Thank you for trying Sticky AMP!!

নগরবাসী পাখি হলো

অলংকরণ: তুলি

কোনো এক কালের কথা। ছিল এক অদ্ভুত শহর। শহরের নাম নেইনেই। নেইনেই শহরে সব আছে—উঁচু উঁচু বাড়ি, গাড়ি, বৃষ্টি হলে ছাতা, গরমের দিনে ফলের রস, দশাসই এক মেয়র, অনেকগুলো অফিস, নথিপত্রের ধুলো ঝাড়ার ঝাড়ু; তারপরও সবার মনে হয় কী যেন নেই। কোনো কিছুর তো অভাব নেই! তারপরও এমন মনে হবে কেন? শহরের লোকজনকে কোনো কাজও করতে হয় না। মশা মাছি নেই, অফিসের কেরানিদের তাই মাছি তাড়াতে হয় না। এমনকি আকাশে কোনো পাখিও নেই যে তারা ডাস্টবিনের নোংরা ছিটিয়ে নগরকর্মীদের কাজ বাড়িয়ে দেবে। আসলে নতুন করে কিছু পাওয়ার আনন্দ নেই কারও মাঝে।

একদিন নেইনেই শহরে এল এক আগন্তুক। আলখাল্লা পরা লোকটা নিজেকে জাদুকর পরিচয় দিল। শহরে এসেই নাক সিটকে বলে বেড়াল, ‘এই শহরে দেখি কিছুই নেই!’ শুনে তেড়ে এল সবাই। বলল, ‘সাহস তো কম নয় তোমার!’ জাদুকর ফের ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এই শহরের মানুষগুলো চাইলে পাখি হতে পারে না।’ জাদুকরের এই কথায় নগরীতে হইচই পড়ে গেল। মেয়রের কানেও গেল কথাটা। উনিও পড়লেন চিন্তায়। নিজের বিশাল ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে ভাবলেন, ‘আসলেই তো!’ নগরীর বুড়ো খুড়ুম চাচাও বাজখাঁই গলায় বলে বেড়াতে লাগলেন, ‘আগেই বলেছিলাম, ‘এই নচ্ছার শহরে কিসসু নেই। কেউ পাখি হতে পারে না এখানে। এ কেমন শহর রে বাপু! আমি চললাম।’

জাদুকর আসার দুদিনের মধ্যেই গোটা নগরীতে তুমুল হট্টগোল। যে যাকে পাচ্ছে তাকেই বলছে, ‘এ শহরে কিছু নেই। আমরা চাইলেই পাখি হতে পারছি না। মেয়রের উচিত বিষয়টার একটা সুরাহা করা।’

কিন্তু সুরাহা করবে কী! মেয়র নিজেই চুপিসারে হাজির জাদুকরের কাছে। জাদুকরের চেম্বারে গিয়ে গমগম করে বলল, ‘তুমি কি আমাকে পাখি বানিয়ে দেবে?’ জাদুকর মেয়রের আপাদমস্তক দেখে বলল, ‘পারব বটে পাখি বানাতে। কিন্তু পাখি হয়ে করবেটা কী?’ মেয়র খুশিতে নড়েচড়ে বসল। বলল, ‘কী আর করব, এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াব। তবে হ্যাঁ, আমাকে বড়সড় পাখি বানাতে হবে। আমি হলাম মেয়র। আমার একটা দাম আছে। কুকুর বিড়াল যেন আবার আমাকে খেয়ে না ফেলে। যত টাকা লাগে দেব।’ জাদুকর মেয়রকে তার জাদুর চাদর দিয়ে ঢেকে দিল।

পরদিন সকালে নগরীর রাস্তায় দেখা গেল এক ইয়া বড় লাল ঝুঁটিওয়ালা মোরগ। মোরগের চেহারা অবিকল মেয়রের মতো। কুক্কুরুক কুক ডাকতে ডাকতে মোরগটা চলে গেল অফিসে। কিন্তু মোরগটাকে খুশি খুশি মনে হলো না। খুশি হবে কী করে। বাজারের মুরগিওয়ালা তার পিছু নিয়েছে। ধরতে পারলে অনেক টাকায় বেচা যাবে। মোরগটা যে আসলে মেয়র সেটা তারা ধরতে পারলেও চেপে গেছে। জাদুকরের ওপর মেয়রের অনেক রাগ হলো। পাখি বানিয়েছে ঠিকই কিন্তু মোরগ তো উড়তে পারে না। মোরগরূপী মেয়র জাদুকরের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিল। সুরাহা করতে নগরের উকিলেরা গেল জাদুকরের কাছে।

জাদুকর উকিলদের প্রস্তাব দিল, ‘তোমরা আমার পক্ষে থাকলে তোমাদেরও পাখি বানিয়ে দেব, এক টাকাও লাগবে না। বলো কেমন পাখি হতে চাও তোমরা?’ উকিলেরা সবাই খুশি। বলল, ‘আমরা বাপু দামি পাখি হব। কিন্তু এই কালো কোটটা ছাড়তে পারব না।’ সেটাই হলো। কিছু সময় পর জাদুকরের ঘর থেকে বেরিয়ে এল একপাল পেঙ্গুইন। হেলেদুলে পেঙ্গুইনরূপী উকিলেরা চলে গেল যার যার অফিসে। তারাও নাখোশ। কালো কোট পেয়েছে ঠিক, কিন্তু পেঙ্গুইন তো উড়তে পারে না!

এবার জাদুকরের কাছে গেল নগরীর হোমরাচোমরা লোকগুলো। সবার এক কথা, ‘পাখি বানাবে ঠিক আছে, কিন্তু শক্তিশালী এবং সবচেয়ে বড় পাখি বানাতে হবে। যেন সবার আগে গিয়ে খাবার খেতে পারি। সবাইকে দাবিয়ে রাখতে পারি।’ ব্যস, জাদুকর তাদের বানিয়ে দিল উটপাখি। সবচেয়ে বড় পাখি তো এটাই! কিন্তু হায়! উটপাখিও যে উড়তে পারে না, এটা লোকগুলোর জানা ছিল না।

নগরীর কোনো কাজেকর্মে নেই এমন একদল ধনী ভদ্রলোক গেল জাদুকরের কাছে। বলল, ‘যে পাখিই বানাও না কেন, আমরা বাপু আরাম–আয়েশে থাকতে চাই। দুবেলা খাবার চাই, পানিও চাই।’ জাদুকর তাদের বানিয়ে দিল খাঁচার পোষা পাখি! খাঁচায় থাকার কারণে যারা উড়তে ভুলে গেছে।

সবশেষে এক কিশোরী গেল জাদুকরের কাছে। নেইনেই শহরে সম্ভবত সে-ই একমাত্র দুঃখী মানুষ। জাদুকরকে গিয়ে বলল, ‘আমার আর কারখানায় কাজ করতে ইচ্ছে করে না। মালিক অনেক খাটায়। আমাকে পাখি বানিয়ে দাও।’ জাদুকর বলল, ‘কী পাখি হতে চাও?’ মেয়েটা বলল, ‘স্বাধীন পাখি। উড়ে বেড়াব, ঘুরে বেড়াব। সারা দিন চিত্কার করে খেলব।’ জাদুকর তাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিল। খানিক পর চাদরের এক কোনা দিয়ে ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে গেল একটা চড়ুই। কিচিরমিচির করে জাদুকরকে ধন্যবাদ জানাল চড়ুইটা। তারপর আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। ডানা ঝাপটে চোখের পলকে ফুড়ুৎ।