনো এলোমেলোভাবে যে কারও নাম চুরি করি না।

এ পর্যন্ত কতগুলো নাম চুরি করেছেন?

সব মিলিয়ে মোট সাতজন হবে।

আপনি এটা কীভাবে করেন? আমাকে কি একটু বলা যায়?

পুরোটাই করতে হয় ইচ্ছাশক্তি খাটিয়ে। প্রথমে আপনাকে মানসিকভাবে খুব দৃঢ় হতে হবে। তবে সেটাই যথেষ্ট নয়। আরও একটা জিনিস দরকার আছে। সেটা হচ্ছে, সেই মেয়েটার নাম লেখা যেকোনো একটা কিছু। এ জন্য আইডি কার্ড সবচেয়ে আদর্শ। সেটা পাওয়া না গেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স হতে পারে বা ইনস্যুরেন্স কার্ড অথবা পাসপোর্ট। এই ধরনের যেকোনো জিনিস। সাধারণত এ জন্য আমাকে চুরি করতে হয়। আমি গিয়ে বললেই কেউ আমাকে তার আইডি কার্ড দিয়ে দেবে, বিষয়টা এমন নয়। মেয়েটা যে বাড়িতে থাকে, সেখানকার লোকেরা যখন বাইরে চলে যায়, তখন আমি খুব দ্রুত ওই বাড়িতে ঢুকে পড়ি। বানরেরা দেয়াল বেয়ে জানালা দিয়ে খুব সহজেই কোনো বাড়িতে ঢুকে যেতে পারে। আমি তখন আমার যে জিনিসটা দরকার, সে রকম একটা নেমট্যাগ খুঁজে নিই।

তারপর সেই নেমট্যাগের সঙ্গে নিজের ইচ্ছাশক্তি যোগ করে আপনি নামটা চুরি করেন, এই তো?

একদম। আমি দীর্ঘ সময় সেই নামটার দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার সব আবেগকে একটা জায়গায় জড়ো করার চেষ্টা করি, তারপর যে নামটার দিকে তাকিয়ে আছি, সেই নামটাকে নিজের ভেতর শুষে নিই। এটা করতে অনেক সময় লাগে। আমি শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ি এবং একটা সময় ওই মেয়েটার একটা অংশ আমার হয়ে যায়। আমার ভেতরের সব ভালোবাসা আর আকাঙ্ক্ষা এত দিন পর্যন্ত যার কোনো গন্তব্য ছিল না, সেগুলো একটা নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছে যায়।

তার মানে এটা পুরোপুরি হাইপোথিটিক্যাল একটা ব্যাপার। সেক্সের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই?

বানরটা মাথা নিচু করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, যদিও আমি শুধু একটা বানর, একটা খুবই নিম্ন প্রজাতির সৃষ্টি, তারপরও আমি কখনো কারও ক্ষতি হতে পারে এ রকম কিছু করি না। আমি যে মেয়েটাকে পছন্দ করি, তার নামের একটা অংশ শুধু আমার কাছে রেখে দিই, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। যদিও আমি জানি, এটা একধরনের বিকৃত ইচ্ছা। তবু এটা সম্পূর্ণ খাঁটি একধরনের প্লেটোনিক লাভ। আমি গোপনে নামটাকে আমার নিজের মধ্যে রেখে দিই এবং তার প্রতি গভীর ভালোবাসা অনুভব করি। অনেকটা ঘাসভূমির ওপর দিয়ে মৃদু বাতাস বয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার এটা।

হুম, আমি মুগ্ধ হয়ে বললাম, এটাকে আপনি রোমান্টিক ভালোবাসার একটা সর্বোচ্চ ধাপ বলতে পারেন।

আপনার সঙ্গে আমি একমত। তবে আপনি এটাকে নিঃসঙ্গতারও সর্বোচ্চ ধাপ বলতে পারেন। একটা কয়েনের দুটো সাইড থাকে। হেড এবং টেল। দুজনে খুব কাছাকাছি ঘর করে। কিন্তু তারা একা, স্বতন্ত্র। তারা দুজন দুজনকে চায়। কিন্তু কখনো এক হতে পারে না। আবার আলাদাও করা যায় না। অথচ একজন আরেকজনের গায়ের সঙ্গে লেগে থাকে। বিচিত্র দুনিয়া।

আমাদের মধ্যে বেশ একটা নীরবতা নেমে এল। বানর আর আমি চুপচাপ বিয়ার খেলাম কিছুক্ষণ।

আপনি কি রিসেন্টলি কারও নাম চুরি করেছেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

বানরটা মাথা নাড়ল। সে নিজের বাহুতে খাড়া চুলগুলো এমনভাবে ধরছিল, যেন যাচাই করতে চাচ্ছে যে সে সত্যিই একজন বানর কি না।

আমি রিসেন্টলি কারও নাম চুরি করিনি, সে বলল, এই শহরে আসার পর আমি আমার আগের এসব অপকর্ম ভুলে থাকব বলে ঠিক করেছি। এতে একটা লাভ হয়েছে আমার। আত্মার মধ্যে একধরনের শান্তি টের পাচ্ছি। যে সাতটা মেয়ের নাম চুরি করেছিলাম, তাদেরকেই আমার মনের মধ্যে যত্ন করে রাখি এবং একধরনের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের চেষ্টা করি।

খুব ভালো লাগল এটা শুনে, আমি বললাম।

যদি বেয়াদবি না নেন, ভালোবাসা সম্পর্কে আমার নিজস্ব কিছু ব্যাখ্যা আছে, সেগুলো একটু বলার চেষ্টা করতে পারি।

নিশ্চয়ই, আমি বললাম।

আমি বিশ্বাস করি যে প্রেম আমাদের মধ্যে থাকতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য এটা খুবই জরুরি। একধরনের জ্বালানির মতো। একদিন হয়তো সেই ভালোবাসা শেষ হয়ে যেতে পারে। অথবা একটু ফিকে হয়ে যাবে। কিন্তু ফিকে হওয়ার পরও আপনি আপনার ভালোবাসার কিছু টুকরো স্মৃতি ধরে রাখতে পারেন। আপনি যখনই স্মৃতিগুলোর কথা ভাববেন, সেটা আপনার মধ্যে একধরনের আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে দেবে। সেই উষ্ণতাটুকু ছাড়া একটা হৃদয়, তা সে মানুষেরই হোক বা বানরেরই হোক, একটা ঠান্ডা জঞ্জালে পরিণত হবে। সে হৃদয়ে সূর্যের আলো পড়বে না, শান্তির বুনো ফুল ঝরবে না, আশার গাছ সেখানে বেড়ে উঠবে না। আমার এই ছোট্ট হৃদয়ে আমি সেই সাতটা মেয়ের নাম গুপ্তধনের মতো লুকিয়ে রেখেছি। এই নামগুলোই ক্লান্তিকর শীতল রাতে আমাকে উষ্ণতা জোগায়।

শেষ পর্যন্ত আমরা বড় দুটি বিয়ারের বোতল শেষ করি। ঘড়িতে সাড়ে ১১টা বাজছিল।

বানরটা বলল, এবার আমার যাওয়া উচিত। অনেক বেশি মদ খেয়ে ফেললাম, আর অনেক কথা বলে ফেললাম, আমাকে ক্ষমা করবেন।

না না, একেবারেই না। বরং, আমি খুব মজার একটা গল্প শুনলাম, বললাম তাকে।

যদিও মজার শব্দটা বলা আমার উচিত হয়নি। আসলে বানরের সঙ্গে বসে বিয়ার খাওয়া আর গল্প করা ব্যাপারটাকে একটা অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা বলা যেতে পারে। কিন্তু সেটার সঙ্গে 'মজার' শব্দটা যোগ করা নিয়ে আমার মনের মধ্যে কিছু সন্দেহ টের পাই। যদিও বানরটা মানুষের মতোই ব্রুকনারের সিম্ফনি ভালোবাসত এবং যেসব মেয়ের প্রতি সে শারীরিক আকাঙ্ক্ষা (অথবা ভালোবাসা) অনুভব করত, তাদের নাম চুরি করত, তারপরও মজার শব্দটা বলা ঠিক নয়। কিন্তু আমি তার অনুভূতিতে আঘাত করতে চাইনি বলে 'অস্বাভাবিক' শব্দটার বদলে 'মজার' বলেছি।

বিদায়ের সময় হয়ে গেলে আমি বানরটাকে একটা এক হাজার ইয়েনের নোট টিপস হিসেবে দিলাম। বললাম, আপনার জন্য বেশি কিছু করতে পারলাম না। টাকাটা দিয়ে আপনি ভালো কোনো খাবার কিনে খাবেন।

বানরটা টাকা নিতে অস্বীকার করল। কিন্তু আমি জোর করে তাকে দিলাম। সে টাকাটা ভাঁজ করে তার সোয়েট প্যান্টের পকেটে রাখল।

আপনি অনেক ভালো একজন মানুষ, সে বলল, অনেকক্ষণ ধরে আমার ফালতু জীবনটা নিয়ে আপনাকে কিছু উদ্ভট গল্প বলেছি। আপনি সেগুলো শুনেছেন, আমাকে বিয়ার খেতে দিয়েছেন, আবার এখন এই এক হাজার ইয়েন দিলেন। কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব, সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

বিয়ারের খালি বোতল আর গ্লাসগুলো ট্রেতে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।

পরের দিন সকালে আমার টোকিও ফেরার কথা। ব্যাগ–বোচকা নিয়ে মোটেলের রিসিপশনে এলাম চেক আউট করব বলে। আগের টাক মাথার বুড়োটা সেখানে নেই। নাক ডাকা বিড়ালটাও ছিল না। তার পরিবর্তে বেশ মোটা থলথলে চর্বিওয়ালা এক মধ্যবয়সী মহিলা বসেছিলেন। আমি যখন তাকে গত রাতের বিয়ারের বোতলের জন্য অতিরিক্ত চার্জ করতে বললাম, তিনি দৃঢ়ভাবে বললেন যে আমার বিলে বিয়ার খাওয়া বাবদ কোনো চার্জ লেখা নেই।

তিনি বেশ জোর দিয়েই বললেন, আমাদের এখানে বোতলের বিয়ার পাওয়া যায় না। ভেন্ডিং মেশিনে আছে শুধু ক্যান বিয়ার। সুতরাং আপনি যে বলছেন, আপনি বোতলের বিয়ার খেয়েছেন, সেটা সত্যি নয়। আমরা কখনো বোতলজাত বিয়ার স্টকে রাখি না।

পুরোটা বিষয়ে আমার বেশ তালগোল পাকিয়ে গেল। বাস্তবতা এবং অবাস্তবতার রিদমিক বিটগুলো ঘনঘন তাদের স্থান পরিবর্তন শুরু করল। বানরের সঙ্গে বসে গল্প শুনতে শুনতে আমি অতি অবশ্যই দুটো বড় বোতলের সাপ্পোরো খেয়েছি। আরেকটু হলেই আমি মহিলাকে বানরের গল্পটা বলতে যাচ্ছিলাম। তবে শেষ মুহূর্তে থেমে গেলাম।

কেন যেন মনে হলো, বানরটা সম্ভবত আসলে ছিল না। এটা কেবল আমার একটা কল্পনা। একধরনের মায়া, বিভ্রম। গরম পানিতে দীর্ঘক্ষণ গোসলের সময় মস্তিষ্কে উৎপন্ন একটা পণ্য। অথবা এমনও হতে পারে, আমি যেটা দেখেছিলাম, সেটা ছিল এক অদ্ভুত বাস্তব স্বপ্ন। আমি যদি মহিলাকে জিজ্ঞাসা করতাম, 'আচ্ছা আপনাদের কি এমন কোনো কর্মচারী আছে যে একজন বয়স্ক বানর আর মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারে?' তাহলে সে হয়তো আমাকে ভুল বুঝত। মনে করত, আমি পাগল। আবার এমনও হতে পারে যে বানরটার নাম হোটেলের এমপ্লয়ি লিস্টে ছিল না। কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য অথবা স্বাস্থ্য বিভাগের স্যানিটেশন–সংক্রান্ত ঝামেলা এড়ানোর জন্য মোটেল কর্তৃপক্ষ তার নাম এমপ্লয়ি লিস্টে না–ও রাখতে পারে। সে ক্ষেত্রে মহিলা কখনোই স্বীকার করবে না।

ট্রেনে করে টোকিও যাওয়ার পথে বানরটা আমাকে যা যা বলেছিল, সেগুলো মনে করার চেষ্টা করলাম। আমি সমস্ত বিবরণ একটা নোটবুকে লিখে ফেললাম। যা যা মনে করতে পারি সব লিখলাম। ভাবছিলাম টোকিওতে ফিরে গেলে আমি পুরো গল্পটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভালো করে লিখব।

বানরটা যদি সত্যিই থেকে থাকে আর আমি যদি বাস্তবে তাকে দেখে থাকি, তাহলে বিয়ার খেতে খেতে সে আমাকে যা বলেছিল, তার কতটুকু আমার গ্রহণ করা উচিত, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। তার গল্পটা বিশ্বাস করা খুব কঠিন ছিল। আবার অবিশ্বাস করার গ্রহণযোগ্য কোনো কারণও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মেয়েদের নাম চুরি করা আর সেগুলো নিজের করে ফেলা, এটা কি সত্যি সম্ভব? এটা কি এমন কোনো ক্ষমতা, যা শুধু ওই বিশেষ সিনেগাওয়া মাংকিকে দেওয়া হয়েছিল? বানরটা কি আসলে মিথ্যাবাদী ছিল? মিথ্যা বলে তার লাভ? কে বলতে পারে?

মিথ্যা কথা বলাটা কখনো কখনো একটা রোগের মতো হয়ে যায়। যদিও মিথোম্যানিয়ায় আক্রান্ত কোনো বানরের গল্প আমি শুনিনি, তারপরও এ রকম মিথ্যা বলা বানর থাকতেই পারে। কোনো বানর যদি দক্ষতার সঙ্গে মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারে, তবে তার পক্ষে মিথ্যা বলার অভ্যাস তৈরি করাটাও খুব একটা কঠিন কিছু না।

তবে একটা ব্যাপার কি, আমি অসংখ্য মানুষের সঙ্গে মিশেছি। এটা আমাকে আমার কাজের অংশ হিসেবে করতে হয়। মানুষের সাক্ষাৎকার নিতে হয়। কাকে বিশ্বাস করা যাবে বা কাকে করা যাবে না, সেটা আমি বেশ ভালো বুঝি। কিছুক্ষণ কথা বললেই টের পেয়ে যাই। সে জায়গা থেকে দেখতে গেলে বানরটা যে আমাকে বানিয়ে বানিয়ে কোনো গল্প বলছিল, এ রকম কোনো অনুভূতি আমার মধ্যে টের পাইনি। তার চেহারা, অভিব্যক্তি, কথা বলতে বলতে যেভাবে থেমে গিয়ে সে চিন্তা করছিল, তার অঙ্গভঙ্গি, কিছুটা বিরতি নিয়ে শব্দগুলো যেভাবে খুঁজে বের করছিল, সবকিছুই মোটামুটি বাস্তবসম্মত। কৃত্রিম কিছু মনে হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, তার স্বীকারোক্তির মধ্যে একধরনের বেদনাদায়ক সততা ছিল।

টোকিও ফিরে আমি আমার জীবনের আগের রুটিনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। একের পর এক কাজে জড়িয়ে পড়লাম। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগের চেয়ে আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। শেষ পর্যন্ত আমি কাউকেই সিনেগাওয়া মাংকি সম্পর্কে কিছু বলতে পারিনি বা তাকে নিয়ে কিছু লিখিনি। সব সময় একটা ভয় কাজ করত। ঠিক ভয় না, একধরনের সংশয়। যে বিষয়টা মানুষকে বিশ্বাস করানো কষ্ট হবে, সেটা নিয়ে শ্রম দেওয়ার আমি কোনো অর্থ খুঁজে পাইনি। কথার পেছনে আমি যদি উপযুক্ত প্রমাণ দিতে না পারতাম, তাহলে লোকজন বলত, আমি বানিয়ে বানিয়ে বলছি।

আবার আমি যদি কথাসাহিত্য হিসেবে গল্পটা লিখি, তাহলেও একটা অসুবিধা আছে। পুরো গল্পটার মধ্যে একটা নির্দিষ্ট পয়েন্ট অব ফোকাস বলে কিছু নেই। আর কে না জানে, এ ধরনের সাহিত্য মানুষ পছন্দ করে না। আমি আমার সম্পাদকের হতবাক মুখটা কল্পনায় চোখের সামনে দেখতে পাই, সে আমাকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করছে, 'আচ্ছা আপনি তো লেখক। বলুন তো, যে গল্পটা আপনি লিখে এনেছেন, এই গল্পের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়, মানে থিমটা কী?'

থিম? থিম যদি খুঁজতে যাই, তাহলে অবশ্য সেটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটা বুড়ো বানর যে মানুষের ভাষায় কথা বলে, যে গুনমা এলাকার একটা ছোট্ট শহরের মোটেলে অতিথিদের পিঠে সাবান ঘষে দেয়, ঠান্ডা বিয়ার খেতে পছন্দ করে, মানব রমণীর প্রেমে পড়ে আর তাদের নাম চুরি করে। এই গল্পের থিম কী হতে পারে? মরালটাই–বা কী?

সময় বয়ে যায়। স্মৃতির ফ্রেমে ধুলা জমে। হট-স্প্রিং শহরের সিনেগাওয়া মাংকির গল্প একটু একটু করে হারিয়ে যেতে বসে। স্মৃতি যতই স্বচ্ছ হোক না কেন, সময়কে জয় করতে পারে না।

তবে আজ এই পাঁচ বছর পরে এসে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এটা নিয়ে লিখব। সে সময়ে যে নোটগুলো নিয়েছিলাম, তার ওপর ভিত্তি করেই আমি লিখব। সম্প্রতি এমন একটা ঘটনা ঘটেছে, যা আমাকে লিখতে বাধ্য করছে। যদি ঘটনাটা না ঘটত, তবে সম্ভবত এটা আমি কখনোই লিখতাম না।

হোটেল আকাসাকার কফি লাউঞ্জে সেদিন আমি বসেছিলাম। সেখানে খুব আকর্ষণীয় এক মহিলার সঙ্গে আমার অ্যাপয়েনমেন্ট ছিল। তিনি একটা ট্রাভেল ম্যাগাজিনের সম্পাদক। মহিলার বয়স ত্রিশের মতো, লম্বা চুল, খাড়া নাক, চোখগুলো বড় আর স্বচ্ছ, গায়ের রং খুবই সুন্দর। বিয়েশাদি কিছু করেননি। আমরা একসঙ্গে এর আগে বেশ কয়েকবার কাজ করেছি এবং কাজগুলো ভালোই হয়েছে বলা যায়।

সেবারও আমরা কাজের আলাপ শেষ করে কফি খাচ্ছিলাম। হঠাৎই তার সেলফোন বেজে উঠল এবং তিনি আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে ফোনটা ধরলেন। আমি বোঝার চেষ্টা করলাম, তিনি কী নিয়ে কথা বলছেন। সম্ভবত কোনো একটা কিছু রিজার্ভেশন করতে চাচ্ছেন। সেটা রেস্টুরেন্ট হতে পারে, একটা হোটেল বা ফ্লাইটও হতে পারে। হঠাৎই অপর প্রান্তের কোনো একটা কথা শুনে তাকে বেশ চিন্তিত মনে হলো। তিনি কিছু একটা ভেবে বের করতে চাচ্ছেন। কিন্তু পারছেন না। খুবই চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকালেন। হাত দিয়ে সেলফোনের কথা বলার জায়গাটা ভালো করে ঢাকলেন।

আমি খুবই সরি, তিনি আমাকে বললেন, আসলে আমি আপনাকে একটা খুব অদ্ভুত প্রশ্ন করব। আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনি কি আমাকে একটু বলবেন, আমার নামটা কী?

আমি বড় করে একবার শ্বাস টেনে তার পুরো নামটা বললাম। মাথা নেড়ে তিনি তার নামটা টেলিফোনের অপর প্রান্তের লোকটাকে বললেন। ফোনটা কেটে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটা বোকা বোকা হাসি দিলেন।

আসলে আমি খুবই সরি, তিনি বললেন, হুট করে নিজের নামটা মনে করতে পারছিলাম না। আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে।

এটা কি প্রায়ই ঘটে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

তিনি একটু দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেছেন বলে মনে হলো। অবশেষে তিনি মাথাটা একবার নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, এটা ইদানীং প্রায়ই ঘটছে। আমি নিজের নামটা মনে করতে পারি না। অনেকটা ব্ল্যাক আউটের মতো হয়ে যায়।

হুম, আমি বললাম, আপনি কি অন্য জিনিসও ভুলে যান? এই যেমন নিজের জন্মদিন বা টেলিফোন নম্বর বা ধরেন আপনার কোনো একটা গোপন পিন নম্বর? এগুলো মনে করতেও কি অসুবিধা হয়?

একদম না। আসলে ছোটবেলা থেকেই আমার মেমরি খুব শার্প। আমার সব বন্ধুর জন্মদিন আমার মনে থাকে। তবে এই ভয়াবহ জিনিসটা ইদানীং শুরু হয়েছে। কখনো কখনো নিজের নামটা মনে করতে পারি না। ওই যে আপনাকে কিছুক্ষণ আগে যে বললাম, সে রকম হয়, ব্ল্যাক আউট হয়ে যায়। অবশ্য কিছুক্ষণ পর আমার স্মৃতি আবার ফিরে আসে। আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় এটা একটা খুব খারাপ রোগ? আলঝেইমারের পূর্বলক্ষণ?

আসলে সঠিক মেডিকেল টার্মটা আমি বলতে পারব না। তবে আমি কি কয়েকটা ব্যাপার নিয়ে আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?

নিশ্চয়ই।

আপনি কি আমাকে বলতে পারেন যে আপনার এই নিজের নাম ভুলে যাওয়া ব্যাপারটা ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে?

মহিলা চোখ বন্ধ করে একটু ভেবে বললেন, মাস ছয়েক আগে।

আচ্ছা আরেকটা প্রশ্ন করি, আমি বললাম, যদিও প্রশ্নটা অদ্ভুত, তা–ও করি। সে সময় কি আপনি গুরুত্বপূর্ণ কোনো জিনিস হারিয়ে ফেলেছিলেন? এই যেমন ধরেন, কোনো আইডি কার্ড বা ড্রাইভিং লাইসেন্স বা পাসপোর্ট অথবা ইনস্যুরেন্স কার্ড?

তিনি একবার ঠোঁট কামড়ালেন। গভীরভাবে চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ আমার মনে পড়ছে, তখন আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। চেরি ফুলের সময় ছিল তখন। একটা পার্কে অলসভাবে বসেছিলাম। লাঞ্চ টাইম ছিল। আমার হ্যান্ডব্যাগটা বেঞ্চে আমার ঠিক পাশেই রাখা ছিল। কমপ্যাক্ট দিয়ে আমার ঠোঁটের লিপস্টিকটা একটু ঠিক করে নিচ্ছিলাম। হুট করে দেখি, আমার পাশে হ্যান্ডব্যাগটা আর নেই। চারপাশে তাকালাম। কেউ ছিল না। শুধু আমি একা। কেউ যদি ব্যাগটা চুরি করতে আসে, তাকে তো আমার আশপাশে কোথাও দেখতে পাওয়ার কথা, কিন্তু সে রকম কাউকেই দেখলাম না।

তারপর?

কখনো কখনো তারা নিজেদের নাম মনে করতে পারে না। সে অবস্থায় আপনি যদি তাদের নামটা জিজ্ঞাসা করেন, তারা বলতে পারবে না। তখন একধরনের পরিচয়সংকট তৈরি হয়। এটাকে আপনি আইডেন্টিটি ক্রাইসিস বলতে পারেন। সে সময় আমার খুব খারাপ লাগতে শুরু করে। কারণ আমি জানি, সব দোষ আমার। আমার কারণেই মেয়েটা নিজের নাম মনে করতে পারছে না। যদিও আমি জানি, আমি একটা অন্যায় কাজ করছি, তবু আমি নিজেকে আটকাতে পারি না।


তারপর ওই দিন বিকেলবেলায় একটা খুব অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। পুলিশ স্টেশন থেকে আমার কাছে ফোন এল। তারা বলল যে তারা একটা হ্যান্ডব্যাগ খুঁজে পেয়েছে, ধারণা করছে ব্যাগটা আমার। ব্যাগটা থানার সামনে কেউ ফেলে রেখে গেছে। থানাটা আমি দুপুরবেলা যে পার্কে বসে ছিলাম, ওই পার্কের ঠিক পাশে। আমি থানা থেকে ব্যাগটা উদ্ধার করলাম। ব্যাগের মধ্য থেকে ক্যাশ টাকা বা ক্রেডিট কার্ড কিছুই নেওয়া হয়নি। আমার সেলফোন, এটিএম কার্ডও সব আগের মতোই আছে। শুধু ড্রাইভিং লাইসেন্সটা নেই। কেউ নিয়ে গেছে। পুলিশ খুবই অবাক হয়েছিল। টাকা বা ব্যাংকের কার্ড ফেলে রেখে কেউ যে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে যেতে পারে, সেটা তাদের কাছে খুব অস্বাভাবিক একটা ঘটনা মনে হয়েছিল।

আমি চুপ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কিছু বললাম না।

ঘটনাটা মার্চের শেষ দিকে ছিল, তিনি বললেন, আচ্ছা আপনি কিছু একটা হারিয়ে যাওয়ার কথা জানতে চাইলেন কেন? আপনার কি মনে হয় আমার নাম ভুলে যাওয়া এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স হারিয়ে যাওয়া—এই দুটি ঘটনার মধ্যে কোনো যোগাযোগ আছে?

আমি দ্রুত মাথা নাড়লাম। সিনেগাওয়া মাংকির গল্প ওই সুন্দরী মহিলার সামনে আমি তুলতে পারিনি। বললাম, আসলে আমি কিছু ভেবে বলিনি। এমনি হুট করে কথাটা মাথায় এল, তাই জিজ্ঞেস করলাম।

তাকে দেখে মনে হলো না, তিনি আমার কথাতে মন থেকে সায় দিতে পারছেন। চোখেমুখে সন্দেহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাকে সেই মুহূর্তে আরও কিছু জিজ্ঞেস করাটা একটু ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেত আমার জন্য। তারপরও খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন আমাকে করতে হয়েছিল।

আচ্ছা আপনি কি ইদানীং কোনো বানর দেখেছেন? জানতে চাইলাম আমি।

বানর? তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি বলতে চাচ্ছেন, বানর মানে অ্যানিমেল? মানে মাংকি?

হ্যাঁ।

তিনি বিভ্রান্তভাবে মাথা নাড়লেন। বললেন, আমার মনে হয় না গত কয়েক বছরের মধ্যে আমি কোনো বানর দেখেছি। এমনকি চিড়িয়াখানায়ও যাইনি আমি।

আমি মনে মনে ভাবলাম, সিনেগাওয়া মাংকি তার নাম চুরির অভ্যাস কি আবার ফিরে পেল? যদিও সে আমাকে বলেছিল, সে আর চুরি করবে না। এবং যে সাতজন মেয়ের নাম সে ইতিমধ্যে চুরি করেছে, তাদেরই বুকে লালন করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে।

কিন্তু এমনও তো হতে পারে, বানরটা কথা রাখেনি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। সে একটা জটিল মানসিক রোগী এবং মিথ্যাবাদী বানর। তার মস্তিষ্কের ডোপামিন লেভেল তাকে আবার একটা নাম চুরি করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল। আর সে তার পুরোনো অভ্যাসবশত নাম চুরি করতে শুরু করে।

এই অবস্থায় আমার মনে আরেকটা সন্দেহ ঢুকে পড়ে। সম্ভবত, কোনো একদিন আমি নিজেই এটা করার চেষ্টা করব। কোনো এক ঘুমহীন রাতে, যেদিন আমার চিন্তাভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যাবে, নিজেকে বড় একা মনে হবে, কোনো এক কাল্পনিক নারীর কথা আমার মাথার মধ্যে আসবে। আমি সেদিন নাম চুরি করব। যে নারীকে আমি পছন্দ করি, তার নেমট্যাগটা হাতে নিয়ে আমি লেজার তাক করার মতো মনোযোগ দিয়ে সেটার দিকে তাকাব। তার নামটাকে আমার ভেতর শুষে নেব। আমার ভেতরের সব ভালোবাসা যার কোনো গন্তব্য নেই, সেগুলো একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। কেমন লাগবে আমার?

না না, এটা কখনোই হবে না। আসলে সারা জীবনে আমি কোনো জিনিস চুরি করতে পারিনি। আমার দ্বারা কাজটা হবে না। যদিও নামের কোনো শারীরিক আকার নেই, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো ফৌজদারি আইনও নেই, তারপরেও শেষ পর্যন্ত এটা চুরি, একটা অপরাধ। আমি এটা করতে পারব না।

ভালোবাসার চূড়ান্ত রূপ সম্ভবত চূড়ান্ত রকমের একাকিত্ব। এ রকমই হওয়ার কথা। এরপর আমি যখনই ব্রুকনারের সিম্ফনি শুনি, আমি যেন সেই সিনেগাওয়া মাংকিকে চোখের সামনে দেখতে পাই। সেই হট-স্প্রিং শহরে একা একা একটা পুরোনো মোটেলে ঘুমিয়ে আছে। অথবা আমরা একসঙ্গে মেঝেতে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে বিয়ার খাচ্ছি।

সেই ট্রাভেল ম্যাগাজিনের সম্পাদকের সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হয়নি। তাই জানাও হয়নি, তার জীবনে এরপর কী ঘটেছিল। আমি শুধু এটাই আশা করতে পারি যে নাম চুরি যাওয়ায় তাকে সত্যিকারের কোনো অসুবিধায় পড়তে হয়নি। তার তো দোষ ছিল না কোনো।

মহিলার জন্য আমার মাঝেমধ্যে খুব খারাপ লাগে। কিন্তু তারপরেও তাকে কখনো সিনেগাওয়া মাংকির বিষয়টা বলা হয়ে ওঠে না।

নির্ঘণ্ট: হট-স্প্রিং শহর: জাপানে প্রাকৃতিকভাবে উষ্ণ জলাধারসংবলিত কিছু শহর আছে। জাপানিজে এগুলোকে বলে ওনসেন, আর ইংরেজিতে হট-স্প্রিং। এসব জলাধার ঘিরে জাপানে পর্যটন উপশহর গড়ে উঠেছে।


অন্য আলোতে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com