Thank you for trying Sticky AMP!!

ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ নজরুলের ওমর খৈয়াম

মৃত্যুর ৮৮৮ বছর পরেও দোর্দণ্ড প্রতাপে বেঁচে আছেন ওমর খৈয়াম। গত শতকের ত্রিশের দশকে বাংলা ভাষায় এই কবির অমর কাব্য রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম অনুবাদ করতে শুরু করেন নজরুল। আর এর মাধ্যমে বাঙালিও বিশদভাবে পরিচিত হয় পারস্যের এ কবির সঙ্গে। ১৮ মে উদ্​যাপিত হলো ওমর খৈয়ামের ৯৭১তম জন্মদিন। এ লেখায় আছে ওমর ও নজরুলের প্রবণতা ও যুগলবন্দী-বৃত্তান্ত
শিল্পীর তুলিতে ওমর খৈয়াম

স্থান, কাল ও ভাষাগত দিক থেকে ওমর খৈয়াম আমাদের একটু দূরের মানুষ ছিলেন, অথচ তাঁর নানান উক্তি আমাদের জীবনযাপনের অংশ হয়ে গেছে। নজরুলই বলতে গেলে দারুণভাবে তাঁকে আমাদের কাছের মানুষ করে দিয়েছেন। তিনি নিজে তো আমাদের কাছের মানুষই। বাংলায় লিখেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবিও তিনি। প্রচলিত একটি কথা আছে, ‘যদি তুমি এক জীবনে হাজার জীবন বাঁচতে চাও, তাহলে পড়ো। আর এক জীবনে হাজার জীবন বাঁচতে চাও, তাহলে লেখো।’ কিন্তু ‘লেখা’মাত্রই সেই স্থায়িত্ব পায় না। সবার সব লেখাও টিকে থাকার যোগ্যতা লাভ করে না। এই নশ্বর পৃথিবীতে ও জীবনে নিশ্চয়তা বলে কিছু নেই। ‘অনিত্যতাই এই জগতের একমাত্র নিত্যতা।’—কথাসরিৎসাগর-এর রচয়িতা সোমদেব ভট্ট–ই কেবল নন, বহুবার বহু জায়গায় বহু মনীষী বলে গেছেন এই সত্য কথা। আর যে সত্য সর্ব সত্যে মেলে, তা-ই তো প্রকৃত সত্য। কথাটি মিথ্যার দিক থেকেই মিলিয়ে দিতে পারেন কেউ কেউ: যে মিথ্যা সর্ব মিথ্যায় মিলে তা-ই প্রকৃত মিথ্যা।

এই মিথ্যার বিরুদ্ধে দুই কালের দুই দেশের দুজন মানুষ একই কাজ করেছেন—খৈয়াম ও নজরুল। নিজের অনূদিত রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম-এর ভূমিকায় স্বয়ং নজরুল লিখেছেন, ‘ওমরের রুবাইয়াৎ বা চতুষ্পদী কবিতা চতুষ্পদী হলেও তার চারটি পদই ছুটেছে আরবি ঘোড়ার মতো দৃপ্ত তেজে সম-তালে-ভণ্ডামি, মিথ্যা বিশ্বাস, সংস্কার, বিধি-নিষেধের পথে ধূলি উড়িয়ে তাদের বুক চূর্ণ করে।’

কথিত আছে, কান্তি ঘোষের রুবাই অনুবাদেই প্রথম এর জোয়ার তৈরি হয়, নরেণ দেব তা আরও জনপ্রিয় করে তোলেন, তদুপরি, কোথায় যেন একটু অভাব থেকেই যাচ্ছিল। সৈয়দ মুজতবা আলীর মতে, ‘ওমরই ওমরের সর্বশ্রেষ্ঠ মল্লিনাথ এবং কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী।’ বলে রাখা ভালো, তিনি ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত এবং কাজী নজরুল ইসলাম অনূদিত রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম-এর ভূমিকা লিখেছিলেন। তাঁর মতে, নজরুল ততটা ফার্সি জানতেন না। মুজতবা আলীর ধারণা, তিনিও অন্যদের মতো ইংরেজি থেকেই অনুবাদ করেছেন। বলা বাহুল্য, নজরুল ফার্সি ভাষাটি কতটা আয়ত্ত করেছিলেন, নানান জনের নানান লেখায় এর সবুত মিলবে। সবচেয়ে বড় কথা, যেকোনো পাঠক ইংরেজ কবি অ্যাডওয়ার্ড ফিটসজেরাল্ডের অনুবাদ এবং নজরুলের অনুবাদ করা খৈয়ামের রুবাইয়াৎ একটু খেয়াল করে পড়লেই বুঝবেন যে নজরুল ইংরেজি অনুবাদের ধারে–কাছে দিয়েও যাননি। বরং তিনি ছাড়া অন্যদের অনুবাদই ‘ফিটসজেরাল্ডের মুখে ঝাল খাওয়া’। খৈয়ামের প্রায় এক হাজার রুবাই থেকে দু শর কাছাকাছি রুবাই তিনি অনুবাদ করেছেন। মোট ১৯৭টি। তাঁর অনূদিত ১ থেকে ৩১ রুবাই ১৩৪০ কার্তিকের, ৩২ থেকে ৪৬–সংখ্যক রুবাই ১৩৪০ অগ্রহায়ণের এবং ৪৭ থেকে ৫৯–সংখ্যক রুবাই পৌষের মাসিক মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হয়।

আমরা এই দুজন কবির মেজাজ–মর্জি খেয়াল করলে দেখব, দুজনেই যাঁর যাঁর যুগের ‘বিদ্রোহী ভৃগু’। ‘ভগবান বুকে পদচিহ্ন এঁকে’ দেওয়ার হিম্মত ছিল দুজনেরই। সামাজিক অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াই ছিল প্রখর ও অপ্রতিরোধ্য। ওমর লড়েছেন তাঁর সময়ের মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে। নজরুলও তা–ই। তবে নজরুলের আরেক বিরুদ্ধ শক্তি ছিল বিদেশি সরকার। এ ছাড়া হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অসংস্কৃতবান-মোল্লা-পুরুতদের বিরুদ্ধে, জাতপাতের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার।

ফলে নজরুলের হাতেই ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ-এর সার্থক অনুবাদ হবে, সেটিই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু নজরুলের নিজস্ব ভাষ্য হলো, ‘ওমর খৈয়ামের ভাবে অনুপ্রাণিত ফিটসজেরাল্ডের কবিতার যাঁরা অনুবাদ করেছেন, তাঁরা সকলেই আমার চেয়ে শক্তিশালী ও বড় কবি। কাজেই তাঁদের মতো মিষ্টি শোনাবে না হয়তো আমার এ অনুবাদ। যদি না শোনায়, সে আমার শক্তির অভাব-সাধনার অভাব, কেননা কাব্য-লোকের গুলিস্তান থেকে সঙ্গীতলোকের রাগিণী-দ্বীপে আমার দীপান্তর হয়ে গেছে। সঙ্গীত-লক্ষ্মী ও কাব্য-লক্ষ্মী দুই বোন বলেই বুঝি ওদের মধ্যেই এত রেষারেষি। একজনকে পেয়ে গেলে আরেক জন বাপের বাড়ি চলে যান। দুই জনকে খুশি করে রাখার শক্তি রবীন্দ্রনাথের মতো লোকেরই আছে। আমার সেই সম্বলও নেই, শক্তিও নেই। কাজেই আমার অক্ষমতার দরুন কেউ যেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ওমরের উপর চটে না যান।’ উদ্ধৃত অংশে কয়েকটি বিষয় খেয়াল করার মতো, বিদ্রোহী কবির বিনয় তো বটেই, কবিতা ও সংগীত নিয়ে নিজের মত, সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সামর্থ্যের প্রতি বিপুল আস্থা, আর জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে ওমর খৈয়ামকে উল্লেখ করা।

নজরুল ওমর খৈয়ামকে কতটা ভেতর থেকে জেনেছেন, সেটি তাঁর নিজের রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম-এর ভূমিকা পড়লেই স্পষ্টভাবে টের পাওয়া যায়। আর ফার্সি ভাষা জানা? তাঁর নিজের চাচা কাজী বজলে করিম ছিলেন মস্ত ফার্সিবেত্তা। ফলে তাঁর পারিবারিক আবহের ভেতরেই ফার্সি ছিল। মুজফ্ফর আহ্​মদের কাছ থেকে আমরা জানি যে শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে নজরুলের দ্বিতীয় ভাষা ছিল ফার্সি। হাফিজ নূরন্নবী নামে সেখানে ভালো একজন শিক্ষক পেয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া পল্টনে যোগদানের পর এক পাঞ্জাবি মৌলবি সাহেবের কাছে তিনি কবি হাফিজের কাব্য পড়েছেন। ফলে হাফিজের কবিতাগুলো যেমন তিনি মূল ফার্সি থেকে অনুবাদ করেছেন, ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতগুলোও।

নজরুল লিখেছেন, ‘ওমরের কাব্যে শারাব-সাকির ছড়াছড়ি থাকলেও তিনি জীবনে ছিলেন আশ্চর্য রকমের সংযমী। তাঁর কবিতায় যেমন ভাবের প্রগাঢ়তা, অথচ সংযমের আঁটসাঁট বাঁধুনী, তাঁর জীবনও ছিল তেমন।...তিনি মদ্যপ লম্পটের জীবন (ইচ্ছা থাকলেও) যাপন করতে পারেননি। তাছাড়া ও-ভাবে জীবনযাপন করলে গোঁড়ার দল তা লিখে রাখতেও ভুলে যেতেন না। অথচ, তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুও তা লিখে যাননি।’

ওমর কবিতা লিখেছেন। আমরা সেই কবিতা পড়ে আনন্দ পাই। নিজেকে তিনি যতই ‘তত্ত্ব-গুরু’ বলুন, নজরুলেরও রস-পিপাসা মিটেছে এসব কবিতা পড়ে। কবিতায় শব্দ প্রচলিত অর্থ ছেড়ে বিচিত্রমাত্রায় দেখা দেয়। জমে ওঠে রহস্য। খৈয়াম সুরা, সাকি, শারাবসহ আরও যেসব শব্দ ব্যবহার করেছেন, এসবের শাব্দিক অর্থ করতে যাঁরা যাবেন, তাঁরা আদতে সাহিত্যের লীলা থেকে বঞ্চিতই হবেন। সাহিত্য জীবনের অকপট ভাষ্য নয়, আবার কপট ভাষ্যও নয়। এ হলো লীলালাস্যে পরিপূর্ণ জীবনরহস্যের আগার। যে কারণে একে অবলীলায় পড়ার কথা যাঁরা ভাবেন, বুঝিবা গোড়াতেই গলদ ঘটিয়ে ফেলেন তাঁরা। যখন বলা হয়, ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও/ বাকির খাতা শূন্য থাক/ দূরের বাদ্য লাভ কি শুনে/ মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।’ একালে দূরের বাদ্যকে যদি দূরের সাহিত্য ধরে এগোই, তাহলে ফাঁকের বদলে লাভের কথাটাই ভাবতে হয়। একে ইহকাল-পরকালের ব্যাখ্যায়, কী বস্তুগত ও অবস্তুগত চাওয়া-পাওয়ার ব্যাখ্যায়ও নেওয়া যায়। এই যে একই কথার অনেক দিকে নেওয়ার, অনেক দিকে যাওয়ার ক্ষমতা, সামর্থ্য—এই-ই তো সেই সাহিত্যের লীলা। আর অবলীলায় যা পড়া যায় ও লেখা যায়, তাতে লীলা থাকে না। ফলে সাহিত্য-রসও পাওয়া যায় না ততটা। যা স্পষ্ট—সরাসরি, যাতে কোনো রাখঢাক নেই, তা কতটা সাহিত্য, তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। সেই তর্ক রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম পড়তে গিয়ে আরও বড় হয়ে দেখা দিতে পারে। তাতে নজরুল অনূদিত খৈয়ামের রুবাইগুলো কেবল রসেরই নয়, বোধেরও বৈদূর্যমণি হয়ে ওঠে।