Thank you for trying Sticky AMP!!

তাইপেতে হঠাৎ আকরাম খান

দেয়ালের একটি অংশজুড়ে রয়েছে আকরাম খানের ছবি

এক বছর আগে ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি কোরিওগ্রাফার ও নৃত্যশিল্পী আকরাম খানের নাচের দল ‘দি আকরাম খান কোম্পানি’ এসেছিল জাপানের ইয়োকোহামা শহরে, তাদের বিখ্যাত প্রযোজনা ছোট্ট দেশ নিয়ে। তখন সুযোগ হয়েছিল বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ ব্যক্তিত্বের অসাধারণ সেই নৃত্য পরিবেশনার ওপর প্রথম আলোতে লেখার পাশাপাশি জাপানের নাগরিক সম্প্রচার কেন্দ্রের বেতারের জন্য একটি অনুষ্ঠান করার। আকরাম খান সেবার নিজে জাপানে উপস্থিত ছিলেন না। তবে সেই অনুপস্থিতির অভাব পূরণ করে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলে। তখনই তিনি জানিয়েছিলেন, নতুন একটি প্রযোজনার কোরিওগ্রাফি এবং পরিবেশনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ইচ্ছা সত্ত্বেও দলের সঙ্গে জাপানে যাওয়া হয়নি তাঁর।

এরপর ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিনে গিয়ে খোঁজখবর করে জেনে নিতে পেরেছিলাম নতুন সেই পরিবেশনা সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য।

গত বছর ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির শততম বার্ষিকী। এ উপলক্ষে ব্রিটিশ সরকারের সাংস্কৃতিক বিভাগ থেকে আকরাম খানকে অনুরোধ করা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া প্রায় ১৫ লাখ ভারতীয় সেনার অভিজ্ঞতার ওপর আলোকপাত করে একটি নৃত্যনাট্য রচনার জন্য। দি আকরাম খান কোম্পানির জেনোস হচ্ছে সেই অনুরোধের ফসল। নিজের অন্যান্য কোরিওগ্রাফির মতোই এটিকে বিন্যস্ত করেছেন আকরাম—মুখে কথা না বলে নৃত্যের মাধ্যমে।

 জেনোস–এ মুখের ভাষায় না বলা নৃত্যকথার মধ্য দিয়ে আকরাম ফুটিয়ে তুলেছেন দেশ থেকে অনেক দূরের যুদ্ধের ময়দানে ভারতীয় সেনার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা। প্রায় ৭০ মিনিটের ওই উপস্থাপনার প্রায় পুরোটাজুড়ে আছে তাঁর একক নৃত্য, যেখানে বরাবরের মতো চমৎকারভাবে তিনি সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন ভারতের কত্থকের সঙ্গে পশ্চিমের ব্যালে ও সমকালীন নাচের। মূল চরিত্রে তিনি যেভাবে অভিনয় করেছেন, তাতে যুদ্ধের ভয়াবহতাই কেবল নয়, একই সঙ্গে অনেক দূরের দেশের বৈরী ময়দানে যুদ্ধ করতে যাওয়া ভারতীয়দের বিড়ম্বনার দিকটিও দারুণভাবে উঠে এসেছে। যেমন, শেষ দৃশ্যে ভেসে ওঠে সমস্ত দেহে কাদা লেপ্টে থাকা সৈনিক, আর নাচ ও অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে সে পৌঁছে দেয় যুদ্ধের নির্মমতার বার্তা।

 জেনোস–এর কোরিওগ্রাফির কাজ শুরু করার সময় আকরাম খান ঘোষণা করেছিলেন, এটি হবে তাঁর শেষ একক মঞ্চ উপস্থাপনা, এরপর থেকে কোরিওগ্রাফির কাজেই কেবল নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন তিনি। জেনোস–এর পর নতুন যে কাজে তিনি হাত দিয়েছিলেন, সেটি হলো থেওফিল গুতিয়েরের গল্পের ভিত্তিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের বিখ্যাত অপেরা জিসেলের ভিন্ন রকম এক মঞ্চ উপস্থাপনা, যেখানে বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের বঞ্চনার পাশাপাশি ইউরোপের উদ্দেশে পাড়ি জমানো শরণার্থীদের দুর্দশার বর্ণনাও নৃত্যনাট্যে তুলে এনেছেন আকরাম।

মেমোরিয়াল চত্বরের প্রবেশপথের দুপাশজুড়ে রয়েছে জাতীয় জাদুঘর ও জাতীয় থিয়েটার ভবন

গত বছরের মে থেকে শুরু করে প্রায় সারা বছর ধরে বিলেতের বিভিন্ন শহরে মঞ্চস্থ হয় জেনোস। এরপরেই মঞ্চে এল জিসেল। ফলে আমার ধারণা ছিল, জেনোস হয়তো সাময়িক একটি মঞ্চ পরিবেশনা হয়ে থাকবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির শতবর্ষ পার হয়ে গেলে এর আবেদনও হয়তো ফুরিয়ে যাবে। তবে পরবর্তীকালে প্রযোজনাটি ব্রিটেন ছাড়াও ইউরোপের অন্য গুটিকয়েক দেশে পরিবেশিত হয় মূলত দুই কারণে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো, অসাধারণ পরিবেশনা হিসেবে বিলেতের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সংবাদমাধ্যমেও প্রশংসিত হওয়া, এবং দ্বিতীয় হচ্ছে, একক মঞ্চ পরিবেশনা হিসেবে এটি আকরাম খানের শেষ কাজ। সংগত কারণে ইউরোপে মঞ্চায়নের পালা শেষ করে জেনোসকে এখন যেতে হচ্ছে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও।

তাই বলে তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেতে হঠাৎ করে আকরাম খানের পরোক্ষ দেখা আমি পেয়ে যাব, তা কিন্তু একেবারেই ভাবনায় আসেনি আমার।

সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে অল্প কয়েক দিনের জন্য অবকাশ যাপন করতে তাইওয়ান গিয়েছিলাম। রাজধানী তাইপের দর্শনীয় কয়েকটি জায়গার মধ্যে একটি হলো চিয়াং কাই শেক মেমোরিয়াল, দৃষ্টিনন্দন ভবনে তাইওয়ানের প্রতিষ্ঠাতার বিশাল এক মূর্তির পাশাপাশি যেখানে আছে একটি জাদুঘরও। তবে স্মৃতিসৌধ চত্বরজুড়ে এখানে আরও রয়েছে জাতীয় জাদুঘর ও জাতীয় থিয়েটার মঞ্চ, যে দুটি ভবনই তৈরি করা হয়েছে চীনা স্থাপত্য রীতি অনুসরণে।

ওখানে যাওয়ার পাতাল রেলস্টেশনের নামও চিয়াং কাই শেক মেমোরিয়াল। একদিন পাতাল রেলস্টেশন থেকে ওপরে উঠতেই হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেল স্টেশন ভবনের ভেতরে দেয়ালজুড়ে সাঁটা এক পোস্টারে, লেখাগুলো চীনা ভাষায় হলেও আকরাম খানের বড় একটি ছবি দখল করে আছে পোস্টারটির একটি অংশ। এতে চীনা ভাষার বর্ণনার সঙ্গে এক জায়গায় ইংরেজিতেও বড় করে লেখা ছিল ‘জেনোস’। ফলে আকরাম যে তাইপেতে আছেন, এটি বুঝতে আমাকে আর গোয়েন্দা হতে হয়নি।

কিন্তু মঞ্চ পরিবেশনার তারিখের দিকে চোখ পড়তে কিছুটা হতাশ আমাকে হতে হয়েছে বৈকি। কারণ, তাইপের জাতীয় থিয়েটার মঞ্চে জেনোস–এর মঞ্চ–পরিবেশনার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে নভেম্বর মাসের প্রথম চার দিন। ফলে আকরাম খান যে এখনো তাইপে এসে পৌঁছাননি, সে বার্তা আমাকে হতাশ করলেও, অন্যদিকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই গুণী নর্তক ও কোরিওগ্রাফার যে নিজ প্রতিভার গুণে আমাদের দেশটিকেও বিশ্বজুড়ে আরও বেশি পরিচিত করে তোলায় অবদান রেখে যাচ্ছেন, এ ভাবনা আমাকে আনন্দ দিতে পেরেছে।