Thank you for trying Sticky AMP!!

বুখারায় বারো রকমের মানুষ (২য় পর্ব)

[কি ছিল প্রথম অংশে—লেখক বুখারা যাবেন। পথে জাপানী তরুণী সাউরির সঙ্গে পরিচয়, সমরখন্দে। ট্যাক্সি করে তারা পৌঁছালেন বুখারার পুরনো অংশে। তার আগে পরিচয় ঘটেছে বুখারার কৌতূহলোদ্দীপক নানা চরিত্রের সঙ্গে। সেই অভিজ্ঞতা আরো বৈচিত্রময় হয়ে উঠেছে এ পর্বে। ]

ওল্ড বুখারা থেকে বের হয়ে আবারও পুরোনো শহরের গলি-ঘুপচির পথ ধরি। এখানে-ওখানে কয়েকটি দোকানের টিমটিমে আলো। যাওয়ার বেলায় যে কয়টি দোকানের নিষ্প্রভ বাতি চোখে পড়েছিল, তারাও এই কনকনে রাতে ঝাঁপি বন্ধ করে পালিয়েছে। পথের একটি বাঁক ঘোরার সময়ে হঠাৎ সেই বিকেলে পরিচয় হওয়া জার্মানদ্বয়ের সঙ্গে দেখা হয়। ওরাও রাতের খাবার সারতে বাইরে বেরিয়েছিল। এখন ফিরছে। ইট বিছানো পথটিতে ধীরলয়ে হেঁটে হোটেলে ফেরার সময়ে আমাদের বেশ কিছু গালগল্প হয়। সেই ঢ্যাঙা লোকটিই মূলত আলাপ চালিয়ে নিয়ে যায়। আর তার সঙ্গী যুবকটি হয়তো ইংরেজি ততটা না জানার দরুন কেবল মাথা নেড়ে হুঁ-হাঁ করে। আমাদের মধ্যে মূলত কথা হয় বাংলাদেশ আর উপমহাদেশ নিয়ে। ভদ্রলোক ফ্রাঙ্কফুর্টে চামড়ার ব্যবসা করেন। হোলসেলার। তার কাছ থেকে মাল কিনে অনেকে পাইকারি বাজারে বিক্রি করে। সেই সূত্রে ফ্রাঙ্কফুর্টের বহু পাকিস্তানি আর বাংলাদেশি চামড়ার পণ্য ব্যবসায়ীকে চেনেন। তার কাছ থেকে জানলাম চমকপ্রদ এক তথ্য। ব্যবসার জন্য তিনি মূলত চামড়ার পণ্যগুলো আমদানি করে আনেন মরক্কো কিংবা আলজেরিয়া থেকে। যদিও মূল চামড়া যায় বাংলাদেশ থেকে। মরক্কোতে কেবল ফিনিশিং শেষে ভোগ্যপণ্যটি প্রস্তুত করা হয়। তাহলে চামড়ার মূল উৎস স্থল বাংলাদেশ থেকেই পণ্য উৎপাদন করে ইউরোপের মার্কেটে নিয়ে যান না কেন, এ প্রশ্নের জবাবে ভদ্রলোক কিছুটা আশাহত কণ্ঠে বলেন, ‘দু-একবার সে চেষ্টা করেছি। কিন্তু পরে জানতে পারি, বাংলাদেশের চামড়াশিল্পের মালিকেরা শিশু শ্রমিক ব্যবহার করেন। ওসব আমাদের মার্কেটে একবার জানাজানি হলে আমার আমদানি করা পণ্য কোনো ক্রেতা কিনবে না। তাই আমি আর ঝুঁকি নিতে চাইনি। বাংলাদেশ যদি ইউরোপের বাজারে সরাসরি চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করতে চায়, তাহলে উচিত হবে এই শিশুশ্রমের ব্যাপারটিকে পুরোপুরি নির্মূল করা।’ তবে বাংলাদেশ নিয়ে নিরাশাময় উক্তির বাদে তিনি ভিন্ন এক গল্প বলে আমাকে একেবারে চমকে দেন। আমরা সেই মুহূর্তে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেছি আমাদের হোটেলের প্রবেশদ্বারের কাছে। সেখানটায় কিছুটা আলো আছে। সেই আলোতে নিজের মুখখানিকে পেতে বললেন, ‘আমার গালের দিকে ভালো করে খেয়াল করো তো। কোনো অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পাও?’ এমন নয় যে এখানে একেবারে ঝলমলে আলোর বন্যা বইছে, তবে ভদ্রলোকের মুখাবয়ব ভালোভাবে দেখার জন্য খুব যে অপর্যাপ্ত, সেটিও হয়তো বলা যাবে না। আমি সেদিকে ভালো করে তাকিয়ে অস্বাভাবিক কিছুর অস্তিত্ব ধরতে পারি না। আমার এ মন্তব্য শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে তিনি বলেন, ‘বছর ছয়েক আগে আমার একটা খুব বাজে ধরনের মোটরসাইকেল অ্যাক্সিডেন্ট হয়। গালের ডান পাশটা একেবারে থেঁতলে যায়। আমি শরণাপন্ন হই ফ্রাঙ্কফুর্টের এক বাংলাদেশি প্লাস্টিক সার্জনের। তিনি এমন নিখুঁত অপারেশন করেন যে এই দেখো তুমিও কিছু ধরতে পারলে না। এরপর থেকে বাংলাদেশি ডাক্তারদের আমি বেশ সমীহের চোখে দেখি।’

পরদিন সকালে হোটেলে প্রাতরাশ সেরেই আমি সাউরির খোঁজে পথে নামি। মিনারের সামনে যেখানে ওর থাকবার কথা ছিল, সেখানে ও নেই। তার পরিবর্তে সেখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছেন উজ্জ্বল নকশা অঙ্কিত নানা ধরনের তৈজস নিয়ে বসা কয়েক ফেরিওয়ালা। গতকাল রাতের বৃষ্টি বিদায় নিলেও রেখে গেছে সঙ্গে করে আনা শৈত্যপ্রবাহ। আকাশ এখনো মেঘলা। মেঘের ফাঁক গলে সূর্য এখনো সুবিধে করে উঠতে পারেনি। কেমন যেন বেগুনি সকাল। বেলেপাথরে মোড়া মসৃণ চত্বরটি মানুষের অভাবে খাঁ খাঁ করছে। চত্বরের মাঝখানে হাম্মামখানা। সামনের দিকে দোকান সাজিয়ে সবে একজন বসেছেন। তাঁর ভান্ডারে আছে পিতলের নকশা করা নানা ধরনের তালা আর কাঠের তৈরি হরেক পদের পুতুল। আরও আছে সিলভারের তৈরি অদ্ভুত একধরনের কাঁচি, যার অগ্রভাগটি পাখির মুখাবয়বের মতো। অস্থায়ী এই দোকানের পাশ দিয়ে সরু গলি। হয়তো এ পথে গতকাল রাতে হেঁটেছি। কিন্তু নিকষ কালো আঁধারের মধ্যে হাঁটায় এ গলির কোনো স্মৃতি মস্তিষ্ক খুঁড়ে তুলে আনতে পারছি না। গলিটি বেয়ে কিছু দূর যেতেই চৌকোনা একটি বদ্ধ স্থান। ওপরে হাম্মামখানার বর্ধিত ছাদ। এখানে চারধারে ঢাকার নিউ মার্কেটের হকারদের মতো করে বাল্বের আলো জ্বেলে পসরা নিয়ে বসছেন কয়েক বিক্রেতা। তাঁদের মধ্যে যিনি বিক্রি করছেন সুই-সুতোর কাজ করা বালিশের কুশন, তাঁর দোকানের সমুখেই আমি আবিষ্কার করি সাউরিকে। বেশ নিবিষ্ট মনে একটি কুশনের কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।

সাউরির পরনে আজ সিলভার রঙের পাতলা জ্যাকেট। ভেতরে হালকা সবুজ রঙের ফুলস্লিভ টি-শার্ট। গলায় ঝুলছে গতকাল ট্রেনে দেখা সেই ক্যামেরা। পাতলা ঠোঁটে হালকা লিপস্টিকের চিহ্ন। কাঁধ অবধি নেমে আসা চুলগুলো হাওয়ায় খানিক উড়ছে। আগেই জেনেছি, সাউরি স্নাতক পাস করেছে নাইন-ইলেভেনের পরপর, তাই বয়সের হিসাবে ও হয়তো চল্লিশের খুব কাছাকাছি। কিন্তু রূপলাবণ্যের দিক দিয়ে বিচার করলে সেই অমোঘ সত্যকে মেনে নেওয়া কষ্টকর। ওকে দেখে মনে হয়, বয়স বড়জোর ত্রিশ। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ও মিষ্টি হেসে ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর জানতে পারি, আমাকে খুঁজতে কিছুক্ষণ আগে ও মিনারের কাছে গিয়েছিল ঠিকই, তবে সেটি ভুল মিনারের কাছে। আর সে জন্যই আমি ওকে খুঁজে পাইনি। তবে এবারে যেহেতু খুঁজে পাওয়া গেলই, আমরা ঠিক করি বাকি পুরোটা দিন একসঙ্গে বুখারার নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াব।

সাউরির কাছে জাপানিজ ভাষায় লেখা একটা ট্রাভেল বুক ছিল। উজবেকিস্তানের ওপর লিখিত। বোঝা যায়, এখানে আসার আগে ও ভালো রকমের গবেষণা করে এসেছে। সেই বইয়ের একটি বিশেষ পাতা খুলে ও বলে, ‘চলো, এই মসলার দোকানটা আগে খুঁজে বের করা যাক।’ সে পাতার দিকে চেয়ে দেখি, বিশাল ভুঁড়িওয়ালা এক উজবেক তার মসলার সম্ভারে নিমজ্জিত দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সহাস্যবদনে জাপানিজ সাংবাদিকের সামনে পোজ দিয়েছেন। সাউরির শখ হয়েছে সেই মসলার দোকানের মালিকের সঙ্গে মোলাকাত করার। মসলার দোকানটি আমরা খুঁজে পাই সহজেই। দুই গলি পরেই সেই দোকানের অধিষ্ঠান। তবে সাউরির আশায় ছাই দিয়ে দোকানে তখন আসীন মালিকের যুবা বয়সী ছেলে। সাউরি তাকে বইয়ের পাতায় থাকা ছবিটি দেখালে ছেলেটি খুব একটা অবাক না হওয়ার ভঙ্গিতে বলে, ‘তুমিই প্রথম নও, এমন আরও অনেক বিদেশি এসে আমার বাবার খোঁজ করে। ওনার বয়স হয়েছে। আজকাল দোকানে আর খুব একটা আসেন না। আমিই মূলত দোকান চালাই।’ সাউরির যখন ছেলেটির সঙ্গে এমন আলাপ করছে, আমি তখন চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি দোকানের পণ্যসম্ভারের ওপর। ভারতীয় উপমহাদেশে যেসব মসলার সঙ্গে আমরা পরিচিত, সেগুলো এখানে তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে নাম না-জানা আরও হরেক পদের মসলা। এককালে হয়তো এসব মসলার অনেকগুলোই মুঘলদের হাত ধরে, সিল্ক রুটের বণিকদের হাত ধরে পৌঁছে গিয়েছিল আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে। জয়ফল, জয়ত্রী, লবঙ্গ, আলুবোখারা, দারুচিনি, এলাচি—এসবের সম্মিলিত রসনা উদ্রেককারী গন্ধ আমার কাছে তাই খুব পরিচিত হলেও সাউরির কাছে একেবারেই অজানা এক গন্ধ। সাউরির পরম আগ্রহে প্রতি থলে থেকে একেক ধরনের মসলা হাতে নিয়ে হালকা শুঁকে দেখার চেষ্টা করে। তাতে দোকানি ধরে নেয়, ও বুঝি মসলা কিনে জাপানে নিতে ইচ্ছুক। সে তাই লাউ আকৃতির কাঠের বয়ামে পুরে রাখা কিছু মসলা দেখিয়ে সেগুলো বেচার ব্যাপারে বেশ ঝুলোঝুলি করে। কিন্তু ক্রয়সংক্রান্ত ব্যাপারে সাউরির অনাগ্রহ দেখে কিছুটা বিরসবদনে অন্য কাজে মন দেয়।

সেই মসলার ব্যাপারীকে ‘রাখমাত’ অর্থাৎ কিনা ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এসে আমরা আবদুল আজিজ খান মাদ্রাসার সন্ধান পাই। বিশাল ভবন। ভাঙা দেউরি। ঢোকার মুখে মিম্বরের মতো স্থাপত্য। তার দেয়ালের গায়ে টাইলসের কারুকাজের মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য দেখে বোঝা যায়, নিকট অতীতকালে এ দেয়ালের ওপর কয়েক দফা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চালানো হয়েছে। অনেক সময় পুরোনো ঝাপসা ছবির ওপর নতুন করে তুলির আঁচড় দিয়ে যেমন করে ফিরিয়ে আনা হয় খানিক জৌলুশ, তেমনি এখানেও কিছু কিছু টাইলস জোড়া লাগিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুছে যাওয়া আরবি কুফিক বর্ণ কিংবা ফুলের তোড়াসমেত ফুলদানির অবয়ব। কয়েক শতক আগে নিয়ত ছাত্রদের কল্লোল থাকলেও আজ এটি একেবারেই পরিত্যক্ত। ভেতরের চৌহদ্দিতে বাকবাকুম করে উড়ে বেড়াচ্ছে কয়েকটি পায়রা। পায়রাদের পিছু ধাওয়া করে ছুটতেই দেখি, এই সাতসকালে সেই নীরব ভবনের বারান্দার এখানে-সেখানে ঝোলানো অসংখ্য হাতে আঁকা ছবি। বিক্রেতা কেবল একজন। এক বালক। বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সে সকালের রোদ পোহানোর সঙ্গে সঙ্গে সস্তা দামের মোবাইল ফোনে গেম খেলছে। আমরা একটি ছবির সামনে থমকে দাঁড়াতে সেই ছেলেটি উঠোন পেরিয়ে দৌড়ে এসে বলে, ‘দিস ওয়ান লাইলি-মজনু স্যার। গুড প্রাইস। প্লিজ বাই।’

যে ছবিগুলো এখানে বিকোচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কে দুকথা না বললেই নয়। বাংলাদেশে কিংবা ইউরোপ-আমেরিকার নানা গ্যালারিতে আমরা যে আঁকা ছবিগুলো দেখি, এখানকার ছবিগুলো স্পষ্টতই তার থেকে ব্যতিক্রমী। আমাদের সুপরিচিত ছবিগুলো এমন যে, খালি চোখে বেশ দূর থেকেও আমরা সেগুলো দেখতে পারি। দেয়ালে টানিয়ে রাখলেও ছবির বিষয়বস্তু বুঝতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু এই উজবেক চিত্রগুলো যেন নকশিকাঁথার সূক্ষ্ম কারুকাজ। কাছ থেকে খুব ভালোভাবে নিরিখ না করলে তার সবকিছুই প্রতিভাত হয় না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে আবিষ্কার করা যায় ছবির এখানে-ওখানে লুকিয়ে থাকা নানা রহস্যকে। এদের বলা চলে সূক্ষ্মালেখ্য কিংবা মিনিয়েচার পেইন্টিং। এদের মাঝে মূলত ঝকঝকে লাল, নীল আর সোনালি রঙের উজ্জ্বল উপস্থিতি। সোনালি রংটি যেন সোনা ধোয়া জল। তেমনই চিকচিক করে পটের মাঝে। আর নীল রংটি বেশ গাঢ়। হালকা নীল নয়। সাদা কাপড় ধুয়ে আমরা যে নীল ঢেলে দিই, সেই উজ্জ্বল নীল। আগেকার সময়ে ইন্দ্রনীল পাথর গুঁড়ো করে এ রং বানানো হতো। তো এমন সব চোখধাঁধানো রঙে আঁকা ছবির চল শুরু হয়েছিল বহু শতাব্দী আগে, সেই তিমুরিদ বংশের পত্তনের সময় থেকে। তবে এখনকার উজবেক মিনিয়েচারে যেমন করে মানব দেহভঙ্গি, পারস্পরিক সম্পর্কের প্রাণবন্ততা, ঘোড়ার ক্ষিপ্রতা, আসনভঙ্গি, কাপড়ের ভাঁজ, সমরবিদের দুরন্ত দুর্বার গতি ফুটিয়ে তোলা হয়, শুরুর দিককার ছবিতে কিন্তু সেগুলো ছিল অনুপস্থিত। শুরুতে কেবল ক্যালিগ্রাফিক নকশার মধ্যেই এই মিনিয়েচারের অঙ্কন আবর্ত সীমাবদ্ধ ছিল। সেই বন্দী হ্রদের জলকে শাখা নদীর মাধ্যমে সাগরের অপার জলরাশির সঙ্গে যুক্ত করে দিল রেশমপথের বাণিজ্য আর মুঘলদের ভারত জয়ের ঘটনা। রেশম বাণিজ্যের পথটি বিস্তৃত ছিল সেই চীন থেকে ইতালির ভেনিস বন্দর অবধি। সে পথ বেয়ে বাণিজ্যের টাকাকড়ির সঙ্গে এল নব চিত্ররীতি। সমরখন্দ বুখারা শিল্পীরা শিখে নিলেন বাইজান্টাইন মুখাবয়ব আর চৈনিক ধারার আসনভঙ্গি। শুধু নকশা আঁকা ছেড়ে তারা বেছে নিলেন জীবন্ত প্রাণীর প্রতিকৃতিকে, ছবির বিষয় হিসেবে বেছে নিলেন লোকায়ত চরিত্র কিংবা কাহিনিকে। ওদিকে মুঘলরা যখন ভারতবর্ষে গেলেন, তখন এমন সব কাহিনি ফুটিয়ে তোলা ছবির পেছনে সংগোপনে জায়গা করে নিল ভারতবর্ষের পত্রপুষ্প। আজ তাই চারধারে পাখপাখালিসমেত লাইলি-মজনুর যে মিনিয়েচার পেইন্টিংটির সামনে বিমুগ্ধ নয়নে আমি দাঁড়িয়ে, সে ছবিটির অন্তরালে লুকিয়ে আছে এমন নানা দেশের চিত্রকরের মিথস্ক্রিয়ার যৌথ যজ্ঞ।

সেই বালকের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, এই ছবিগুলো আঁকিয়ে আনা হয় আশপাশের গ্রাম থেকে। গাঁয়ের মেয়েরা এমন একটি ছবি আঁকতে সময় নেয় কয়েক দিন। প্রথমে পেনসিল দিয়ে প্রাথমিক অবয়ব এঁকে দেয় পাকা আঁকিয়ে কেউ। তারপর মেয়েরা বসে সেই লাইনগুলোর ওপর সূক্ষ্ম তুলির ব্রাশ বুলিয়ে দেয়। ওদের কাছে এটাই একধরনের কুটিরশিল্প। রুটিরুজির পথ। এমন একটি অপূর্ব ছবির দাম পশ্চিমা দেশে অন্তত শ দুয়েক ডলার তো হবেই, এমনকি বাংলাদেশেও হাজার পাঁচ-ছয়ের কম হবে না। অথচ এই বালক আমার কাছে দাম চাইল মাত্র পনের শ টাকা। টাকাটা ওকে বুঝিয়ে দিলে ছবিটি খুব যত্ন করে প্লাস্টিক পেপারে মুড়ে আমাকে হস্তান্তর করে।

মাদ্রাসা চত্বর থেকে বেরিয়ে আসার পর সাউরি বলে, ‘এখানেই আশপাশে কোথাও বহু পুরোনো এক ইহুদিপাড়া আছে। সেখানে একবার যাওয়া যেতে পারে।’ আমরা ওর বইয়ে থাকা ম্যাপ অবলম্বন করে পথ হেঁটে পুরোনো শহরের উপান্তে এক গলির মুখে ঢুকি। তবে সেই গলিটিই ইহুদিপাড়া কি না, সেটি নিশ্চিন্ত হতে পারি না। তখন দেখি পেছনে ব্যাকপ্যাক নিয়ে আমাদের দিকেই হেঁটে আসছেন এক শ্বেতাঙ্গ বুড়ো। বয়সের তাল সামলাতে না পেরে পিঠ কিছুটা নুয়ে এসেছে। হাতে একটি হাইকিং স্টিক। মাথায় পাতলা টুপি। আমরা ভাবি, ইনি নিশ্চয়ই আমাদের মতোই ইহুদিপাড়া দর্শন শেষে ফিরে চলেছেন। সে কথা তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করাতে হো হো করে হেসে বলেন, ‘আরে ধুর বোকা! সেই ইহুদিরা কি এখনো আছে এখানে? কবেই হয়তো বসতবাড়ি বিক্রি করে দেশান্তরী হয়েছে। সেই বাড়িগুলোয় এখন সস্তা হোটেলের কারবার। আমিও উঠেছি তেমনই এক হোটেলে।’ সাউরির হাতে থাকা বইটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এরপর বলেন, ‘ওসব বইতে নানা রংচঙে কথা লেখা থাকে। বাস্তবে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশই ফক্কিবাজি।’ পকেটে হাত ঢুকিয়ে তিনি বের করেন কয়েকটি লজেন্স। মোড়ক খুলে একটি মুখে দিয়ে আমাদের দিকে বাড়িয়ে দেন বাকিগুলো। লজেন্স খেতে খেতে সেই তথাকথিত ইহুদিপাড়ার দিকে আর না এগিয়ে আমরা বরং বুড়োর সঙ্গেই কিছুটা পথ হাঁটি। জানতে পারি, তিনি মূলত আমেরিকার নেভাডা অঙ্গরাজ্যের রেনো শহর নিবাসী। যৌবনে নৌবাহিনীতে ছিলেন। সেই সূত্রে কিছু দেশ ঘুরতে গিয়েই দেশভ্রমণের নেশা তাকে পেয়ে বসে। এ পর্যন্ত ঘুরেছেন নিরানব্বইটি দেশ। শততম দেশ কোনটি হতে পারে, এ নিয়ে তিনি আমার কাছে পরামর্শ চান। সঙ্গে আবার শর্ত দেন, এমন একটি দেশের নাম প্রস্তাব করতে হবে, যে দেশে গমন সহজ নয় মোটেও। আমি বুড়োকে বেকায়দায় ফেলার জন্য বলি কিউবা। তিনি হাসতে হাসতে বলেন বছর দুয়েক আগে মেলা কাঠখড় পুড়িয়ে কিউবা ভ্রমণও সমাপ্ত করে এসেছেন। তবে আর কী? মে বি নর্থ কোরিয়া? এ প্রস্তাবটা তার মনে ধরে। আমার পরামর্শ তিনি বিবেচনা করবেন জানিয়ে বলে চলেন, লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে এক অদ্ভুত ক্লাব আছে। যারা ১০০টি দেশ ভ্রমণ করেছে, তারাই কেবল সেই ক্লাবের সদস্য হতে পারে। বিশ বছর ধরে তার স্বপ্ন, সেই ক্লাবের সভ্য হবেন। এই আটষট্টি বছর বয়সে অবশেষে তিনি সেই দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন পূরণের পথে। বলতে বলতে তার চোখ দুটো জুলজুলে হয়ে ওঠে।

বুড়ো যে স্থানে এসে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভিন্ন পথে হাঁটা ধরেন, তার পাশেই ইমাম গাজলি মসজিদ। হয়তো তখন জোহরের ওয়াক্ত। মসজিদের সামনে যে চওড়া বারান্দা, সেখানে মুয়াজ্জিন দাঁড়িয়ে আজানের তরঙ্গায়িত ধ্বনিকে চারদিকে ছড়িয়ে দিলেন। শুধু এই মসজিদই নয়, এ দেশে আসা অবধি আরও দু-একটি মসজিদে খেয়াল করেছি, আজান দেওয়া হয় খালি গলায়, কখনো মিনারে দাঁড়িয়ে। মাইকের সাহায্যে নয়। এর পেছনের কারণটি হলো ইসমাইল কারিমভের নিষেধাজ্ঞা। কারিমভ ছিলেন উজবেকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি। মৃত্যুর আগ অবধি ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। কারিমভের নেতৃত্বে উজবেকিস্তান যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হয়, তখন মধ্য এশিয়ায় চলছে টালমাটাল সময়। আফগানিস্থান থেকে তখন বেনো জলের মতো ভেসে আসছে মুজাহিদিনরা। আসছে অস্ত্র। আসছে বিদ্রোহ। কারিমভ সরকার ভয় পেয়ে গেল। তাজিকিস্তানের সঙ্গে বর্ডার সিল করে দেওয়া হলো। সেই সঙ্গে ধর্মাচরণের নানা পথে দেওয়া হল বিধিনিষেধ। কারিমভের মৃত্যুর পর অবশ্য ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে পরিস্থিতি। তবে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড কিংবা সিদ্ধান্তের পরও এ দেশের বহু মানুষের কাছেই কিন্তু কারিমভ এখনো এক নমস্য ব্যক্তিত্ব। দু-একজন যাকেই জিজ্ঞেস করেছি, সেইই বলেছে, হি ইজ আওয়ার হিরো। উজবেকিস্তানের সমৃদ্ধি, স্বাধীনতা আর স্থিতিশীলতা—সবই তার অবদান। সমরখন্দের প্রখ্যাত খোজা খিজির মসজিদসংলগ্ন তার সমাধি কমপ্লেক্সটিতে গিয়েও কারিমভের জন্য মানুষের রয়ে যাওয়া ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতার প্রমাণ পেয়েছি। দেখেছি-খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা বৃদ্ধারা এসেছেন কবর জিয়ারত করবেন বলে, আর অপেক্ষাকৃত তরুণরা দূরদূরান্ত থেকে কড়া রোদ মাথায় নিয়ে এসেছে শুধু তাঁর সমাধিতে কিছু ফুল তর্পণ করবে বলে।

আমি আর সাউরি এবারে পুরোনো শহর ছাড়িয়ে বুখারা দুর্গের পানে চলি। দুর্গের সীমানাপ্রাচীরগুলো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ফুলেফেঁপে এসে মাটিতে মিশেছে। আর সেখানটায় কয়েকটি প্যারাম্বুলেটর গাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে—শিশু নয়, রুটির বোঁচকা। বাচ্চা কয়েকটি মেয়ে হিমজব্দ বায়ুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মাথার চারদিকে কাপড় পেঁচিয়ে পাকা দোকানির মতো বেচে চলেছে ঘরে তৈরি রুটি। তাদের কিছু দূরে দাঁড়িয়ে এক উটওয়ালা। গায়ে আলখাল্লা, মাথায় পেঁচিয়ে রাখা পাগড়ি। চোখে এ পোশাকের সঙ্গে বেমানান কালো চশমা। ১০০ সোমের বিনিময়ে তিনি তাঁর পালিত উটের পিঠে কিছু সময়ের জন্য ওঠার অনুমতি দান করেন। এই উটগুলো কিছুটা বিচিত্র। পিঠে দুটি কুঁজ। সারা গায়ে ভেড়ার লোমের মতো পশম। ব্যাকট্রিয়ান জাতের এই উটগুলো একমাত্র মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতেই দেখা যায়। আর কোথাও নয়।

পাকস্থলীর প্যাঁচের মতো সরু কিছু সড়ক ঢুকে গেছে দুর্গের অভ্যন্তরে। সেই ঢালু সড়ক বেয়ে ওঠার সময়ে উল্টো দিক থেকে আসা একপাল ছেলেমেয়ের জন্য আমাদের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াতে হয়। ওরা একটু দূর গিয়ে আবার ফিরে আসে। দলটির সঙ্গে থাকা ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, এরা তাঁর ছাত্রছাত্রী। বুখারার কাছের এক গ্রাম থেকে বেড়াতে এসেছেন। ছাত্রছাত্রীদের ইতিহাসের পাঠ দিচ্ছেন বেড়ানোর ছলে। তাঁর দলের ছেলেমেয়ের সাধ হয়েছে আমাদের সঙ্গে একটি ছবি তুলবে। উজবেকিস্তানে এ অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম নয়। আগেও দেখেছি, হুট করে কেউ রাস্তায় থামিয়ে বলেছে, তোমার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে পারি? বেশ লাগে তখন। নিজেকে কিছুটা সেলিব্রেটি মনে হয়।

দুর্গের ভেতরটায় খোলা এক চিলতে জায়গা। একপাশে ছোট্ট জাদুঘর। সেখানে আছে বুখারার সাবেক আমিরদের সংগৃহীত প্রাচীন কোরআন শরিফের কিছু কপি। জাদুঘরে ঢোকার মুখে কয়েক ফেরিওয়ালা রঙিন সুতোয় নকশা করা কিছু চাদর নিয়ে বসেছে বিক্রির আশায়। আর তাদের পাশে এক ছবির কারবারি। সকালের সেই বালকটির মতোই এর কাছেও শত শত মিনিয়েচার পেইন্টিংয়ের ভান্ডার। সিল্ক রোড বেয়ে চলা উটের কাফেলা, বাবরের দরবারে কবিদের সভা, বুখারার নবাবের শিকারযাত্রা, তৈমুর লংয়ের বিজয় অভিযান—এমন কত কাহিনি যে ফুটে উঠেছে সেসব চিত্রের জমিনে। সাউরি সেই ছবির ভান্ডারের সামনে যাওয়ার আগেই আমাকে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘আমার ওই সিল্ক রুটের ছবিটা কেনার শখ হয়েছে। আমি কোথা থেকে এসেছি জিজ্ঞেস করলে আমি কিন্তু বলব, কম্বোডিয়া থেকে। তুমি আবার মুখ ফসকে বলে ফেলো না আমি জাপানি।’ আমি কিছুটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালে এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলে, পৃথিবীর বহু অঞ্চলের মানুষের কাছেই কম্বোডিয়া কিছুটা অজানা দেশ। ধনী না গরিব দেশ, মানুষ জানে না। একই সঙ্গে তারা জাপানকে জানে ধনী দেশ হিসেবে। কাজেই জাপানের কথা বললেই অনেক সময়ে সওদার কারবারি এক লাফে জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণ বাড়িয়ে বলে। সাউরি এযাবৎ ভ্রমণ করেছে মোট ৪২টি দেশ। পৃথিবীর বহু জনপদ হয়েছে ওর দৃষ্টিগত। তাই ওর অভিজ্ঞতালব্ধ যুক্তিকে হেলাফেলা করার উপায় আমার নেই। আমি হাতের ইশারায় অভয় দান করে সেই ছবির দোকানের দিকে এগিয়ে যাই।

সাউরির অনুমান কিন্তু মিথ্যে ছিল না। সেই অস্থায়ী ছবির দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দোকানির প্রথম প্রশ্ন, কোন দেশ থেকে এসেছেন? কম্বোডিয়া—শুধু এটুকু বলে সাউরি চোরা চোখে আমার দিকে তাকায়। ওদিকে আমার পানে দোকানির সকৌতূহলী দৃষ্টি। যে দৃষ্টির মানে হচ্ছে, এই পীত দেশীয় রমণীয় সঙ্গে ভারতীয় চেহারার এই যুবক জুটে গেল কী করে? তাকে বেশি ভাবার সুযোগ না দিয়ে সাউরি সেই সিল্ক রোডের মিনিয়েচার পেইন্টিং নামিয়ে আনতে অনুরোধ করে। দুই থামের মাঝে রশি ঝুলিয়ে তাতে ক্লিপের সাহায্যে ছবিগুলো আটকে ছিল। বিশেষ সেই ছবিটি নামানোর সময়ে বিক্রেতা জানায়, ওই একই কাহিনিকে উপজীব্য করে আরও অন্তত দুডজন ছবি আছে তার কাছে। সেগুলো ডিসপ্লেতে নেই। আছে তার বসার স্থানের পাশে রাখা ঝোলার ভেতরে। সেগুলোও সে সাউরিকে দেখাতে চায়। ছবিগুলো একই বিষয়ে আঁকা হলেও সূক্ষ্মতার তারতম্য রয়েছে। রয়েছে রঙের ব্যবহারের পার্থক্যও। আর দামটাও সে হিসাবেই কমবেশি। চোখের শক্তি পরীক্ষা করাতে চক্ষুবিশারদের কাছে গেলে তিনি যেমন করে এক বাক্স লেন্স একের পর এক পরখ করিয়ে বলেন, এটা ভালো নাকি আগেরটা, ঠিক তেমনি এই ছবি বিক্রেতাও সেই দুডজন ছবি একে একে উপস্থাপন করে জানতে চায়, এটা বেশি ভালো লাগছে? নাকি আগেরটাই ঠিক ছিল?

খানিক দরাদরি করে অপূর্ব সুন্দর একটি মিনিয়েচার পেইন্টিং বাগানোর পর আমরা ফিরে আসি পুরোনো শহরের বিষণ্ন গলিতে। সেখানে গম্বুজওয়ালা এক হলদেটে বাড়ি নিজেকে পুরু দেয়ালে মুড়িয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় পরিত্যক্ত বাড়ি। যদিও কাছে যাওয়ার পর ভেতরের গুমোট স্থানে জ্বলে থাকা কয়েকটি টিউব লাইটের আলো দেখে আন্দাজ করা যায়, বাড়িটি পুরোপুরি জনহীন নয়। ওদিকে এমনও নয় যে সে বাড়ি আগলে আছে কোনো সদর দরজা। অবারিত গমনপথের সন্ধান পেয়ে ভেতরে ঢুকতেই পা ডুবে যায় মাখনের মতো মোলায়েম কার্পেটের আবেশে। কার্পেটে বুনে রাখা লতানো মঞ্জরি যেন পা’কে পেঁচিয়ে ধরতে চায়। শুধু পায়ের নিচের এই কার্পেটই নয়, ভেতরে টিমটিমে আলো জ্বলা ঘরে ঝুলে রয়েছে আরও কয়েকটি। তবে সেগুলোয় বুনে থাকা পত্রপল্লব এখনো পূর্ণতা পায়নি। সেই পূর্ণতা প্রদানের কাজটি নীরবে সারছেন কয়েক রমণী। কার্পেটের অপূর্ণ অংশকে নিজের কোমরের কাছে টেনে এনে তাতে অদ্ভুত নিপুণতায় ফুটিয়ে তুলছেন নানা নকশার প্রকাশিতব্য রূপ।

কার্পেটের দোকানের পাশেই একটি ক্যাফে। বহু ওপরে ছাদের ঘুলঘুলি থেকে ঠিকরে আসা খানিক আলো সেই ক্যাফেকে কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন থেকে বাঁচায়। এ ক্যাফেটির কোনো সীমানাদেয়াল নেই। ওই যেখানে কার্পেটের দোকান শেষ, সেখান থেকে পরের পিতলের তৈজসের দোকান অবধি এর অধিষ্ঠান। এমন শীতার্ত দুপুরে এখানে বসে কিছু মিছু খেলে হয়তো মন্দ হয় না। আমি তাই এক পট চায়ের সঙ্গে অর্ডার করি চিজ কেক, আর সাউরি চেয়ে নেয় ভেজিটেবল সামসা। সামসা মানে ওই আমরা যাকে সমুচা বলি আরকি। এ অঞ্চলে ওটা সামসা, আর পাশের দেশ কিরগিজস্তানে ওটা সামসি।

ধবধবে সাদায় নীলচে নকশা আঁকা পটে চা আসে। পাতলা লিকারের চা। সঙ্গে দুটো পেয়ালা। পট থেকে চা ঢালার সময় সাউরি হঠাৎ বলে, ‘দুদিন আগে সমরখন্দে এমন এক ব্যাপার দেখেছি, তারপর ভেবেছিলাম এ যাত্রায় আর কোনো ব্যাটাছেলের সঙ্গে আলাপ জমাব না। কিন্তু তোমার সঙ্গে কী করে যেন মিতালি হয়ে গেল। প্রতিজ্ঞা ভাঙতে হলো আমাকে।’ স্বভাবতই ব্যাপারখানা কী, সেটি বলার জন্য আমি ওকে চেপে ধরি। কিছুটা ইতস্তত করে ও বলে, ‘সেদিন সমরখন্দের রেজিস্তানে কমপ্লেক্সে ঘোরার সময় এক স্থানীয় উজবেক যুবক যেচে এসে আমার সঙ্গে পরিচিত হয়। তারপর সন্ধ্যার দিকে বেশ খাতির করে নিয়ে যায় এক পাবে। আমাকে কিছু হার্ড ড্রিংকস কিনে দেয়। নিজে অবশ্য নিল শুধু পেপসি।’ এটুকুতেই আমি ঘটনা কিছুটা আঁচ করতে পারি, তাই কৌতূহল চাপতে না পেরে এ পর্যায়ে ওকে থামিয়ে বলি, ‘ছেলেটি কি তোমাকে মাতাল বানানোর মতলবে ছিল? সো দ্যাট হি ক্যান টেক সাম অ্যাডভান্টেজ?’ চায়ের কাপটি টেবিলে নামিয়ে রেখে ও বলে, ‘কিন্তু আমি এত সহজে মাতাল হই না। আমার এসবে ভালো অভ্যাস আছে।’ তারপর কি যেন মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে নিজের পার্স ব্যাগটি খুলে ও বের করে আনে নিজের মোবাইল ফোন। তারপর কিছু একটা খুলে আমার দিকে ফোনটি বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘ম্যাসেজটা পড়ে দেখো। সেদিন হোটেলে ফেরনোর পর ছেলেটি পাঠিয়েছিল।’ আমি ওর হাত থেকে ফোনটি নিয়ে দেখি সে ম্যাসেজে লেখা, আই ওয়ান্ট সেক্স। বোঝা যায়, ছেলেটির ইংরেজি জ্ঞান খুব গভীর নয়, তাই যৎসামান্য শব্দ যা জানে তাই দিয়ে মনের আসল কুমতলবটি ভণিতা না করেই বলে দিয়েছে। ফোনটি ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার সময়ে লক্ষ্য করি, সাউরির মুখের মাংসপেশিতে ফুটে উঠেছে নিখাদ ঘৃণাময় অভিব্যক্তি। অপ্রীতিকর প্রসঙ্গটি এড়ানোর জন্য বলি, ‘সো, ডু ইউ হ্যাভ এনি বয়ফ্রেন্ড?’ ‘ওয়েল’...কণ্ঠে খানিকটা সংশয় জাগিয়ে ও বলে, ‘আই ডোন্ট নো। ইটস আ বিট কম্পলিকেটেড। একজন আছে। ও থাকে টোকিওর বাইরে। শনিবার করে দেখা হয় আমাদের। একসঙ্গে লাঞ্চ করি, ওয়াইনের গ্লাসে ডুবে যাই। কিন্তু সম্পর্কের ব্যাপারে আমরা সিরিয়াস নই। চলছে, চলুক ধরনের সম্পর্ক।’ এ কথা বলে ও হাতের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটি অন করে। তারপর কী একটা বের করে ফোনটি আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বলে, এটা দেখো। পূর্বের অভিজ্ঞতাটির কারণে এবারে আমি কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকাই। তবে এবারে কিন্তু সেখানে ভেসে উঠেছে একটি শিশুর ছবি। কম্বলের পুঁটুলি জড়িয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। আমি মুখ তুলে তাকাতে সাউরি বলে, ‘আমার বোনের মেয়ে। বোন আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট। এই ভাগনি হওয়ার পর এখন মা আমাকে জ্বালিয়ে মারছে। তোমার ছোট বোন বিয়ে করে সন্তানের মা হয়ে গেল, আর তুমি কী করছ? ফোন করলেই মায়ের এই এক প্রশ্ন। আচ্ছা বলো তো পৃথিবীর সবাইকেই ওই এক নিয়ম মেনে বিয়ে, সংসার, সন্তানের চক্রে ঢুকতে হবে—এমন দিব্যি কে দিয়েছে?’

ক্যাফেতে চা পান পর্ব শেষ হলে আমরা সাউরির হোটেলের সন্নিকটে এক বাঁধানো পুকুরের পাড়ে এসে বসি। এখন আকাশের মেঘলা ভাবটা কিছুটা কমেছে। সূর্যের নিষ্প্রভ আলো কিছুটা হলেও ঠিকরে আসায় হিমভাব কিছুটা দূরীভূত। আমাদের পাশের পুকুরের সবুজাভ জলে ঝকঝকে প্রতিবিম্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একহারা একটি মালবেরিগাছ। যদিও সে প্রতিবিম্ব মাঝেমধ্যেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে কয়েকটি রাজহাঁসের অবাধ সাঁতারে। পুকুরের পাড় ঘেঁষে লিয়াবি হাউস রেস্টুরেন্টের বেঞ্চ। পুকুরের জল আর সেই বেঞ্চের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাতলা একফালি পর্দা। আমাদের অনতিদূরে এক ফেরিওয়ালা বিক্রি করছেন নানা আকারের কাঠের ‘দুতরা’। আমরা যেটিকে বলি দোতারা, ওরা সেটিকেই বলে দুতরা। পুকুরের কোণের দিকে শহরের বিরাট ম্যাপ। সেখানে একটা জটলামতো। কালোর মাঝে জরির কাজ করা টুপি পরে বেশ কয়েক বৃদ্ধ সেই ম্যাপের সামনে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে নিজেদের মধ্যে কিছু আলাপ করছেন। হয়তো ছুটির দিনে কাছেপিঠের গ্রাম থেকে বুখারা নগরে ঘুরতে এসে খুঁজে নিচ্ছেন পথের হদিস। ওদের এই পথ খুঁজে নেওয়া দেখেই হয়তো এ প্রশ্ন আমার মনে আসে, ‘কখনো পথ হারিয়েছ সাউরি? বিয়াল্লিশটি দেশে ঘুরতে গিয়ে কখনো কি মনে হয়নি ভুল পথে ভ্রমণ করে এসেছি ভুল ঠিকানায়?’ আমার প্রশ্ন সাউরিকে ভাবায়। বেশ কিছুক্ষণ ও ডুবে থাকে স্মৃতিরোমন্থনে। আমি ওকে ভাবার সময় দিয়ে পুকুরের কিনার ঘেঁষে খেলান গাড়ি নিয়ে ছুটে চলা এক বালকের দিকে তাকিয়ে থাকি। ‘বছর কয়েক আগে এক অদ্ভুত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম।’ সাউরির জবাবে ওর দিকে দৃষ্টি ফেরাই ‘কয়েক বছর আগে গিয়েছিলাম আমেরিকায়। অ্যারিজোনার সেডনা শহরে। রেড রক ক্যানিয়ন দেখতে। পরিকল্পনা ছিল সেডনা থেকে ফিনিক্স হয়ে ফ্লাই করব মেক্সিকোর কানকুন শহরে। সেখান থেকে হয়তো যাব বেলিজে। কিন্তু কানকুনে গিয়েই টের পেলাম কিছু একটা হয়েছে আমার। অসম্ভব কাশি, পুরো শরীর যেন নিস্তেজ। মনে হচ্ছিল, আমি যেন ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছি।’

‘ডু ইউ থিংক ইট ওয়াজ সাম কাইন্ড অব ফ্লু? সাউরি নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানায়। তারপর কিছুটা নিচু স্বরে বলে, ‘তুমি জানো কিংবা বিশ্বাস করো কি না জানি না, সেডনায় কিন্তু একধরনের অতিপ্রাকৃত শক্তি আছে। আমার বদ্ধমূল ধারণা, সেই শক্তিই আমাকে কাবু করে ফেলে।’ সেডনায় আমি এর আগে গিয়েছি, কিন্তু এমন কোনো অদ্ভুত শক্তির কবলে পড়ে নাজেহাল হইনি। আমার দৃষ্টিতে অবিশ্বাসের সনির্বন্ধ উপস্থিতি দেখে সাউরি যোগ করে, ‘তারপর কী করে সেরে উঠলাম জানো? বলতে পারো, সেও এক দৈবযোগ। কানকুনের হাসপাতালে গিয়ে ওষুধ খেয়েও যখন কাজ হচ্ছিল না, তখন একদিন হঠাৎ পথের পাশে সন্ধান পাই এক তান্ত্রিক ধরনের রমণীর। ছোট্ট এক দোকান খুলে ব্যবসা করেন। ভদ্রমহিলা আমার গলার নিচটায় কী যেন এক তরল মাখিয়ে কিছুক্ষণ মাসাজ করে দেন।’ গলার নিচটায়—বলার সময়ে সাউরি ওর কণ্ঠহারের কাছটায় হাত বুলায়। সমরখন্দের উলুবেগ মানমন্দিরে রক্ষিত দিক পরিমাপক গোলকের মতো দেখতে একখানা পেন্ডেন্ট সোনালি চেইনের সঙ্গে বন্দী হয়ে ঝুলে রয়েছে ঠিক সেখানটায়। ‘অদ্ভুত কাণ্ড হলো’—আগের কথার খেই ধরে সাউরি বলে, ‘তারপর ভোজবাজির মতো সেরে উঠি আমি। জাপানে ফেরার পর নিজেকে বহুবার প্রশ্ন করেছি, কেন গেলাম আমি সেডনায়? তবে কি মৃত্যু আমায় ছলনা করে সেখানে ডেকে নিয়ে ফাঁদে ফেলার মতলবে ছিল?’

বছর কয়েক আগে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনা যে আজও ওর মানসপটে আতঙ্কের মেঘ এক ঝটকায় এনে দেয়, সেটি আমি খুব বুঝতে পারছি। আরও বুঝি, যখন সাউরি কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর কিভা শহরে যাত্রাসঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসে। আজই বিকেলে ও কিভায় রওনা হবে। হোটেলের ম্যানেজার একটি ট্যাক্সি ঠিক করে দিয়েছে। তবে বলে দিয়েছে, এখান থেকে কিভায় যেতে পাঁচ নয়, প্রায় সাত ঘণ্টার প্রয়োজন পড়বে। এতটা পথ একা ট্যাক্সিতে যাওয়া কিছুটা ভীতিকর তো বটেই। মাঝে আবার কয়েক শ মাইল আছে, যেখানে কোনো শহর নেই, আছে কেবল ধু ধু প্রান্তর। সন্ধ্যার পর সেখানে কিছু হলে ঈশ্বর ছাড়া আর কারও পক্ষে সাক্ষী থাকা সম্ভব নয়। ওদিকে আমার কাল বুখারায় থাকার হোটেল আর ফেরার ট্রেনের টিকিট বুকিং হয়ে আছে। কিভায় গেলে বেশ কিছু পয়সা জলে যায়। তবে মেয়েটি যেহেতু এত করে বলছে, ওর অনুরোধকে অগ্রাহ্য করতেও রীতিমতো কুণ্ঠা হচ্ছে। আমি বুঝতে পারি, খুব দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হবে আমাকে।