Thank you for trying Sticky AMP!!

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

সৈয়দ হকের ‘যেকোনো দরজা’ ও মনের ভেতরের উথলে ওঠা কথা

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যুদিনে প্রথমা প্রকাশনী থেকে আজ বের হয়েছে তাঁর হারিয়ে যাওয়া উপন্যাস ‘যেকোনো দরজা’। এটি তিনি লিখেছিলেন ২৬ বছর বয়সে, ১৯৬১ সালে। অনেককাল বাদে আবার সেই উপন্যাস পড়ার পর ঔপন্যাসিকের সহধর্মিণী আনোয়ারা সৈয়দ হক জানিয়েছেন তাঁর অনুভূতি।

আমার বয়স যখন ২৩ বছর তখন আমি সৈয়দ শামসুল হকের ‘যেকোনো দরজা’ পত্রিকায় পড়ি। তারও অন্তত দুবছর আগে উপন্যাসটি ‘সচিত্র সন্ধানী’তে বেরিয়েছিল। তখন পড়িনি, পড়েছি পরে। তবে ২৩ বছরে লেখাটি পড়লেও এর মর্ম সে সময় উদ্ধার করতে পারিনি। ততখানি পরিপক্বতা অর্জিত হয়নি। শুধু লেখাটি পড়ার পর সারা দিন মন খারাপ ছিল, এটুকু মনে আছে। এরপর লেখাটি কীভাবে যেন হারিয়ে যায়। পরবর্তী জীবনে বেশ কয়েকবার সৈয়দ হককে স্মরণ করিয়ে দিলে তিনিও মনে করতে পারেননি কোথায় লেখাটি বেরিয়েছিল। ফলে ‘আরে, ভুলে যাও’—এই ছিল তাঁর সান্ত্বনা বাক্য।

কিন্তু আমি ভুলিনি! আমার মনের মধ্যে সর্বদাই একটা ব্যাকুলতা ছিল লেখাটি খুঁজে পেতে। হয়তো, মনের সেই তাড়না ছিল বলেই বোধ হয় ঘটনাটি ঘটল। গবেষক অনুপম হায়াৎ অকস্মাৎ একদিন ফোন করলেন আমাকে। জানালেন, তিনি সৈয়দ হকের অগ্রন্থিত একটি ছোট্ট উপন্যাস খুঁজে পেয়েছেন। কথার প্রথমেই আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘ভাই, এটা কি কোনো কুকুরের গল্প?’

তিনি আমার কথা তখন বুঝতে পারেননি। শুধু বললেন, ‘তা কুকর? মনে হয় আছে।’
তবে আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল লেখাটি সেই লেখাই হবে। এখন যখন প্রথমা প্রকাশনী থেকে ‘যেকোনো দরজা’ বই হয়ে বেরিয়েছে, দুরু দুরু বুকে আমি মলাট খুলে দেখি, সেই গল্প। গতকাল সারা রাত জেগে বইটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়লাম। পড়তে গিয়ে মুগ্ধতার চেয়েও বিস্ময় আমার মনের পরতে পরতে খেলা করছিল। শুধু মনে হচ্ছিল, মাত্র ২৬ বছর বয়সে এ রকম একটি দর্শন কীভাবে আয়ত্ত করেছিলেন সৈয়দ হক?

নিজের সংসারে প্রতিভা ঠিকমতো চেনা যায় না। পৃথিবীর কোনো সংসারই তাদের নিজের গৃহে প্রতিভা চিনতে পারে কি না, এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ সক্রেটিস। আমার এখন মনে হয় এই একটিমাত্র বইয়ের জন্যই আমি সারা জীবন তাঁকে যত্ন করতে পারতাম!

তাঁর এই বইটির দর্শন মানুষের আত্মম্ভরিতার ভিত নড়িয়ে দেয়। এই মাত্র কদিন আগে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্তৃপক্ষ যখন কুকুর নিধন যজ্ঞে মেতে উঠল, তখন মনে হয়েছিল, পৃথিবী তার মানুষের আদি যাত্রা থেকে—যখন মানুষ কাঁচা মাংস খেয়ে বেঁচে থাকত, তার চেয়ে একচুলও এগোয়নি! এই সব ভাবনা ভাবতে সৈয়দ হকের সদ্য প্রকাশিত বইয়ের দিকে তাকাই। দেখি কত আগেই হক সাহেব ‘যেকোনো দরজা’য় সেখানে লিখেছেন:

‘যেকোনো দরজা’র প্রচ্ছদ

‘সে বলবেÑআমি মানুষ, আমি পশুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। বুঝতে পারছ, মানুষের কি ভয়ঙ্কর উক্তি এই, আমি পশু নই, আমি মানুষ। কে তাকে শেখাল পশু মানে ঘৃণিত, অভিশপ্ত, পাপে আকীর্ণ একটি অস্তিত্ব? কে তাকে বলে দিল পশুত্ব মনুষ্যত্বের বিপরীত? মনুষ্যত্ব পশুত্বের চেয়ে শ্রেষ্ঠ? পশুকে উন্নত বুদ্ধির উপযুক্ত করে গড়ে তোলেনি প্রকৃতি। সে তার ইনস্টিংক্ট ফলো করছে। বুঝতে পারছ, সে তার বেঁচে থাকার জন্যে রক্তের ডাক শুনে ব্যবহার করে যাচ্ছে মাত্র! তুমি কে তার বিচার করবার? তুমি কোন মানদণ্ডে মেপে দেখলে যে সে পশু, ঘৃণার পাত্র? কোন মানদণ্ডে? তোমার মানদণ্ড। তুমি মানুষ, তুমি তোমার মানদণ্ডে বিচার করতে চাও পশুকে? এর চেয়ে নির্বুদ্ধিতা আর কী হতে পারে? তুমি মানুষ, বেঁচে থাকার ভিত্তিতে তোমার ধর্মনীতি, তোমার সমাজনীতি, তোমার অর্থনীতি, তোমার তামাম নীতি গড়ে নাওনি? তাতে কেউ তো তোমার মনুষ্যত্বকে তিরস্কার করতে বসেনি। করলে বোধ হয় তার গলা টিপে মারতে। সেই তুমি, মানুষ নামক আরও একটি জন্তুর মুখ উজ্জ্বল করা বংশধর, তুমি কিনা পশুর পশুত্বকে দেখলে হীন করে? আত্মপ্রসাদ আর অহমিকা তোমাকে অন্ধ করেছে পাঁচ হাজার বছর আগে, যেদিন তুমি প্রথম নিজেকে মানুষ বলে চিনতে পেরেছিলে! জাহান্নামে যাক সেদিন।’

আবার এক জায়গায় লেখা আছে, ‘কুকরগুলো ঠাসাঠাসি করে আছে, জিব বের করে হাঁফাচ্ছে, ভেতর থেকে...আর্তনাদ করছে...অসংখ্য থাবা জালের ফাঁক দিয়ে বাইরে ঝুলে পড়েছে।...অসংখ্য থাবা। একটা নয়, দুটো নয়, প্রত্যেকটা ফাঁক দিয়ে এক শ দু শÑঅসংখ্য থাবা। সেই থাবাগুলো প্রসারিত হলো আমার দিকে। জমাদার হেসে বলে গেল, ইয়ে সব কুত্তা হ্যায়, মালিক। ‘কুকুরগুলোকে নিধন করবার জন্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বধ্যভূমির দিকে।’

আবার আরেক জায়গায় লেখা আছে, ‘আমি একা হাঁটু গেড়ে ক্ষমা চাইলে যদি হাজার বছরের কোটি কোটি মানুষের অহংকারের প্রায়শ্চিত্ত হতো, তো এই আমি হাঁটু গেঁড়ে বসছি—এই আমি বলছি, আমি মানুষ, জন্ম থেকে জন্মে আমি যে অপরাধ করেছি, তা ক্ষমা করে দাও।...আমি তোমাকে আমার উন্নত বুদ্ধির বড়াই নিয়ে নিন্দা করব না, আমার ভাষা থেকে পশুর সমস্ত অর্থ মুছে ফেলে দেব। আমি বলব, পশু হচ্ছে প্রাণ, যেমন এ প্রাণ আমার; বলব, পশু হচ্ছে অস্তিত্ব, যেমন এ অস্তিত্ব আমার। আমাকে ক্ষমা করো।’

সৈয়দ শামসুল হক

সবশেষে বলতে চাই ‘যেকোনো দরজা’ বইটি এমন সময়ে বেরোল, যখন দক্ষিণ ঢাকায় অবোধ কুকুর নিধন চলেছে, যে কুকুর মানুষের চেয়ে হাজার গুণ বিশ্বস্ত এবং প্রাণবিক (ইচ্ছা করেই এই শব্দ ব্যবহার করলাম, যেহেতু মানবিক শব্দটি এখানে মানায় না), যে কুকুর চুরি করে না, মিথ্যা বলে না, গরিবের ধন লুট করে না, মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয় না, কালোবাজারি করে জিনিসের দাম বাড়ায় না, নকল ওষুধে বাজার সয়লাব করে না, করোনার সময় ইচ্ছেমতো মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করে না, নকল টেস্ট করে মানুষকে ধোঁকা দেয় না, সেই কুকুরকে মেরে ফেলার জন্য এলাকার মানুষেরা—কি নারী, কি পুরুষ—কুকুর নিধনের জন্য মিছিল করছেন, শত শত প্রাণকে নিহত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন, যেহেতু নিধনের অস্ত্র তাঁদের হাতেই আছে।

আমাদের সেই গভীর পাপ স্খলের জন্যই বিধাতা যেন এই সময়ে পাঠককের হাতে তুলে দিলেন সৈয়দ শামসুল হকের এই বইটি। জীবনের বড় একটা সময় সৈয়দ হক কাটিয়েছেন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন পুরান ঢাকায়। তাই বলতে পারি, এ হয়তো জীবনের ওপার থেকে এই সংবেদী শিল্পীর সোচ্চার প্রতিবাদ।

কে জানে, যে লেখা আমি সারাটা জীবন খুঁজে বেড়িয়েছি, তা হয়তো এই সময়ের জন্যই তোলা ছিল! সাহসী জয়া আহসানকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্যই অপেক্ষা করছিল হয়তো এই লেখাটি। নাট্যশিল্পী নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের হয়তো এই লেখাটি বলতে চেয়েছিল, সত্য কখনোই পেছনে চাপা পড়ে থাকে না। ন্যায় কখনোই বিপথগামী হয় না। যাদের হাতে অবোধ প্রাণীর বেঁচে থাকা নির্ভর করে, তারা কখনোই রাক্ষস হতে পারে না। কারণ পশু হচ্ছে প্রাণ। আর প্রাণই হলো অস্তিত্ব, যা নিধন করে ফিরিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য মানুষের নেই।

আমরা কি মানুষ? যদি মানুষ হই, তাহলে আমাদের ভাবতে হবে, কেন আমরা মানুষ?
সৈয়দ হকের ‘যেকোনো দরজা’ পড়তে পড়তে এসব কথা কেন জানি মনের ভেতর উথলে উঠল!

অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com